সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা

#কেয়া_চ্যাটার্জি

প্যারিস পর্ব


• #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে








১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস্তার লাভ করেনি তখন শহরের পশ্চিমাংশ শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ তৈরি করেন একটি দুর্গ। দুর্গটির নাম ল্যুভর। পরবর্তীকালে, আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা প্রথম ফ্র্যান্সিস এই দুর্গকে একেবারে ভেঙে ফেলে রেনেসাঁ স্টাইলের নতুন একটি প্রাসাদ তৈরি করেন যা রাজবংশীদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথম ফ্র্যান্সিস যেমন একাধারে ছিলেন সুশাসক তেমনি ছিলেন শিল্প সংগ্রাহক। তিনি এই প্রাসাদে মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিসহ বহু বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবি ও মূর্তি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ‘মোনালিসা’। প্রথম ফ্র্যান্সিসের পরে দ্বিতীয় হেনরি ও নবম চার্লসের আমলেও এই প্রাসাদের অনেকগুলি অংশ নির্মাণ ও পুনর্নির্মিত হয়। তবে ল্যুভর প্রাসাদ গড়ে ওঠার নেপথ্যে রাজা ত্রয়োদশ লুই ও রাজা ষোড়শ লুইয়ের অবদান সবথেকে বেশি। 

  ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য ষোড়শ লুই রাজপ্রাসাদ ল্যুভর থেকে ভেরসিলিতে স্থানান্তরিত করেন। তখন এই প্রাসাদটি একাধারে আর্ট মিউজিয়াম এবং অন্যদিকে শিল্পীদের স্টুডিও ও বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয় গঠনগত কিছু কাজের জন্য। আবার নতুনভাবে খোলা হয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে নেপলিয়নের রাজত্বকালে। নেপলিয়ন নানা দেশ জয় করে ফেরার সময় সেখানকার শিল্প কর্মগুলি লুঠ করে নিয়ে আসতেন। সেই লুঠ করা জিনিসের অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া হলেও, থেকে যায় আরও অনেক কিছু। ল্যুভর মিউজিয়ামে আজও অবস্থিত ইজিপ্টের বহু হাতের কাজ ও শিল্পকর্মের নিদর্শনগুলি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ল্যুভরের প্রচুর শিল্পকর্ম লুকিয়ে রাখা হয় নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তা সত্ত্বেও নাৎসিরা এই প্রাসাদ নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য খুলে নেয়। বহু বছর পরে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেঞ্চ সরকার এই প্রসাদটিকে সম্পূর্ণরূপে একটি মিউজিয়াম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে ল্যুভর মিউজিয়ামের ৬৫২,৩০০ স্কোয়ার ফিট জমিতে প্রায় ২০০ জন শিল্পীর ৩৫০০০ শিল্পকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগ পর্যটক আসেন শুধুমাত্র ‘মোনালিসা’কে দেখতে। ইতালিয় চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে দেহাবসান হলে তাঁর আঁকা এই ছবিটি যা প্রথম ফ্র্যান্সিস অনেক আগেই কিনে নিয়েছিলেন ল্যুভরের দেওয়ালে সাজিয়ে রাখেন। নেপোলিয়ন এটিকে নিয়ে যান নিজের শয়ন কক্ষে। ফ্রাঙ্কো প্রাশিয়ান যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটিকে লুকিয়ে রাখা হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চুরি হয় মোনা লিসা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরুদ্ধারের পরে আবার ছবিটি শোভা পায় ল্যুভরের দেওয়ালে। 

  ল্যুভরের এই ইতিহাস জানা যায় মিউজিয়ামের অডিও গাইডের মাধ্যমে। এছাড়াও, মিউজিয়ামের নিজস্ব ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট, ইতিহাস বইয়ের পাতা তো আছেই। 

  ল্যুভর দেখতে হলে প্রথমেই আপনাকে একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করতে হবে। সেই নির্দিষ্ট দিনের জন্য টিকিট কাটতে হবে। তবে টিকিট কাটার একটি বিশেষ নিয়ম আছে। আপনাকে অনলাইন টিকিট কাটতে হবে গুনে গুনে ষাট দিন আগে। মানে ধরুন, আপনি যাবেন ১০ই জানুয়ারি। আপনাকে কিন্তু টিকিট কাটতে হবে সেইদিনের ৬০ দিন আগে। আঠারো বছর বা তার উপরে যাদের বয়স অনলাইন টিকিট কাটতে তাদের খরচ ১৭ ইউরো, অফলাইনে ১৫ ইউরো (সাথে ঘণ্টা দুই-তিন লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ফ্রি।) আঠারো বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের এন্ট্রি ফ্রি। মূল্য দিতে না হলেও টিকিট কিন্তু কাটতে হবে। আপনি যদি ইওরোপিয়ান নাগরিক হন তাহলে ১৮-২৫ বছর বয়সীদের জন্য মিউজিয়াম এন্ট্রি ফ্রি। এছাড়াও, একটা লম্বা লিস্ট রয়েছে www.louvre.fr ওয়েবসাইটে যেখানে লেখা আছে কাদের কাদের জন্য মিউজিয়ামের অবারিত দ্বার। ধরুন, আপনি শিল্পী বা আর্ট টিচার। আপনার সেই হিসেবে একটি কার্ড আছে। কাউন্টারে সেটি দেখালে আপনাকে মূল্য দিতে হবে না। অথবা আপনি সাংবাদিক। সেক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটবে। 

  প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবার সন্ধ্যে ছয়টার পরে মিউজিয়ামে সকলে বিনামুল্যে প্রবেশ করতে পারেন। এই নিয়মটি অবশ্য জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রযোজ্য নয়। তখন তো সিজন টাইম। তবে ১৪ই জুলাই মিউজিয়ামে প্রবেশ করা যায় বিনামূল্যে। সকাল সাড়ে নটা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা অবধি খোলা থাকে ল্যুভর। বন্ধ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগেই দর্শনার্থীদের বাইরে বের করার প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়।

  এবার একটা ছোট্ট টিপস (হালকা লিপস্টিক) দিয়ে যাই। ফ্রান্স ভারতের থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। শীতকালে সেটি দাঁড়ায় সাড়ে চার ঘণ্টায়। অনলাইন পোর্টাল চালু হয় রাত বারোটায়। তবে আমাদের দেশের রাত বারোটা নয়, ওদের সময়ের রাত বারোটা ধরেই কিন্তু আপনাকে সমস্ত ব্যবস্থা নিয়ে রেডি থাকতে হবে। টিকিটে টাইম স্লট উল্লেখ করতেই হবে। প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর টাইম থাকে। আমাদের টাইম ছিল সাড়ে চারটে। তবে গিয়ে যা বুঝলাম টাইম স্লট ব্যাপারটাকে এরা খুব একটা পাত্তা দেয় না। আপনার ভ্যালিড টিকিট থাকলেই হল। মোট কথা, এখানে যখন রাত সাড়ে তিনটে বা ভোর সাড়ে চারটে তখন ওখানে সবে মধ্যরাত। আপনাকে সেই সময় টিকিট কাটলে সহজে পেয়ে যাবেন। আইফেল টাওয়ারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। আমি কী বোঝাতে পারলাম ব্যাপারটা? ভূগোলে আমি বড়ই কাঁচা।  এবার ধরুন আপনি এত কষ্ট করতে চাইছেন না। সেক্ষেত্রেও সমাধান রয়েছে। ইন্টারনেট ঘাটলেই পেয়ে যাবেন বেশ কিছু সংস্থার সন্ধান যারা আপনার জন্য টিকিট কেটে দেবেন এবং গাউডেড ট্যুরও দেবেন।  সেক্ষত্রে টিকিটের মূল্য স্বভাবতই বেশি হবে। এছাড়া রয়েছে 'প্যারিস মিউজিয়াম পাস'। এই টিকিটের দ্বারা আপনি প্যারিসের সমস্ত মিউজিয়ামে প্রবেশের অধিকার পেয়ে যাবেন।

    মিউজিয়ামের মোট চারটি ফ্লোর। কিন্তু ম্যাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেও বা মিউজিয়ামের কর্মীদের বারংবার জিজ্ঞাসা করলেও আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য। এ বিশাল ভুলভুলাইয়া! অবশেষে ইজিপ্ট, রোম, ইতালি ঘুরে আমরা মোনালিসার দেখা পেয়েছি। তাকে দেখতে গিয়ে অবাক হলাম একটা বিষয় দেখে – খ্যাতির কি বিড়ম্বনা! একটা একহাতের ছবির সামনে শ্রীভূমি মার্কা ভিড়। এদিকে ঠিক পিছনেই দেওয়াল জোড়া বিশাল বিশাল বিস্ময় জাগানো পেন্টিংয়ের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। 

  যাইহোক, আরও বেশ কয়েকটি ঘর ঘুরে মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে। লাগোয়া একটি সুদৃশ্য ক্যাফেতে বসে হট চকোলেট খেতে খেতে কাঁচের পিরামিডটিকে আলোকিত হতে দেখলাম। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ কিন্তু প্রয়োজন বুঝলে একদিন বা দু’দিনের জন্য গোটা মিউজিয়াম বন্ধ রেখে দিতে পারেন। কখনও কখনও কয়েকটি বিশেষ ঘরও পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে না। আমরা যখন গেছিলাম তখন মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধ তুঙ্গে। বেশ চাপেই ছিলাম। কারণ ফ্রান্সেও এই যুদ্ধের আঁচ পরেছে। জায়গায় জায়গায় দেখেছি প্যালেস্তাইনকে সাপোর্ট করে দলে দলে লোকজনকে পতাকা, প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে, সভা করতে।

  বাইরে বেরিয়েই আমাদের ছেলে লাফিয়ে উঠল। ওর বিস্মিত চোখ অনুসরণ করে দেখলাম সামনেই জ্বলজ্বল করছে দি আইফেল টাওয়ার। বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার দাপটে তখন দাঁত কপাটি লাগলেও আইফেল টাওয়ারকে রাতের অন্ধকারে দেখার আনন্দে সেই কষ্ট নিমেষে ভুলে গেলাম। সামনেই দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি রিক্সার মতো দেখতে যান। ফেসবুক গ্রুপের কল্যানে জেনেই ফেলেছিলাম এগুলিকে বলা হয়, “টুকটুক”। রিক্সা ও অটোর কম্বিনেশনে তৈরি নতুন যান চড়ার ঝোঁক উঠল। শুরু হল দরদাম। চালক প্রথমেই হাঁকল আশি ইউরো। সেটিকে কমিয়ে কমিয়ে নামানো হল পঁয়ষট্টিতে। সিয়েন রিভারের ধার ঘেঁষে, পার্লামেন্টের পাশ দিয়ে, ব্রিজ টপকে, বিখ্যাত চ্যাম্প ইলিসেস ধরে পৌঁছলাম আর্ক দে ত্রায়াম্ফের সামনে। চালক বেশ অমায়িক। আগ বাড়িয়ে ছবি তুলে দিলেন আমাদের। এবার গাড়ি গড়াল আইফেল টাওয়ারের দিকে। রাতের অন্ধকারের সোনালী টাওয়ার জেট ল্যাগ, ক্লান্তি - সব ভুলিয়ে দিল। 

  টুকটুক চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকেই ওয়াইফাই ধার নিয়ে বুক করে নিলাম উবের। প্যারিসের মেট্রো পরিষেবা খুবই ভালো। এছাড়াও পর্যটক থেকে সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, ইলেকট্রিক স্কুটারে, আরও নানা ধরনের স্কেট বোর্ডে চেপে যাতায়াত করতেই  পছন্দ করেন। তবে আমরা প্রথম দিনেই মেট্রো চাপতে একটু দ্বিধা বোধ করলাম। সুখ্যাতির পাশাপাশি চোর ছ্যাঁচড় সম্বলিত মেট্রো লাইনের কুখ্যাতিও আছে। উবের ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও দুটি ক্যাব পরিষেবা G7 ও Bolt । এছাড়াও ট্যাক্সি তো রয়েছেই। আমরা প্রধানত ট্যাক্সি আর উবেরের উপরেই বেশি ভরসা করেছি। 

ক্রমশ…

শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৩

ঘরকুনোর বিদেশ যাত্রা

 ঘরকুণোর বিদেশ যাত্রা

কেয়া চ্যাটার্জি

প্যারিস পর্ব


পর্ব - প্যারিসিয়ান সংসার 

আগেই বলেছি ফ্লাইট যখন ল্যান্ড করেছে তখন প্যারিসের ঘড়ি অনুযায়ী সময় সকাল আটটা। কিন্তু কাঁচ ঘেরা এয়ারপোর্টের ভিতর থেকেই দেখে বুঝতে পারছিলাম ফ্রান্স তখন সদ্য ফোটা ভোরের আলো মাখছে। প্রাচ্যে যে ঋতু শরৎ ও হেমন্ত, পাশ্চাত্যে সেই ঋতুই ‘autumn বা falls season’। শীত পড়ার আগের পূর্বাভাস। পাতা ঝরার মরশুম। এই সময় সকাল শুরু হয় দেরি করে। সন্ধ্যেও নেমে যায় সাড়ে ছটার মধ্যে। সেদিন ভোরের প্যারিস আমাদের মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালো।

বাইরে বেরিয়ে একটি মিনি ভ্যান বুক করে আমরা পাড়ি দিলাম মালাকফের উদ্দেশ্যে। যদিও মিনি ভ্যান বুক করা উদ্দেশ্য ছিল না আমাদের। লাগেজের তুলনায় একটু বেশি বড় গাড়ি হয়ে গেছিল। কিন্তু সেই সময় সাধারণ সিদান গাড়ি সেখানে না পাওয়ায় এবং দীর্ঘ ফ্লাইট জার্নির পরে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছে না করায় আমারা বাধ্য হয়েই গাড়িটি নিই। ফলে গাড়ি ভাড়াও সামান্য বেশি লাগে। বলে রাখি, দরদাম কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের দেশেই চলে তা নয়। আপনি চাইলে কি না সম্ভব? গাড়ী চলতে শুরু করার পরে চালক মালাকফ পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেয়ে বসল ৯৫ ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় নয় হাজারের কাছাকাছি। গাড়ি চলমান অবস্থাতেই আমরা সেটিকে টেনেটুনে ৮৫ ইউরোতে নামাতে পেরেছি। অবশ্যই অন্তত বিনয়ের সঙ্গেই দরদাম করতে হয়েছে। Attitude দেখিয়েছেন কি গেছেন! ছোট গাড়ি পেলে হয়তো ভাড়া নেমে আসত পঞ্চাশ বা ষাট ইওরোতে। প্রথমদিন, তাই, একটু লোকসান দিয়েই যাত্রা শুরু হল।



  প্যারিস রাজধানী শহর হওয়ায় ভাষার অসুবিধা খুব একটা হয়নি। ফ্রান্সে সবাই ইংরাজি বলতে পারে না। না বলতে পারায় আমাদের মতো হিন্মন্য়তাতেও ভোগে না। তবে চেষ্টা করে বোঝার। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে যাত্রীকে বা নতুন পর্যটককে নিজের বক্তব্য বোঝানোর। তারপর যখন দুপক্ষই নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে অপারগ হয়ে পড়ে তখন ওরা সাহায্য নেয় ট্রান্সলেটারের। প্রসঙ্গত, যাহা আমাদের ম্যাক্সিমাম; তাহা উহাদের মিনিমাম। আমরা আইফোন কেনার জন্য কিডনি বেচার তাল করি, আর ওদিকে আমাদের হৃদয়ে ব্যথা দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার পকেট থেকে ফটাস করে আনল আইফোন (মডেল বৃত্তান্ত জানতে চাইবেন না প্লিজ।)। ফোনের একটি বিশেষ সফটওয়্যারে গিয়ে ফ্রেঞ্চ ভাষায় নানা রকম ফুস ফাস করে এগিয়ে দিল সামনে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইংরাজি বাক্য। এইভাবেই দরদাম সম্পন্ন হল। বাঙালির জয়! রাস্তার যানজট দেখে বুঝলাম শহরে সদ্য ভোর হলেও শহরের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। গাড়ীর সারিতে যোগ দিলাম আমরাও। চললাম মালাকফ। 

  মালাকফ,প্যারিস সিটি সেন্টার থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি টাউন। টাউন শুনে অনেকেই নাক কুঁচকে, হাসতে পারেন। তাই বলে রাখি, এটি ফ্রান্সের একটি ঐতিহাসিক এবং বৃহৎ শহর। তাছাড়া, The European Organisation for Civil Aviation Equipment এই মালাকফেই অবস্থিত।  এখানেই বুক করা হয়েছে আমাদের আগামী তিনদিনের সংসার। প্রসঙ্গত, হোটেল নয় বুক করেছি এয়ারবিএনবি। এই এয়ারবিএনবি সম্পর্কে অনেকেই জানেন। আবার অনেকেই জানেন না। Airbnb হল একটি online marketplace যেখানে একটি প্রপার্টি ভাড়া দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, নির্দিষ্ট মুল্যের বিনিময়ে। Google playstore থেকে AirBnb app ডাউনলোড করে সাইন আপ করলেই নিজের পছন্দ মতো দেশে, বা নিজের দেশেও পছন্দসই লোকেশান ও মূল্যে এপার্টমেন্ট বুক করে নেওয়া যায়। হোটেলে রুমের ভাড়ার পাশাপাশি, খাওয়া দাওয়ার খরচটাও কিন্তু বিশাল অঙ্কের। বিদেশে এসে বিদেশী খাবার কতটা সহ্য হবে সেই ভেবেই এয়ারবিএনবি নিলাম। তাছাড়া, শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় তিনদিনের ভাড়াও পেয়ে গেলাম বেশ কমের মধ্যেই। তিনদিনের জন্য ২৮০ ইউরো। বড় একটি এপার্টমেন্টে– বাগান, রান্নাঘর, বেডরুম, লিভিং রুম, বাথরুম সহ পেয়ে গেলাম। শুধুমাত্র ঘর নয় সঙ্গে ছিল রান্না করার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মশলাপাতি, ডিশ ওয়াশার, রেফ্রিজেরেটার, ওয়াশিং মেশিন, টিভি, সোফা, দুটি বেড ইত্যাদি। (একটা সম্যক ধারণা পেতে হলে নিচের ইউটিউব লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন আমাদের এপার্টমেন্টের ভিডিওটি। লাইক, সাবস্ক্রাইব ইত্যাদি ইত্যাদি করতে বলছি না কিন্তু।) আমাদের হোস্টের নাম ছিল মার্ক। আমাদের জন্য বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিল তার সহকারি ‘মামাদো’। ইশারায়, অল্প ইংরাজি, কিছুটা স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ মিশিয়ে সে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল কীভাবে কম্বিনেশন লকের মাধ্যমে মেইন গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে হবে। তারপর দেখিয়ে দিল চাবির বাক্স। সেখানেও কম্বিনেশন লক করা। ঠিকঠাক নম্বর মেলাতে পারলেই ঘরের চাবি পাওয়া যাবে হাতে। একে একে সে দেখিয়ে দিল ওভেন, মাইক্রোওয়েভ, রুম হিটার চালানোর পদ্ধতি। 

মামাদোকে বিদায় জানিয়ে আমরা লেগে পড়লাম কাজে। চাল, ডাল, নুন, ঘি, আলু ভাজা, রেডিমেড তরকারি, রেডিমেড বিরিয়ানি, ম্যাগি, পোহা, সুজি – অনেক রেডি টু ইট খাবারই নিয়ে গেছিলাম। ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে একটি উবের বুক করে চললাম বিশ্বের সবথেকে বড় মিউজিয়াম গ্র্যান্ড ল্যুভ দেখতে।


ক্রমশ…


youtube link:


https://youtu.be/r1r_IGu0CxU?si=krbOlsHw1-AUccY0


ঘরকুনোর বিদেশ যাত্রা

 একেবারে নতুন একটা ভ্রমণ মূলক ধারাবাহিক শুরু করলাম আজ। এই লেখার পাশাপাশি চলবে 'ওজন বাড়ান' ধারাবাহিকটিও। তাই ওজন বাড়ানের পাঠকরা হতাশ হবেন না। এই লেখাটি একেবারে নিজের জন্য লেখা। নিজেদের জন্য লেখা। সম্প্রতি ঘুরে এসেছি বিদেশ থেকে। কোনও ট্যুর এজেন্সি ছাড়া, নিজেদের প্রচেষ্টায়। তাও আবার রোড ট্রিপ। সেই অভিজ্ঞতাই সকলের সাথে ভাগ করে নিতে এই লেখা। তাছাড়া, যখন সময়ের ধূলিকণা স্মৃতির আল্ব্যামে জমে উঠবে, যখন ফিকে হয়ে আসবে কোনও এক ঘটনা তখন ফেসবুক মেমোরিতে ফিরে আসবে এই দিনগুলি - বারবার। এটাই জীবনের অন্যতম সম্পদ। আর এই লেখা পড়ে আপনারা যারা ভ্রমণ পিপাসু, তাদের যদি কোনও উপকার হয় তাহলে সেটা আমাদের উপরি পাওনা।  🥰🥰🥰


ঘরকুণোর বিদেশ যাত্রা

কেয়া চ্যাটার্জি

প্যারিস পর্ব





                           ১. প্যারিসে পা 


না, ঠিক ঘরকুনো আমরা নই। বেড়াতে যেতে কে না ভালোবাসে? গতে বাঁধা জীবন থেকে কয়েকদিনের ছুটি। কে না চায়? তবে হ্যাঁ, আমায় অনায়াসে ঘরকুনো হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়। সেজেগুজে বাইরে বেরোতে গেলেই আমার জীবনে বড় ল্যাদ লাগে। যাইহোক, এদিক ওদিকের কথায় মাথা না ঘামিয়ে আসল কথায় সরে আসা যাক। ফোকাস করা যাক কাজের কথায়। দুর্গা পুজোর কলকাতা ফেলে বেড়াতে যেতে মন চায়নি কখনও। কিন্তু এবারে হয়তো জগজ্জননী নিজেই সঙ্গ দিয়েছিলেন আমাদের জগৎ দেখার বাসনা পূরণে। তাই তৃতীয়ার কলকাতা, আলো – রোশনাই, যানজট, পুজোর গান, প্যান্ডেলের ভিড় ছেড়ে কত্তা, গিন্নী আর ছানা- তিনজন মিলে পাড়ি দিলাম ইউরোপের পথে। মূল গন্তব্য প্যারিস, সুইজারল্যান্ড হলেও বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

   কলকাতার নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে আবু ধাবির কানেক্টিং ফ্লাইট ধরলাম। এতিহাদ এয়ারওয়েজ। আমার ও ঋভুর ক্ষেত্রে এই প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। মনে অনেক প্রশ্ন। কিছুটা জড়তাও ছিল। কোনও এজেন্সি ছাড়া নাকি প্রথম বিদেশ ট্যুর সম্ভব নয়। যেদিন থেকে প্ল্যানিং শুরু করেছিলাম সেদিন থেকেই এই কথা আমাদের দুজনের কানের কাছে পাঁচালির মতো আওড়ে গেছে অনেকেই। তাই একটা হালকা মানসিক চাপও ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো? যা যা, যেভাবে ভেবেছি, সব ঠিকঠাক করতে পারব তো? ইমিগ্রেশন নাকি ভারী বিষম বস্তু! অনেকক্ষণ সময় লাগে। অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে সেইসব ঝামেলায় পড়তে হয়নি। সবকিছুই হয়েছে একেবারে মাখনের মতো। 

  ইমিগ্রেশনের পরে হাতে ছিল বেশ কিছুটা সময়। রাত ন’টা পঁচিশে ফ্লাইট থাকলেও নিয়ম অনুযায়ী পৌঁছে গেছিলাম চার ঘণ্টা আগেই। ফলে পেটের ভেতর অদেখা ইঁদুর ঘোরাঘুরি শুরু করে দিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তো পারা যায় না। তাই সময় কাটাতে ঢুকে পড়লাম এয়ারপোর্ট ভিআইপি লাউঞ্জে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড যারা ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা জানেন যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার সাথে সাথে প্রায়োরিটি পাস থাকার ফলে এই ধরনের আন্তর্জাতিক মানের ফুড লাউঞ্জে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। আমাদের কাছে দু’ধরনের প্রায়োরিটি পাস ছিল, তবে আমরা এসবিআই- এর পাস ব্যবহার করি। একে তো তৃতীয়ার সন্ধ্যে তার উপর আগামী কটা দিন কেমন খাবার দাবার পাবো সেই নিয়ে একটু দ্বন্দ্ব তো ছিলই। তাই ডায়েটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুফে মেনু সাজানো হয়েছিল বাংলার ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে। ভাত, সোনা মুগের ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, দই পোনা, বাসন্তি পোলাও, কষা মাংস, চিকেন কারি, পটলের দোলমা, স্যালাড, গন্ধরাজ ঘোল, আম পোড়া সরবত যেমন ছিল তেমন ছিল মটন বিরিয়ানি, রায়তা, দু রকমের চাটনি, নানা রকমের পাঁপড়, চাট কাউন্টারে পাপড়ি চাট। এছাড়াও, নানা রকমের কফি, জুশ, ফল, মিষ্টি, আইস ক্রিম, সফট ও হার্ড ড্রিঙ্কস।

এবার প্লেনে চড়ার পালা। সময় হতেই বোর্ডিং পাস হাতে রেডি হলাম আমরা। এরপর ধীরে ধীরে প্লেনের চাকা গতিবেগ বাড়িয়ে মাটি ছেড়ে আকাশে ভেসে উঠতেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠল। অবশেষে আমাদের যাত্রা হল শুরু।

  আবু ধাবি এয়ারপোর্টে যখন পা রাখলাম তখন মোবাইলের ঘড়িতে সময় রাত একটা। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে টার্মিনাল থ্রি থেকে ছাড়ল প্যারিসগামী বিমান। ততক্ষণে যদিও রাতের ঘুম চটে গেছে। বিমান সেবিকা খাবার পরিবেশন করে গেল। এই রাত তিনটের সময় খাবো কি খাবো না ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ভেসে ওঠা হিন্দি সিনেমা ‘দশবী’ দেখতে দেখতে খেয়েই ফেললাম হিন্দু নন ভেজ মিল। যতই হোক, পাপী পেট আর অভিষেক বচ্চন বলে কথা!

   ঘড়িতে সকাল আটটা। পাইলট জানিয়ে দিলেন আমরা এসে পৌঁছেছি সিটি অফ লাভ প্যারিসে। মুহূর্তে ঘুম উড়ে গেল। ইতিমধ্যে গরম কফি আর চিকেন অমলেট পেটস্থ করা হয়ে গেছে। এবার কেবিন লাগেজ কাঁধে চাপিয়ে গুটি গুটি পায়ে ইমিগ্রেশনের দিকে পা বাড়ানোর পালা। তারপর লাগেজ কালেকশন, ট্যাক্সি বুকিং ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনেছিলাম ফ্রান্সের ইমিগ্রেশন অফিসারেরা নাকি ভীষণ কড়া। কিন্তু কাউন্টারে পৌঁছে আমাদের সেই শোনা কথা যে ভ্রান্ত তার প্রমাণ পেলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার হাসি মুখে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর পাসপোর্টের সঙ্গে একে একে মুখ মিলিয়ে সুইচ টিপে খুলে দিলেন পাশের কাঁচের দরজা। ভেবেছিলাম দু-তিন ঘণ্টা জলাঞ্জলি দিতে হবে শুধুমাত্র এই কাজটিতেই। কিন্তু দেখলাম ঘড়ি ধরে সাত মিনিটে সব কাজ শেষ করে আমরা ব্যাগেজ নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়েই দেখা মিলল সারি সারি ট্যাক্সির লাইনের। তবে এখানে বলে রাখা ভালো বিমান বন্দরের নিজস্ব একটি সরকার অনুমোদিত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই গাড়ি নেওয়া ভালো কারণ বড় শহরে পর্যটকদের সাথে স্ক্যামিং হয় প্রচুর। ট্যাক্সি বুকিঙের আগে চালকের কাছ থেকে এটাও জেনে নিতে হবে যে সে কার্ডে পেমেন্ট নেয় কি না। যাতে পরে ঝামেলা না হয়। আমরা প্রথম দিন থেকে কার্ডেই পেমেন্ট করেছি কারণ তখনও নতুন দেশের নতুন টাকা পুরোপুরি চেনা হয়নি।

  


ক্রমশ...

শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

About John Donne

 জন ড্যান: মেটাফিজিক্যাল কবি

কেয়া চ্যাটার্জি




সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজি সাহিত্যে উদিত হল এক নতুন ধারণার সূর্য। একদল তরুণ কবি পূর্বতন কবিদের রোম্যান্টিক ধ্যান ধারণার বাইরে গিয়ে পৃথিবীকে দেখতে শেখে এক অন্য ধরনের দৃষ্টি দিয়ে। প্রেমে কি শুধুই চাঁদ, তারা, ফুল, পাখিদের অধিকার? প্রেমিকা কেন হবে এক অলীক জগতের অধিবাসী? তাকে ছোঁয়া যাবে না কেন? শুধুই তার পথ চেয়ে কবি লিখে যাবে কিছু পেলব পংক্তি? তারুণ্যের উচ্ছ্বাস সেই না পাওয়া গুলির বিরুদ্ধে শানিয়ে তুলল নিজেদের কলম। জন্ম নিল কিছু ছক ভাঙা কাব্যের। গঠিত হল মেটাফিজিক্যাল কবি গোষ্ঠী। 

   এই গোষ্ঠীর কবিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল চিরাচরিত কাব্যের থেকে একটু আলাদা। কবিতাগুলি ছিল ছন্দবদ্ধ, আধ্যাত্মিক ও প্রেমের, কাব্যিক ভঙ্গি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও চমকপ্রদ। তবে মেটাফিজিক্যাল কবিতার আসল চমক ছিল তার উপমায়। দুটি অসম বস্তুকে উপমিত করে কবি তাঁর মনের ভাব ব্যক্ত করেন। এই ধরণের উপমা সম্বলিত কবিতার প্রয়াস এর আগে কখনো ইংরেজি সাহিত্যে ঘটেনি। সব থেকে কোমল অনুভূতিদের প্রকাশ কীভাবে কিছু নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর মাধ্যমে সম্ভব সেই ভাবনাই ঘিরে ধরল পাঠক মহলকে। 

   মেটাফিজিক্যাল কাব্যগুলির গঠন ছিল মোটামুটি একরকম ছকের। একজন কথক, মুক্ত ছন্দ এবং ভিন্ন ধরার উপমা যা পাঠককে চমকে দেবে। এই উপমার ভিতরেই নিহিত থাকে কবির জটিল ভাবনা, গভীর মনস্তত্ত্ব। মেটাফিজিক্যাল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন গবেষক ডক্টর জনসন। এই গোষ্ঠীর কবিদের রীতি ভাঙার সাহসিকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই কবিরা তাঁদের যৌন চাহিদার কথা, প্রেমের কথা, সামাজিক অবস্থানের কথা নির্দ্বিধায় জানাতেন। পূর্বতন কবিদের মতো তাঁদের পদ্যে ছিল না কোন অহেতুক অলঙ্কারের আতিশয্য। তৎকালীন কবিদের মধ্যে নাম উঠে আসে জর্জ হার্বার্ট, রিচার্ড ক্রস, হেনরি ভগান, থমাস কারিউ, অ্যান্ড্রু মার্ভেল, আব্রাহাম কাউলি, হার্বার্ট ওয়ালের প্রমুখের নাম উঠে এলেও এঁদের মধ্যে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন জন ডান। 

১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের এক অভিজাত ক্যাথোলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জন ডান। তবে তাঁর শিক্ষাজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিভেদের জন্য। তাঁকে ইংল্যান্ডের সব থেকে ঐতিহ্যপূর্ণ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ পড়াশোনা শেষ করার আগেই ছেড়ে দিতে হয়। ধর্মীয় অভিমতের অমিলের কারণে তাঁর দাদাকে একটি চার্চের পৌরহিত্য ত্যাগ করতে হয় কারাবাসে প্রাণত্যাগ করতে হয়।  এতো প্রতিকূলতার পরেও জীবনের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাননি। পরবর্তী কালে তিনি আইনের ওপর পড়াশোনা করেন। ধীরে ধীরে তিনি যে চার্চের অধীনে তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন সেটি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বিভেদের উর্দ্ধে গিয়ে নিজেকে শুধুমাত্র একজন খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিতেন। 

 কবিতা লেখার অভ্যাস ছোটোবেলা থেকেই তাঁকে ঘিরে ছিল। প্রাপ্তবয়সে কবিতা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি ভাগ করে নিতেন দরিদ্র ক্যাথোলিক পরিবারের সাথে। তিন বছর তিনি বসবাস করেন ইউরোপে। ফিরে এসে লর্ড এগেরটনের সেক্রেটারির কাজে নিযুক্ত হন। এই সময় তাঁর পরিচয় ঘটে তাঁরই মালিকের ভাইঝি অ্যান মোরের সাথে। তাঁরা দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। তাঁর প্রেমের অপরাধে তাঁকে কারাবাস করতে হয়। তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। বহু বছরের দারিদ্রতার জ্বালা সহ্য করার পর অ্যানের পিতা জর্জ মোর তাঁদের ক্ষমা করেন ও তার কন্যার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জন এই আরামের জীবন চাননি কখনোই। তিনি চার্চের চাকরির সুযোগ ছেড়ে দেন। তিনি রাজা প্রথম জেমসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর পৃষ্টপোষকতা আশা করেন। কিন্তু রাজা তাঁর দিকে নজর দিলেও তাঁকে কোন জীবিকা দিলেন না। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর অ্যানের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যায়। সাতটি সন্তানের দায়িত্ব ও চরম দারিদ্র তাঁকে অবেশেষে একটি চার্চের পুরোহিত হিসেবে যোগ দিতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে তিনি শহরের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত হয়ে ওঠেন। অবশেষে তাঁকে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রালের ডিন হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। 

  জীবনের এই ওঠা পড়ার মাঝেও কবিতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁর জীবনের সবথেকে বেশি কবিতা তিনি লিখেছেন ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে ধরা পড়েছে বুদ্ধিমত্তা, কোমলতা, সন্দেহ, মানবিকতা। তাঁর কাব্যে ধরা পড়ে তাঁর গভীর মনস্তত্ত্ব, জীবনের প্রতি ভালোবাসা। তাঁর কবিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল The Flea, The Good Morrow, The Canonization, The Sun Rising, Go and catch ba falling star, The Anniversary, Holy Sonnets। এলিজাবেথান ও পেট্রারকান কবিদের চিরাচরিত ধরন থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। তাঁর ছন্দ ছিল সহজ, ভাষা ছিল সাধারন মানুষের হৃদয়গ্রাহ্য ও সাবলীল। তাঁর কাব্যে ছড়িয়ে আছে জীবনকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করার এক আনন্দ। জীবন, প্রেম, আধ্যাত্মিক চিন্তা ধারা সব ধারায় তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন এক রহস্যের চিহ্ন। 

তাঁর এই শৈলী শুধুমাত্র তাঁর পরবর্তী কবিদের মধ্যেই সীমিত ছিল না। হার্বার্ট, ক্লিভল্যান্ড, মার্ভেল ছাড়াও তাঁর এই শৈলীর বশীভূত হয়েছিলেন কবি ড্রাইডেন, কোলেরিজ, ব্রাউনিং, এলিয়ট, পোপ, হপকিন্স প্রমুখরা। খুব কম কবি তাঁর জীবদ্দশায় এতটা বিখ্যাত হতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষা বোধ, শব্দ চয়ন তাঁকে মানুষের মনের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তাঁর মৌলিকত্ব ও আধুনিক প্রকাশভঙ্গি জন ডানের নামকে ইংরেজি সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল করে রেখেছে।

মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০২২

Ruskin Bond ও কিছু কথা

  রাস্কিন বন্ড ও কিছু কথা

কেয়া চ্যাটার্জী




     বিমল, রিয়াজ, ব্রিয়ান এবং রাস্কিন হেঁটে যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। দিনটা রবিবার। বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনার ছুটি। কর্তৃপক্ষ কোনও খেলাধূলার আয়োজন না করলে ছাত্রদের এই একটি দিনেই তারা ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দেন। চলতে চলতে হঠাৎ একজন হোঁচট খেয়ে পড়ল মুখ থুবড়ে। ছেলেটি বিস্মিত হয়ে দেখল একটা প্রায় সদ্যজাত শিশুকে কাপড়ে মুড়ে কে যেন রাস্তায় রেখে দিয়ে চলে গেছে। তারা ঠিক করল এভাবে একটি বাচ্চাকে পথে ফেলে যাওয়া একদম ঠিক হবে না। অতএব তারা শিশুটিকে নিয়েই হাঁটা লাগাল স্কুলের দিকে। তারপর কী হল?

  আচ্ছা একটা বই শেষ করার পর কখনও মন খারাপ হয়েছে? মনে হয়েছে, বেশ তো ছিলাম ওদের জগতে, কেন আবার ফিরে এলাম এই রুক্ষতায়? কখনও কান্না পেয়েছে খুব? রাস্কিন বন্ড এমনই একজন লেখক। এমন একজন যে তাঁর কলমের প্রথম আঁচরেই পাঠককে বইয়ের পাতার সাথে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বারবার ধরা পরে তাঁরই জীবন স্মৃতি, অভিজ্ঞতা। নিজেকে সকলের মাঝে রেখেই সকলের গল্প বলেছেন তিনি— মানুষের গল্প, ছোটদের গল্প। ছোটদের মনের খবর দিতেন তিনি পাতার পর পাতা জুড়ে।

     ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে মে ভারতবর্ষের কাসৌলীতে জন্মগ্রহণ করে এডিথ ক্লার্ক এবং অবরে বন্ডের পুত্র রাস্কিন বন্ড। বাবার এয়ারফোর্সে চাকরি করার সুবাদে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে নানান জায়গায়। মা বাবার বিচ্ছেদ ও বাবার মৃত্যু তাঁর জীবনে ও তাঁর লেখনীতে  বিশেষ ছাপ ফেলেছে। পিতামহির লালন পালন ও সিমলার বোর্ডিং স্কুলের জীবন তাঁকে গল্প লিখতে শিখিয়েছে। অন্য চোখে, অন্য ভাবে দেখতে শিখিয়েছে চেনা জানা জগৎটাকে। তাঁর জীবন, তাঁর অভিজ্ঞতা গল্প হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে বারবার। রাস্কিন বন্ডের লেখা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর ছোটবেলা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।  কারণ লেখক হওয়ার সমস্ত রসদ, গল্পের চরিত্ররা, গল্পের ভাবনা, ছোট ছোট মুহূর্ত সবই তাঁর শৈশবে লুকিয়ে আছে। বেড়ে উঠেছে ছোট্ট রাস্কিনের মধ্যে একটা বটবৃক্ষের সম্ভাবনা।

     একটি নিঃসঙ্গ ও জটিল শৈশব পাওয়া সত্ত্বেও রাস্কিন তাঁর পাঠকদের উপহার দিয়েছেন এক একটি সদর্থক গল্প। যে জীবন তিনি চেয়েও পাননি, যা তাঁর প্রাপ্য হয়েও অধরা, তা-ই হয়তো উপহার দিতে চেয়েছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে। তাই তো তাঁর চরিত্ররা আমাদের বড় আপন। তারা যেন আমাদেরই কথা বলে, আমাদেরই মাঝে থাকে। তারা আমাদের থেকে দূরের কেউ নয়। আমাদেরই চারপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষ, নিত্য নৈমিত্তিক ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহকে অন্য আঙ্গিক ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখার এক একটি নতুন চশমা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যান গল্পের ফেরিওয়ালা। আমরা অবাক হই। জীবন এত সুন্দর!

    তাঁর লেখনীর জীবন লুকিয়ে তাঁর ভাষায়। সাবলীল বাচন ভঙ্গী, শব্দ নির্বাচন, দৃশ্য বর্ণনা, ঘটনা প্রবাহের সজ্জা, চরিত্র চিত্রণ, সহজ সংলাপ এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের সুন্দর বর্ণনা তাঁর লেখনীকে অন্য মাত্রা এনে দেয়। যা কিছু সহজ, যা কিছু সুন্দর শিশু মনকে তা-ই আকৃষ্ট করে। রাস্কিন বন্ড তাই শিশুদের প্রাণের লেখক। আসলে তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি আজও নতুন নতুন বন্ধু বানায়। শিশুরা নিজেদের খুঁজে পায় বইয়ের পাতায়। একটা স্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প, দাদু- ঠাকুমা বা একটা অংকে ভয় পাওয়া ছেলের গল্প — এরা তো অন্য কোনও  জগতের বা অন্য কোনও সমাজের মানুষ না। এরা তো আমাদেরই লোক। তারা তো আমরাই। নিজেদের জীবনের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে? 

    একটা সাধারণ ঘটনা, তা কিভাবে যেন অসাধারণ হয়ে ওঠে বন্ডের জাদু কলমে। Getting Granny's Glasses একটি ছোট ছেলে মনির তার ঠাকুমাকে মুসৌরিতে চোখের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার গল্প। এই ছোট্ট অভিযানে রাস্কিন বন্ড কি অদ্ভুত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন পথের, ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির, কুয়াশা, রাস্তায় নামতে থাকা ধস ও রাতের মুসৌরি শহরের। পরিশেষে যখন ঠাকুমা তার নতুন চশমা দিয়ে বহুদিনের অস্পষ্ট পৃথিবীকে ফের পরিষ্কারভাবে দেখতে শুরু করলেন তখন তার আনন্দের বর্ণনা, তার উল্লাস পাঠক যেন সচক্ষে দেখতে পায়। মুসৌরি যাওয়ার পথে ঠাকুমা এগারো বছরের মনির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এদিকে ফেরার পথে মনি ঠাকুমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। একই গল্পে দু'জন মনি। একজন অত্যন্ত দায়িত্ববান, আরেকজন নিশ্চিন্ত কিশোর। রাস্কিন বন্ডের এই সরলতায় বাঁধা পরে পাঠকের হৃদয়।

কথায় আছে, যে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারে সে পৃথিবীর সব কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায়। রাস্কিন বন্ড এমনই একজন মানুষ। Roads to Mussoorie গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "Instead of a Forward I'm writing a Backward, because that's the kind of person I've always been...Very backward." এমন অকপটভাবে নিজের ব্যাপারে কে-ই বা বলতে পারে। যেমন অকপট ভাবে তিনি নিজের শৈশবের ব্যাপারে লিখেছেন তাঁর নব্য গ্রন্থে। বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ তাঁকে ততটা নাড়িয়ে দেয়নি যতটা টলিয়ে দিয়েছে বাবার মৃত্যু। মাত্র দুবছর বাবার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিনি। মায়ের ভূমিকা পালন করা বাবা রাস্কিনের জীবনের অর্ধেকটা জুড়ে। আজও একাকী সময়ে তিনি অনুভব করেন বাবার উপস্থিতি। তাঁর আশ্রয়ের ছায়া। বুজে আসা কণ্ঠে তিনি সাক্ষাৎকারীকে বলেন, যে বাচ্চারা ছোট থেকেই একা থাকতে শিখে যায়, যাদের পারিবারিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়, যারা বিচ্ছেদ দেখেছে তারা ভীষণ সংবেদনশীল হয়। এই সমস্যা আর সংবেদনশীলতা তাদের লিখতে অনুপ্রাণিত করে। যেমন তিনি নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আসলে তাঁর গল্প, উপন্যাসে তিনি নিজের কথাই লিখে গেছেন নিরন্তর। সতের বছর বয়সে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস The Room on the Road, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে পেল Llewellyn Rhys Memorial Prize.  উপন্যাসটি রচিত হয় একটি কিশোরকে ঘিরে যে তার কঠোর অভিভাবকদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে তার বন্ধুদের সাথে পালিয়ে যায় নিরুদ্দেশের পথে। আচ্ছা, আমাদের কি কখনও মনে হয় না এই কঠিন পৃথিবীর বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে? কৈশোরে কি কখনও মনে উঁকি দেয়নি নিজের একটা জগৎ গড়ার ইচ্ছা? বন্ডের গল্পে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। সুপ্ত ইচ্ছেগুলো এক ম্যাজিক ফুঁয়ে সত্যি হয়ে যায়। পাঠকের মনে তাই চিরন্তন, চির নবীন রাস্কিন বন্ড।

The Blue Umbrella উপন্যাসে একটি নীল রঙের ছাতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সমগ্র প্লটটি। 

আঙ্কেল কেন, আন্ট রুবি, বিবিজি, সমি, রঞ্জি, দলজিৎ, রাস্টি— রাস্কিন বন্ডের চরিত্ররা চির অমর পাঠকের হৃদয়ে। তাঁর মননে যেমন ছায়া ফেলেছে জীবন ও অভিজ্ঞতা তেমনই প্রভাব রেখেছেন চার্লস ডিকেন্স, শার্লট ব্রন্টে, রুডইয়ার্ড কিপ্লিংয়ের মতো বরেন্য সাহিত্যিকরা। তাঁর প্রতি গল্পে উঠে আসে মুসৌরির পরিবেশ ও প্রকৃতি, তার ছাত্র জীবন, পিতামহির সাহচর্য ও বন্ধুদের কথা, কৈশোরের স্বপ্ন, যৌবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর সারা জীবন ধরে আহরিত জীবন বোধ তিনি বিলিয়ে দেন তার পাঠক কূলের মাঝে। আমাদের বয়স বাড়লেও আমাদের মন আটকে থাকে কৌশোরে। এক স্বপ্নালু কিশোরের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সুদূরে।

শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ভালোবাসার সংজ্ঞা হয়না।

ভালোবাসা। চার অক্ষরের শব্দটা আসলে ওজনে ভীষণ ভারী। শব্দটার সঙ্গে জুড়ে থাকে দায়িত্ব, কর্তব্য, একে অপরকে আজীবন শ্রদ্ধা ও সম্মান করার দায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে।    


শব্দটা আবার ঠিক ম্যাজিকের মতো। নিমেষে এক ছোঁয়ায় সব কষ্ট, অভিমান, অনুযোগ ভ্যানিশ। আবার চিরবসন্ত উড়ে এসে বসে মনের মনিকোঠায়।


ভালোবাসা আকাশ নয়, নিজের ঘরের ভীষণ আপন কোণ। সারাদিনের পরে যার কোলে নিশ্চিন্তে চোখ বোজা যায়।


ভালোবাসার মানুষটা প্রতিপদে মন্দগুলো বিচার করে না। গুণ নিয়েও গান করে না। পিছিয়ে পড়লে বলে না, আর হবে না, থেমে যাও। বরং হাত ধরে আরেকটু এগিয়ে দেয়, হোঁচট খেলে অপেক্ষা করে, আবার তুলে ধরে। 


ভালোবাসা বেড়িবিহীনক্ষণ। যখন ভীষণ ভাবে আমি হয়ে যাওয়া যায়। লোকে কি ভাববে, ভাবতে বলে না কেউ। ভালোবাসা ভাগাভাগি করে বসা স্কুলের বেঞ্চ, একই ভাঁড়ের চা। মুহূর্তটাই ভীষণ দামী।


ভালোবাসা আসলে আজীবনের পণ। মানভঞ্জনের আবশ্যিক অবসর। নৈঃশব্দ বুঝে নেওয়ার অভ্যাস। ভেঙে ফেলার বদলে গড়ে তোলার শিক্ষা। উভয় পক্ষের আমৃত্যু সম্মান রক্ষার দায়। 

 

ভালোবাসা বসন্তের দখিনা বাতাস। সন্ধ্যেবেলা জানলা বন্ধ করতে যাওয়ার আগে যার ছোঁয়ায় হাজার প্রজাপতি উড়ে যায় মনের গহীনে। মনে হয় পৃথিবীটা খুব সুন্দর হতে পারে।


কেয়া চ্যাটার্জী

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

অনুগল্প

প্রতিঘাত
কেয়া চ্যাটার্জী


অজিতের নিথর শরীরটার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে পূর্বা। একবছরের বিবাহিত জীবনে সমাপ্তি ঘটল। পাশে দাঁড়ানো অফিসার তাঁর মহিলা সহকর্মীকে ইশারায় উঠিয়ে নিয়ে যেতে বললেন পূর্বাকে। শেখর চিৎকার করে বলে উঠল, “না না অফিসার বৌদিকে নিয়ে যাবেন না। ও তো জ্ঞানত কিছু করেনি। এর আগেও ও ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেরিয়েছে, কথা বলেছে। আমরা কতো হাসাহাসি করেছি। সকালবেলা কিন্ত ওর কিছু মনে পড়তো না। বিশ্বাস করুন।” অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে মশাই, আপনার কথার ভিত্তিতে কি ওঁকে ছেড়ে দিতে পারি। এত বড় একটা কেস। সরুন তো। আমাদের কাজ করতে দিন।” নিজের স্বামীকে গলা টিপে খুন করার অপরাধে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হলো পূর্বাকে।  জেল হেফাজতে থাকাকালীন ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেল তার সপ্লিট পার্সোনালিটি আছে। ঘুমের মধ্যে সে আলাদা এক মানুষ। জেগে থাকলে সব কিছুই স্বাভাবিক। দীর্ঘ একবছর বিচার চলে। পুলিশ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। পূর্বা আর ফেরেনি শশুর বাড়ি। নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকিয়ে কি লাভ! অন্যায় নিশ্চই করেছে সে। খুন করেছে। একটা মানুষকে মেরে ফেলেছে। শাস্তি পাবে না? কিন্তু মৃত মানুষটা কি নিরপরাধ ছিল? পূর্বার চোখে ভেসে উঠল শ্রীতমার মৃত শরীর। বোকা মেয়েটা ভালোবেসেছিল অজিতকে। কিন্তু অজিতের শরীরে ছিল যৌবনের সর্বগ্রাসী আগুন। সেই আগুনে পুড়ে গেল শ্রীতমার জীবন। সন্তান সম্ভবা মেয়েটাকে অস্বীকার করলো অজিত। তখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই মেয়েটার। পূর্বা অনেক চেষ্টা করেছিল বোঝানোর, রুখে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাতে পারল না শ্রী। পাশে পেল না পরিবারকে। শেষে একদিন গলায় ফাঁস দিয়ে...
 পূর্বা একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিল। অজিতের চোখে মৃত্যুর ভয়টা তাকে তৃপ্তি দেয়। অজিত জেনে গেছে কোন অপরাধে তার এই শাস্তি। তিন বছর ধরে প্ল্যান করে শ্রীর মৃত্যুর দিনটাকেই বেছে নিয়েছিল পূর্বা কাজটা করার জন্য। তার পাশে কি তার পরিবার থাকবে আর?  তার গায়ে যে খুনের প্রলেপ লেগে আছে। হয়তো না, হয়তো  হ্যাঁ। তবে যেটাই হোক প্রতিঘাতটা খুব দরকার ছিল। ভীষণ দরকার ছিল। যেখানে বিচারের হাত পৌঁছয় না, যেখানে প্রতিবাদের শব্দ কড়া নাড়ে না সেখানে প্রতিশোধই একমাত্র উপায়। পূর্বা এগিয়ে চলল নতুন জীবনের পথে, হয়তো একাই।

মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২০

বেলুন


বেলুন
কেয়া_চ্যাটার্জী
দার্জিলিং শহরটা বেশ অদ্ভুত। একদিকে কোলাহল আর একদিকে পাথরের নীরবতা। ঝিলম এই নীরব দিকটাতেই বসে আছে। রেলিঙের ওপারে সুগভীর খাদ। একটু এগোলেই ম্যালের জনবহুল রাস্তা। এখানে পরপর অনেকগুলি হোটেল ও রিসর্ট। তারই মাঝে মাঝে কয়েকটা চওড়া জায়গায় ছাউনি দিয়ে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দুটি নেপালী ভদ্রমহিলা বড় বড় ফ্লাস্কে চা আর কিছু কৌটোয় রকমারি বিস্কুট বিক্রি করছেন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন আঞ্চলিক ভাষায়।
  ঝিলমের ফোনটা বেজে উঠল। আকাশের নম্বর। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে এক কাপ চা নিয়ে ফের চুপচাপ বসলো বেঞ্চে। সূর্য আজকের মতো গোলাপি লাল আভা ছড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রিয়তমা পৃথিবীকে। এই প্রেম পর্বই ভালো। ভালোবাসা থাকে। যেমন ভালোবাসা ছিল আকাশ আর ঝিলমের। পাঁচবছর আগে অবধি।
  একই অফিসে কাজ করার সুবাদে ওদের আলাপ, বন্ধুত্ব, তারপর তা গড়িয়ে বিশেষ এক সম্পর্ক। যেদিন আকাশ অফিসিয়ালি প্রপোস করেছিল সেদিনই ওদের বাড়ি গিয়ে ডেট ফাইনাল করে এসেছিল পাঁজি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। ঝিলমের মা বাবা বেশ হতবাক হয়েছিলেন। পাত্র নিজেই এসে বিয়ের কথা বলছে! দুসপ্তাহ পরে আসেন আকাশের মা বাবা জলপাইগুড়ি থেকে। ছেলের পাগলামী সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত তাঁরা। হেসে বলেছিলেন, “মিয়াঁ বিবি রাজি তো আমরা চার কাজী আর নাক গলিয়ে কি করবো বলুন তো?”
  বিয়ের তিনমাস পর তারা হানিমুন সারতে আসে দার্জিলিং। কিন্তু পাঁচবছর আগের নিখাদ বন্ধুত্বে কেমন একটা ভাঁটা পরে গেছে ইতিমধ্যে। আকাশের অতিরিক্ত প্রাণচ্ছলতা অসহ্য লাগতে শুরু করে ঝিলমের। কথায় কথায় হেসে ওঠা, ভুলে যাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া সব সব অসহ্য ঝিলমের কাছে। আজকেও আকাশের মাথায় বাই চাপলো ঘোড়ায় চড়বে। ঝিলম সাফ না জানিয়ে দিলো, কিন্তু আকাশ টুক করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলল, তুমি ওই বইয়ের দোকানে থাকো, আমি একটু ঘুরে আসি। লেট করবো না প্রমিস। তারপর একঘন্টা কেটে গেলেও আকাশের পাত্তা নেই। ফোন করলেও তুলছে না। মাথা গরম হয়ে উঠল ঝিলমের। ম্যাল ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুল এই জায়গাটায়। আকাশ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। তোলেনি। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছেলেটাকে।
হঠাৎ একটা গান কানে আসতেই ঝিলম এদিক ওদিক ফিরে দেখল সামনের বেঞ্চে একটি লোক পাহাড়ের দিকে মুখ করে আপন মনে গেয়ে চলেছেন, “আঁখি পানে চেয়ে বলে না..না..না..সে যে মানে না মানা।” কলকাতার বাইরে বাঙালি দেখলে, তার সাথে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে। তার গান শেষ হতে ঝিলম বলে উঠল, কলকাতা? লোকটি পিছন ফিরে চাইল। না লোকটি বাঙালি না বরং গোর্খা। সে হেসে বলল, “না দার্জিলিং।” ঝিলম অবাক হয়ে বলল, “আপনি এতো স্পষ্ট বাংলা বলেন কি করে?” লোকটি আবার একগাল হেসে বলল, “আমার বউ শিখিয়েছে। বউ কিন্তু কলকাতায় থাকত।” ঝিলম বলল, “বিয়ের পর  তাহলে এখানেই থাকে?” লোকটির মুখ একটু ম্লান হলো। বলল, “হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এখানেই থাকে। বরাবরের মতো।” ঝিলম এতক্ষনে দেখল লোকটির হাতে একগোছা লাল নীল বেলুন। পাহাড়ি হাওয়ার দাপটে ভীষণ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ঝিলম হেসে বলল, “কটি ছেলে মেয়ে আপনাদের?” লোকটি এবার বেলুনগুলো দিকে চেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো হেসে উঠে বলল, এ তো আমার বড় বাচ্চার জন্য। আমার বৌএর জন্য। অনেকদিন দেখা হয়নি তো। রাগ করেছে। এই বেলুনগুলো দেখলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে, আমি জানি।” একটু থেমে আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “আমিও খুব রাগ করতাম। বৌটা একদম সংসারী ছিল না। ভীষণ ছেলে মানুষ। রাঁধতে পারত না, দরকারি কথা ভুলে যেত, কাজের সময় বসে ছবি আঁকত। একদম অগোছালো। ভীষণ রাগ করতাম। বকতাম। ও কাঁদতো। ভাবতাম কাঁদুক, ভুল বুঝে শুধরে যাবে। কিন্তু...”
― কিন্তু?
ঝিলমের প্রশ্নে লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়াল। “আমি যাই ম্যাডাম। দেরী হয়ে গেল। দেরী হলে আবার রাগ বেড়ে যাবে। বেলুনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে ।” এই বলে একগাল হেসে  ঢাল বেয়ে নেমে যেতে লাগল নীচে। ঝিলমের ভীষণ কৌতূহল হলো। সেও লোকটির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। রাজভবন পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে লোকটি একটি ছোট গেট খুলে ঢুকে গেল একটি জঙ্গল ঘেরা স্থানে। ঝিলমও তার পিছু পিছু ঢুকে বুঝতে পারল এটি কবরস্থান। দূরে কিছুটা গাছ গাছালি ঘেরা জায়গায় লোকটি বসে আছে। সামনের একটি বেদীতে বাঁধা সেই লাল নীল বেলুন গুলি। লোকটি আপন মনে গল্প করছে তার স্ত্রীর সাথে। তার চিরকালের অভিমানী প্রেমিকা।
চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। ঝিলম ছিটকে বেরিয়ে এলো ওখানে থেকে। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে গতি বাড়িয়ে দৌড়োতে লাগল। আকাশ কোথায়? তার অগোছালো খামখেয়ালি আকাশ? ওদের হোটেল পেরিয়ে আরো কিছুটা যেতেই পিছন থেকে হাতে টান পড়তে ফিরে দেখল অবাক দৃষ্টিতে আকাশ দাঁড়িয়ে তার সামনে। ঝিলমের চোখে জল দেখে বলল, “ঘোড়াটাকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল জানতো। অবলা প্রাণী কষ্ট পাচ্ছিল। হাসপাতালে গেছিলাম। আমারও একটু হাত পা ছড়ে গেছে।তোমায় কতো বার ফোন করলাম, তুমি কিছুতেই রিসিভ করলে না। আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল জানো?” ঝিলম আঁকড়ে ধরল ওকে। আকাশ জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদছো কেন? ঝিলম অস্ফুটে বলল, কিছু না।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২০

ম্যাজিক

ম্যাজিক
কেয়া চ্যাটার্জী

গিলি গিলি ছূ, আবরা কা ডাবরা....
হাততালিতে ফেটে পড়ল প্যান্ডেল। ছোট ছোট চোখগুলিতে বিস্ময় ঝরে পড়ল। স্টেজে জাদুকর রঙিন পোশাক পরে একের পর এক জাদু দেখিয়ে চলেছে। কখনো ফুল ঝরে পড়ছে, কখনো বা উড়ে যাচ্ছে পায়রা, কখনো কার পকেট থেকে উঁকি মারছে ইঁদুর।
  শো এর শেষে টাকা হাতে পেতে বেশ দেরি হলো সনাতনের। পুজো কর্তারা আরো কিছুক্ষন খেলা দেখাতে বলেছিলেন। কিন্তু সনাতনের সরঞ্জাম যে আর নেই। তাই শাস্তিস্বরূপ....। সঙ্গের ছেলেটির হাতে হাজার টাকা ধরাতেই তার মুখে ফুটে উঠল সব পেয়েছির হাসি। হয়তো ছেলেটির জীবনের প্রথম কামাই। এইসব দৃশ্য মনকে খুব খুশি করে দেয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে খুশিটা কেমন ম্লান হয়ে যায়। বৌমা ছোট নাতিটার পিঠে গরম খুন্তি চেপে ধরে চিৎকার করছে, “খাবি, খাবি? আমায় খা রে শয়তান, আমায় খা।” দূরে বসে আছে ছেলে। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে স্ত্রীয়ের দিকে। সনাতন দ্রুত ছাড়িয়ে নিল বাচ্চাটাকে, “কি করছো কি বৌমা! ছেলেটাকে এই পুজোর দিনে মারবে নাকি?” সরমা ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, “তাই করলে বাঁচবো বাবা। এমন অপগন্ড সোয়ামীর ঘর করার থেকে তো বাঁচবো।” সনাতন তাকালো প্রকাশের দিকে। সে শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বলল, “আজও দিল না।” সনাতন বলল, “দিল না মানে? তুই তো সাতদিন আগে কাজ করেছিস। আজও টাকা দিল না?”
― না। ওই অন্নপ্রাশন বাড়িতে মিকি মাউসের জামা মাথা পরে ঘুরতে বলেছিল। ওতো বড় মাথাটা কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিলাম না। একবার টাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে একজনের গায়ে পরে যাই। একটা প্লেট আর গ্লাস ভাঙে। ওই টাকা কেটে সাতশ টাকা দেবে বলেছিল। কিন্তু আজও দিল না।”
সনাতন ছেলের হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে বলল, “যা ছেলেটার জন্য খাবার নিয়ে আয়।” ছেলে চলে গেলে মনে মনে ঠিক করে নেয় বাকি দেড় হাজারে কি কি হিসেব মেটানো বাকি। নাতিটা মাটিতে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ঠিক তার ওপরে দেওয়ালে ঝুলছে স্ত্রী মিনতির মালা পড়া ছবি। সনাতন বাক্স থেকে বের করে জাদুকরের পাগড়ি আর পোশাক। নাতির সামনে হঠাৎ বলে ওঠে, “এই দেখো দেখো, জাদু দেখো। ম্যাজিক, ম্যাজিক, ম্যাজিক। আমি পি.সি.সরকারের চেলা। অন্ধকারে সূর্য দেখাই, দিনের বেলা তারা, মরুভূমিতে ফুল ফোটাবে এই সরকার বাবুর চেলা।” প্লাস্টিকের ফুল ঝরে পড়ল ছোট্ট শরীর জুড়ে। হাসি ফুটে উঠল খিলখিলিয়ে। ক্ষিদের ব্যথা ভুলে সে মেতে উঠল দাদুর জাদুর খেলায়। সরমা নিভৃতে চোখ মুছে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ম্যাজিশিয়ানের দিকে। এই বুড়ো মানুষটার পোড়া জীবনে একটা ম্যাজিক ভীষণ দরকার।

রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২০

বিয়ে বাড়ির গপ্পো


বিয়ের মরসুম চলছে। তাই স্মৃতি হাতড়ে কিছু বিয়ের গল্প বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আসলে গল্প তো না, স্মৃতি রোমন্থন।

বাড়ির সব থেকে ছোট হওয়ার সুবাদে আমি আমার ছোটবেলায় তিন দিদির বিয়ে দেখেছি। নব্বই দশকে পাড়ায় কোনো বাড়িতে বিয়ে লাগলে সেই অনুষ্ঠান শুধু সেই বাড়িতেই আটকে থাকত না, গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তো। বাড়ির সামনে ডেকোরেটর এনে প্যান্ডেল টাঙানো হতো। এখনকার মতো বাহারি ফুল, কাপড় সাজানো প্যান্ডেল না, লাল-হলুদ-সাদা কম্বিনেশনের কাপড়। গেটে বসতো একটি বৃহৎ প্রজাপতি, পাত্র-পাত্রীর নাম লেখা থাকত বাংলায়। সকাল থেকে সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙতো। সূর্য ওঠার আগে মা-জেঠিমা আর পাড়ার অন্যান্য কাকিমারা যেতেন জল সইতে। গঙ্গা দেবীকে নিমন্ত্রন করে আসতেন। তারপর হতো খই দই খাওয়ার পর্ব। সে সব পর্ব যদিও আমি দেখিনি। ঘুম থেকেই উঠতাম না। সকালের নানা পর্ব তো বড়দের ব্যাপার। সেসব আমাদের পোষাত না। বিয়ে  মানেই তো খাওয়া-দাওয়া তাই আমরা নজর রাখতাম হেঁসেলের দিকে। সকালবেলা লুচি আর সাদা আলুর তরকারি দিয়ে সারা হতো প্রাতঃরাশ। আহা! সে কি স্বাদ সেই আলু চচ্চড়ির। দুপুর হতেই গন্ধ আসত মাছের কালিয়ার। ততক্ষণে পাড়ার দাদারা আর দাদাদের বন্ধুরা কোমরে গামছা বেঁধে শুরু করে দিত পরিবেশনের আয়োজন। কাঠের লম্বা টেবিল তার সামনে সারি দিয়ে বসানো হতো কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। সেই চেয়ারে বসা একটু বিপদজনক ছিল বটে। বেশ কয়েকবার কব্জায় হাত রেখে আঙুলে চাপা খেয়েছি। তা সে যাইহোক, ছোট হওয়ার একটা সুবিধা ছিল, কোনো কাজ দেওয়া হতো না। উল্টে তাড়াতাড়ি খেতে বসিয়ে দেওয়া হতো। শালপাতার থালা আর মাটির গ্লাস। সেই গ্লাসে জল ঢাললে একটা অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ পেতাম। নুন লেবুর পর এল গরম ভাত আর ঘি , তারপর বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, ঝুরি ঝুরি আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ঝাল ঝাল শুকনো আলুপোস্ত, সেই পোস্ত গা বেয়ে গড়িয়ে পরতো লালচে হলুদ সর্ষে তেল আর শেষে মাছের কালিয়া, টমেটোর চাটনি।
 এরই মাঝে মন খারাপের সুর বাজত ভিতর ঘরে। দিদিকে সাজাতে আসত কোনো এক বিউটিশিয়ান বান্ধবী বা তার পার্লারের কর্মী। সাজার আগে একপ্রস্থ কান্নাকাটি মাস্ট। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। জেঠু বাবা ভীষণ গম্ভীর হয়ে কাজে ব্যস্ত, যতই হোক, মর্দ কো দর্দ মানায় না। আমি বরাবরই ভ্যাবলা গোবিন্দ টাইপ। দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখতাম সবার কান্না। ছোড়দির বিয়ের সময়, আমার থেকে তিন বছরের ছোট বোনপো এসে বলল, ও মাম্পি মাসি তুমি কাঁদবে না? (যেন না কাঁদলে ঠাকুর পাপ দেবে) আমি বললাম, কাঁদবো কেন? সে বলল, পুচি মাসি তো কাল থেকে আর আসবে না।
 কথাটা তখন মাথায় ঢোকেনি। বাচ্চা ছেলের কথায় পাত্তাও দিইনি। তখন মনে মনে জল্পনা রাতে কি হবে। এর মাঝে নিমপাতার মতো একটা দুপুরের অপরিহার্য ঘুমের ব্যবস্থা করা হতো। ফলে দূরদূরান্ত থেকে যত কাছাকাছি বয়সের দিদি ভাই বোনপো বোনঝি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হতো।
  সন্ধ্যে বেলা একবার ঢুঁ মারতাম দিদির ঘরে। সেই দুপুর থেকে সাজতে বসেছে। সন্ধ্যে বেলাও ফাইনাল টাচ বাকি। মাথা চুলকে ভাবতাম, দেখতে তো ভালোই এত সাজের কি আছে বাপু। ঘরের পিছনে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লুচি ভাজা। তখন এত শত স্টার্টার মকটেল ছিল না। বরযাত্রীর হাতে দেওয়া হতো লুচি,তরকারি আর মিষ্টির প্যাকেট। অন্যান্য অতিথিরা খেতেন চা বা শরবত। এই শরবত ব্যাপারটা বেশ লোভনীয় ছিল। একটা বিশাল এলুমিনিয়ামের ড্রামে লিটার লিটার জলে ঢালা হতো প্যাকেট প্যাকেট রসনা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই যে i love you Rasa, সেই রসনা। দেখে তো চোখ চকচক, জিভ লকলক। বাবার মামাতো ভাই একটা জগ হাতে সেই রসনা ঘুটছেন আর গ্লাসে ঢেলে অতিথিদের জন্য রেডি করছেন। পাড়ার দাদারা সার্ভ করছে। জনা পাঁচেক বাচ্চাপার্টি দু তিনবার ঘুর ঘুর করে সুযোগ বুঝে ঝুলে পড়লাম, ও ভোলা কা রসনা দাও না গো। সে চোখ পাকিয়ে বলে দিল, বরযাত্রী না এলে কিচ্ছু পাবি না। যে খেল গিয়ে।
  কি ভীষণ অপমান! সবার মুখ ভার। মনে মনে ভাবলাম, কবে যে দাদাগুলো বিয়ে করবে আর আমরা বরযাত্রী হয়ে একটু খাতির পাবো। বর বা জামাইবাবু আসার সময়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। সবাই ছুটে যায় বর এসেছে এসেছে। তাদের বর দেখার আগ্রহে এই ছোট্ট শরীর গলিয়ে কোনোদিনও জামাই বরণ দেখতে পেলাম না। বরযাত্রীর হাতে হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভার পড়ে গেলে তো ব্যস্ততার শেষ নেই। দিদির বিয়েতে আমরাও কিছু কাজ করেছি। যা হোক তেড়ে খেলার ফলে ক্ষিদে পেয়ে যেত জবর। ফার্স্ট ব্যাচে দূরের অতিথিদের একাধিপত্ব। তারা খেয়েই বেরিয়ে যাবেন। ততক্ষণে বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। দাউদাউ আগুনের সামনে দুই পাঁঠ...থুড়ি পাত্র পাত্রী হাফ সিরিয়াস হয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ছে। আমরা কজন ফাঁক ফোকর গলে পাশে দাঁড়িয়ে পরতাম, ছবি উঠবে যে। একবার ফ্লাস হয়ে গেলে কি আর বাদ দিতে পারবে? হিঃহিঃহিঃ।
 এবার রাতের খাওয়ার পালা। লুচি, ছোলার ডাল, বাঁকা বাঁকা ফিস ফ্রাই, ভাত, মুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, ধোঁকার ডালনা, মাছ, খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি, দই, পান। শালপাতাটা অনুগ্রহ করে চেবাবেন না। এখানেও কিন্তু একটা হালকা পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টভাবে চোখে পড়তো। যে দিদি বা পিসি একটু বেশি সুন্দরী, সে না খেতে পারলেও তার পাতেই খাবার গুলো বেশি বেশি করে পড়ত।কেন যে দাদারা তাদের সামনেই বেশি ঘুরঘুর করতো কে জানে বাবা! তারপর? তারপর আর কি, চোখ ঢুলু ঢুলু। সিঁদুর দান শেষ হতে ঘুম। বাসর ব্যাপারটা কি কোনোদিনও বুঝিনি। এই বাসরে নাকি ভালো ভালো গান হয়, দুস্টু মুসটু ইয়ার্কি হয়। হলে হয়, ঘুমের থেকে ভালো কিছু হয় নাকি! আমার বিয়ের বাসর রাত জেগেছিল আমার বোনপো, বোনঝি আর সবেধন নীলমনি একমাত্র বৌদি। ফলে সেই যে একটা মিথিকাল বিবাহ বাসর আমার দেখা হয়নি এখনও।
  যাকগে, বিয়ে শেষ। বিয়ের গল্পও শেষ। বৌভাত তো অন্যরকম। যে দিদি আগের দিন কেঁদে ভাসায় সেই পরের দিন বাপের বাড়ির সকলকে অভ্যর্থনা করে। কি অদ্ভুত না? সব ভালোর শেষে যখন স্কুল থেকে ফিরে জেঠুর বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়াতাম ঘরটা খাঁ খাঁ করতো। জমজমাট বাড়িটা নিমেষে ফাঁকা। বুম্বার কথাটা কানে এসে লাগত, দিদিকে তো রোজ রোজ আর দেখতে পাবো না।

বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২০

অনুগল্প- প্রশ্ন

প্রশ্ন
কেয়া চ্যাটার্জী

এক বাড়িতে একটা বিড়াল ছিল। তার ভীষণ লোভ ছিল মাঠের পাশে আমগাছে বাসা বাধা ফিঙে পাখিটার ওপর। বিড়ালটা রোজ একটা করে মাছ চুরি করে এনে আমগাছের গোড়ায় বসে ফিঙেকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেত। যেন বলতো তোকেও এইভাবেই খাবো। ফিঙে তার বাচ্চাদের আগলে রেখে ভাবতো কবে ওরা বড় হবে আর এই বাসা ছেড়ে উড়ে যেতে পারবে।
  একদিন পাখিটা দেখল, গাছের নিচে একটা লোক একটা কাপড় মোড়া ঝুড়ি নিয়ে এসে বসল। ঘর্মাক্ত কলেবরে, গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য একটু আশ্রয় নিল গাছের ছায়ায়। কিছুক্ষন পরেই নাক কুঁচকে তাকাল গাছের নীচে পড়ে থাকা মাছের আঁশ-কাঁটার দিকে। সে তার ঝুড়ি থেকে কিছু ফুল ফেলে দিল ওই আবর্জনার ওপর। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। সূর্য পাটে গেলে ফিঙে দেখল কে একজন ওই ফুলের সামনে মোমবাতি আর ধুনো জ্বালিয়ে চলে গেল।
  পরেরদিন সকালে বিড়াল এসে দেখে তার সাধের খাওয়ার জায়গাটা কারা যেন নোংরা করে দিয়েছে। সে থাবা দিয়ে পরিষ্কার করতে যেতেই কিছু লোক রে রে করে তেড়ে এলো তার দিকে। সেদিনের মতো বিড়াল পালিয়ে বাঁচল।
  ক্রমে দিন যায়, মাস যায়, এম গাছের নীচে রোজই কিছু লোক এসে শব্দ করে কি সব বলে। মানুষের ভাষার তুলনায় সে ভাষা একটু দুরূহ। অন্তত বিড়াল বা ফিঙে সেসব ভাষা এর আগে কখনো শোনেনি। এরপর জায়গাটায় বাড়ি উঠল। পাশাপাশি দুটো বাড়ি। তাতে দুটি আলাদা রঙের পতাকা লাগানো। আমগাছের দুটো ডালও গেছে ছাঁটা। ফিঙে কোনোমতে বাসাটা সামলে রেখেছে। ফিঙে আর বিড়াল পরস্পরের দিকে করুণ মুখে চায়। তাদের সম্পর্কের সমীকরণটা কেমন পাল্টে গেল। এখন ফিঙে বিড়ালের পাশে উড়ে এসে বসে। বিড়ালেরও ইচ্ছে করে না ফিঙেকে খেয়ে ফেলতে। ফিঙে ছাড়া যে তার আর বন্ধু নেই।
   একদিন আকাশ ছেয়ে মেঘ করল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আকাশে বুক কাঁপানো বিদ্যুতের ছটা। ফিঙের বাসা গেল ভেঙে। সে তার ভাঙা বাসা আর ছোট ছানাদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিড়াল তা দেখতে পেয়ে এক ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে ছানা সমেত বাসাটা মুখে করে বাড়ির বারান্দায় এনে রাখল। ফিঙেও এসে বসল তার পিছু পিছু। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল তার মাথা।
  সকালবেলা ভোর হওয়ার আগেই কি এক কোলাহলে বিড়াল আর ফিঙে বাইরে মাথা বের করে দেখে, কিছু লোক নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। দুটি রঙের পতাকা লুটিয়ে রয়েছে মাটিতে। হঠাৎ একজন আরেকজনের মাথা দিল ফাটিয়ে। হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড বেঁধে গেল চারিদিকে। রক্তের বন্যা যেন এলাকাময়। কেউ এল না ওদের থামাতে।
  বিড়াল ফিঙেকে প্রশ্ন করল, “হ্যাঁ রে বন্ধু, মানুষ কি মানুষের মাংস খায়?”
ফিঙে দুপাশে মাথা নাড়ালো।
বিড়াল বলল, “তবে ওরা লড়ছে কেন?”

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

History of English literature


History of English literature:
ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস: চসার সমকালীন কবি
John Wyclif: জন উইক্লিফ: (১৩২৪-১৩৮৪)
চতুর্দশ শতকে ইংরাজি সাহিত্যের একজন শক্তিশালী কবি ছিলেন জন উইক্লিফ। তিনি তাঁর সরল ও চলিত ভাষার বক্তৃতার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন।  চসারের মতো অভিজাতদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টির কথা  তিনি ভাবতেন না। বরং তাঁর আগ্রহ ছিল সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি। তাঁর প্রতিভা তাঁকে "ইংরাজি গদ্যের জনক" বা “father of English prose” উপাধি নিয়ে আসে।
  উইক্লিফ বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। যদিও তিনি কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি, শেষ করেন তাঁর শিষ্য Nicholas of Hereford. বাইবেলটি অনুবাদ করা হয় ল্যাটিন ভাষা থেকে এবং ১৩৮৮সালে John Purvey, উইক্লিফের আরেক শিষ্য, সেটিকে পুনর্মুদ্রণ করেন।
  উইক্লিফের কাব্য সাধারণ মানুষের জন্য রচিত হলেও, বর্তমানে তা সাধারণ মানুষের কাছে ততটা জনপ্রিয় নয়। কিছু গবেষকের মাঝেই তাঁর কাজ বরেণ্য। তাঁর বাইবেলের অনুবাদ বিভিন্ন মানুষের দ্বারাই ইংল্যান্ডে পুনরায় লিখিত হয় এবং কিছু প্রাচীন শব্দ বদলে দেওয়া হয়। যদিও উইক্লিফের এই প্রয়াস ইংরাজি সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে এক নবতম আঙ্গিকে মেলে ধরেছেন।


John Mandeville: জন মান্ডেভিল―
১৩৫৬ সালে ইংল্যান্ডের পাঠক মহলকে আচ্ছন্ন করে একটি বই যার নাম, Voyage and Travail of Sir John Maundeville.,  যা একেবারে চলিত ভাষায় লেখার ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব ফেলে।
  এই বইটির আসল লেখককে নিয়ে বেশ জল্পনা ছিল গবেষকদের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে এটি প্রমাণিত যে মান্ডেভিল ওডোরিক, মার্কোপোলো এবং অন্যান্য লেখকদের লেখা থেকে সংগৃহীত। মৌলিক লেখাটি আসলে লেখা ছিল ফ্রেঞ্চ ভাষায়, যা পরবর্তী কালে ল্যাটিন, ইংরাজি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়। যে ভাষাতেই অনূদিত হোক না কেন কাব্যটি তার সাহিত্য গুণের জন্য সর্বত্র প্রশংসিত হয়।
বর্তমানে মান্ডেভিলের পাণ্ডুলিপির ৩০০কপি সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে রয়েছে। একজন ভালো পাঠক দু থেকে তিন ঘন্টায় এই বইটির রসাস্বাদন করতে পারেন। চতুর্দশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতির এটি একটি জ্বলন্ত নথি।

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

সুখ


কণিকাকে অটোর লাইনে দেখতে পেয়েই মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল নন্দিনী। কণিকার ডাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে হলো। স্মিত হেসে বলল, “ও তুই, ভালো আছিস?” কান থেকে হেডফোন খুলতে খুলতে কণিকা বলল, “হ্যাঁ রে ভালো আছি। তা তুই কি এদিকে থাকিস?” 
― হ্যাঁ আরেকটু ভিতরে। চল না।
― না রে। আজ অফিস যেতে হবে তাড়াতাড়ি। পরে একদিন যাবো। তোর ফোননম্বরটা দে না।
নম্বর বিনিময়ের মাঝে নন্দিনী আড় চোখে গিলতে থাকলো কণিকার পোশাক, কানের দুল, স্পা করা চুল, ওয়াক্স করা হাতে পিছলে পড়া রোদ্দুর। মিলিয়ে নিল নিজের রোদে পোড়া চামড়া আর ফেটে যাওয়া গোড়ালি। নাঃ কোনো ভাবেই কণিকার পাশে নন্দিনীকে মানাচ্ছে না। ফোনটা ব্যাগে চালান করে কণিকা বলল, “বল, কি করছিস আজকাল?” নন্দিনী এই প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু অস্বস্তি বোধ করে বরাবর। একইরকম ম্লান হেসে বলল, “কিছু না। বাড়িতেই থাকি।” কণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলে ফেলল, “উফ বাড়িতেও অনেক কাজ রে। ভালোই আছিস। আমি তো দুদিক সামলে আর পেরে উঠছি না। জবের চেষ্টা করছিস?”নন্দিনী কিছু বলার আগেই অটো চলে এলো। কণিকা হাত নেড়ে উঠে পড়ল অটোতে। চেঁচিয়ে বলল, “আসি রে। ফোনে কথা হবে।” নন্দিনী ঘাড় নেড়ে বিদায় জানালো। অটোটা মিলিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো নন্দিনী। বিয়ের পর থেকেই এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত। চাকরি করে না কেন? আজকাল যেকোনো শিক্ষিত মেয়েই চাকুরিরতা। নন্দিনীর যে ইচ্ছে করে না তা নয়। কিন্তু বৃদ্ধ দিদি শাশুড়ি আর তিন বছরের বিট্টুকে ছেড়ে বেরোনো তার পক্ষে অসম্ভব। নন্দিনীর স্বামী বেসরকারী চাকুরে। বাড়ি সেই মেদিনীপুর। ওর মা বাবা পরিবার থাকে ওখানেই। শ্রীমন্ত কলকাতায় চাকরি সূত্রেই থাকে।   নন্দিনীর সাথে বিয়ের দু বছরের মাথায় বিট্টু আসে। ছেলে বছর খানেক হতে না হতেই শ্রীমন্ত তার সংসারে নিয়ে এলো তার দিদাকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য। বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর পর অতিরিক্ত আয়া রাখা শ্রীমন্তর পক্ষে সম্ভব নয়, জানে নন্দিনী। তাছাড়া, ছেলেটাকে অপরিচিত একজনের হাতে ছেড়ে যেতেও মন চায়না। ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে। কতো স্বপ্ন ছিল তার নিজের জীবন নিয়ে। কতো ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গেল। শ্রীমন্ত মানুষটা খারাপ নয়। তবু তার এই অসম্পূর্ণ জীবনের জন্য বিয়েকেই দায়ী করে সে। কি ক্ষতি হতো বাবা মায়ের, যদি আরেকটু সময় দিত? চোখ ফেটে জল আসে নন্দিনীর। ছেলের গায়ের চাদরটা আরেকটু টেনে দিয়ে জানলার কাছে এসে বসে। দুপুরগুলো খুব আলসে কাটে তার। এইটুকু সময় নিজের করে পাওয়া যায়। বই পড়া, গান শোনা, আকাশ পাতাল চিন্তা, সব টুকুই নিজের, একান্ত নিজের। কেউ ভাগ বসানোর নেই। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল নন্দিনীর। অচেনা নম্বর। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে কলকল করে ভেসে এলো কণিকার কণ্ঠ, “কি রে কি করছিস? ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?” আলতো হেসে নন্দিনী জানালো সে দুপুরে ঘুমায়না। নানান কথায় ভাসতে লাগলো দুই সখীর শব্দতরী। পুরোনো গল্প, পুরোনো বন্ধুদের কথা। নন্দিনীর মনে আরেকবার দগ্ধে উঠল ক্ষত। তার থেকে কম রেজাল্ট করা ছেলে মেয়েগুলোও এখন স্ব-নির্ভর আর সে পঞ্চাশ টাকার জন্য স্বামীর কাছে হাত পাতে। চোখটা ভিজে গেল আবার। এ জ্বালা যে কবে জুড়াবে! কণিকা হঠাৎ  জিজ্ঞেস করলো , “তোর ফিউচার প্ল্যান কি?” নন্দিনী থতমত খেয়ে বলল, “কিসের ফিউচার প্ল্যান বলতো?” 
― কেন? তোর এত ভালো রেজাল্ট, এত ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলি তুই। নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করবি না?
Pro gym ― men's gym and sports wear T-shirt for men.




নন্দিনী একচোট হেসে নিয়ে বলল, “আমার আবার কেরিয়ার! সব শেষ রে, সব শেষ।” 
ওপারে কণিকার গলায় সন্দেহ ভেসে উঠল, “কেন তোকে চাকরি করতে দিচ্ছে না শশুরবাড়ি?” নন্দিনীর মনে হলো বহুদিন পর কাউকে পাওয়া গেল যে তার কথা শুনতে চায়। তার ব্যাপারে জানতে চায়। সে নিজের মনের আগল খুলতে শুরু করলো। তার অভিমান, ব্যথা, কষ্ট একে ঝরে পড়ল অশ্রুবিন্দু হয়ে। নন্দিনীর কথা শেষ হতেই ওপাশে শোনা গেল কণিকার হাসি। নন্দিনীর মনে হলো এ তাচ্ছিল্যের হাসি। তার ব্যর্থতায় কণিকার সাফল্য হাসছে। নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই হাসছিস? খুব মজা লাগছে বল আমার কষ্টে?” কণিকা তার হাসির বেগ চাপল, “আরে তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? তোর তো অনেক সুবিধা। মাথার ওপর ছাদ আছে। খেতে পাস। কোল জুড়ে একটা সন্তান আছে। কতো মানুষের আরো কতো কষ্ট, কতো সমস্যা আছে জীবনে জানিস?” নন্দিনী কিছুই শুনতে চাইছে না এখন। তার মন চাইছে সমবেদনার কথা কিন্তু কণিকা তাকে জ্ঞান দিচ্ছে। কণিকা ওদিকে বলেই চলেছে, “আমার বাপেরবাড়ির পাড়ায় একটা মেয়েকে তার বাবা টাকার বিনিময়ে পাচার করে দিয়েছিল, সেই মেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে এখন একজন সমাজসেবী। আমার কাজের মেয়েটা দশ বাড়ি খেটে মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেল। আর তুই তো ভালো আছিস, সুখে আছিস। এত ডিপ্রেশন কেন তোর?” নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর পক্ষে এসব কথা বলা বেশ সোজা। তুই চাকরি করিস, প্রতিষ্ঠিত, নিজের টাকা আছে। আমার কিছু নেই। দশটাকা নিজের জন্য খরচ করলে মনে হয় দেনা বেড়ে গেল। কোন অধিকারে অন্যের কষ্টের টাকা খরচ করছি। তোর জীবনটা অনেক সুখের।” ওপাশ এবার নিস্তব্ধ। নন্দিনী ভাবলো একটু কি বেশিই বলে ফেলল সে? বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করে সারা এলো।
 “বল”
― চুপ করে আছিস যে?
― এই ভাবছি, আমি কতো সুখী।
―মানে?
― আমার বিয়ের পাঁচ বছর হলো, এখনো একটা সন্তান হলো না রে। প্রবলেমটা ওর, কিন্তু মানতে চায়না, ট্রিটমেন্ট করে না। রোজ ঝগড়া, রোজ ঝামেলা। শশুরবাড়ির কুকথা। একটা ব্যবসা করতো, ধার দেনায় লাটে উঠলো। বাধ্য হয়ে চাকরি করছি রে। নাহলে তো খেতে পাবো না। কতো ইচ্ছে ছিল জানিস নিজের একটা পার্লার বানাবো। নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করবো। সবার জীবন বাইরে থেকে যতটা সুখের মনে হয় ততটা সুখের নয় জানিস তো। তবে যেদিন তোর সাথে দেখা হলো সেদিন চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম।” নন্দিনী আকাশ থেকে পড়লো, “চাকরি ছেড়ে দিলি?” কণিকা স্বস্তির হাসি হাসল, “হ্যাঁ। পাড়ায় একটা ঘর ভাড়া নির পার্লার খুলেছি। বর খুব চেঁচামেচি করেছিল। পাত্তাই দিইনি। খুব ভালো লাগছে। কোনো চাপ নেই। বস নেই। একদম ফ্রি। বল জয়েন করবি আমায়?” নন্দিনী চুপ করে রইল। কণিকা বলল, “এই শোন না কাস্টমার এসেছে। এখন রাখি পরে কথা হবে। বাই।” ফোনটা কাটার সঙ্গে সঙ্গে বিট্টু এসে দাঁড়ালো পাশে। ছেলেটা ঘুম ভাঙলে এখন আর কাঁদে না। বিট্টুকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো নন্দিনী। এই একটি অভাব কতো বুক খালি করে রেখেছে! বিট্টুকে কোলে নিয়েই আরেকটা ফোন করলো সে, “হ্যালো সুতপা। তোমার মেয়েকে পড়তে পাঠাবে বলেছিলে, পাঠাবে আমার কাছে? --- তবে কাল থেকেই পাঠিও.....”

নন্দিনীর ভীষণ শান্ত লাগে নিজেকে। শিক্ষা আর ইচ্ছা একটা না একটা পথ বানিয়ে দেয় পরিচিতি গড়ে তোলার। টাকার থেকেও বেশি দামী এই পরিচিতি। পথ নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়। এগিয়েও যেতে হয় নিজেকেই।

বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস: চসারের যুগ।

History of English literature :
The Age of Chaucer :

একটি দেশের সাহিত্য সেই দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলে আবহমানকাল ধরে। চতুর্দশ শতাব্দীর দুটি ঘটনা ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটায়, যা ইংল্যান্ডের সাহিত্য চর্চার ওপর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব ফেলছিল।
     দীর্ঘ একশত বছরের যুদ্ধের ইতি ঘটিয়ে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড  চুক্তি অনুযায়ী দুটি আলাদা দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। এর ফলে ফরাসী ভাষা তার কৌলিন্য হারায় ও ইংরাজি ভাষা শুধু
  Geoffrey Chaucer: A prologue to the Canterbury Tales (with text) by Raghukul Tilak
সাধারণ মানুষের ভাষাই নয় রাজদরবারের ভাষা হিসেবে সম্মান অর্জন করে। দ্বিতীয়ত, এই সময় মানুষের চিন্তা ধারার কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। বহু প্রচলিত রাজ পরিবারের বিলাস বহুল জীবনযাপন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলেন। একদিকে রাজা  দ্বিতীয় রিচার্ড এর বিলাসী জীবন, অপরদিকে কর প্রদানকারী সাধারণ কৃষক মজুরদের দুর্বিষহ জীবন রাজার সিংহাসন টলিয়ে দেয়। ইংল্যান্ডে বিপ্লবের সঞ্চার হয়।

এই দুটি ঘটনা ছাড়াও, এই সময় অধিবাসীরা ব্যবসা বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করে। তাদের দেশের মাটি ছেড়ে তারা সমুদ্রাভিযানে নামে। বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে, ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। তাছাড়া, স্পেন, ইটালি সহ ইংল্যান্ডে এই সময় রেনেসাঁসের আবির্ভাব ঘটে।

 চতুর্দশ শতকের এই দোলাচলপূর্ণ সময়ের পাঁচ জন কবি ইংরাজি সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন। Langland, Wycliffe, Gower, Mandeville, Chaucer.

  এঁদের মধ্যে চশার প্রভূত খ্যাতির অধিকারী হন। তাঁর লেখায় সমকালীন বিখ্যাত অ-ইংরেজ কবি যথা Dante, Petrarch, Boccaccio-র অনুপ্রেরণা পরিলক্ষিত হয়। ইংল্যান্ড ও ইতালীয় সাহিত্য ও বৌদ্ধিক পরিবর্তন সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্য ও চিন্তা ধারার ওপর প্রভাব ফেলেছিল।

Geoffrey Chaucer [1340-1400]

       চসারের জীবনকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রত্যেক পর্যায়েই তাঁর জীবনযাত্রা তাঁর লেখনীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর শৈশব কাটে লন্ডনে। সতেরো বছর বয়সে তিনি রাজকন্যা এলিজাবেথের কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন। ঊনিশ বছর বয়সে কুখ্যাত একশো বছরের যুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় তিনি জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন অথবা বলা যায় মৃত্যুকে খুব নিকটে আসতে দেখেছেন। এই সময়ে প্রাপ্ত জীবনবোধ বারবার উঁকি তাঁর কবিতায়। এরপর ফিরে এসে রাজার অনুচর হিসেবে যোগ দিলে তাঁর সাথে রানীর এক সহচরীর বিবাহ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালের লেখা থেকে অনুমিত হয় যে এই রাজকীয় বিবাহ খুব একটা সুখকর ছিল না।



    1370 খ্রিস্টাব্দে চসারকে পাঠানো হয় ইটালি। এই সময় তাঁর কবিতায় ইতালীয় সাহিত্যের বেশ প্রভাব পরে যার ছায়া আমরা দেখতে পাই তাঁর অসম্পূর্ণ কবিতা  “Hous of Fame”এ। Dante, Ovid, Virgil তাঁর লেখার রসদ জোগালেও এই কবিতার বিষয় ও মৌলিক ভাবনার জন্য চসারের সাহিত্য ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারা যায়না। 1386 খ্রিস্টাব্দে তিনি পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৎ ব্যক্তিদের প্রতিকূল হয়ে পরে। চসার বিভিন্ন পার্টি থেকে ডাক পেলেও তিনি John of Gaunt এর পার্টির সাথেই আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন।
 “Romaunt of the Rose” তাঁর জীবনের প্রথম কাব্য কীর্তি। ফরাসি কবিতা “Roman de la Rose” এর অনুবাদ হলেও কবিতাটির চসারের কবি প্রতিভা কোনো ভাবেই ক্ষুন্ন হয়নি।



  তাঁর পৃষ্ঠপোষক John of Gaunt এর স্ত্রী Blanche এর মৃত্যুর পর যিনি রচনা করেন Dethe of Blanche the Duchesse যা Boke of Duchesse হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। এছাড়াও তাঁর ছোট কবিতার মধ্যে Truth বেশ জনপ্রিয়।
 ইতালিতে থাকাকালীন তিনি রচনা করেন Troilus and Criseyde. এটি একটি ৮০০০ লাইনের কবিতা। Boccaccio র Il Filostroto র অনুপ্রেরণায় কবিতাটির জন্ম। এই কবিতার মূল ভাবনার ওপর নির্ভির করে নাট্যকার সেক্সপিয়ার রচনা করেছিলেন নাটক ট্রইলাস ও ক্রিসেডি।
House of Fame এর পর তিনি রচনা করেন আরেকটি কাব্য “The Legende of Goode Wimmen” .  এটি সমকালীন ও পূর্বতন কিছু মহিয়সী নারীর জীবনী ও কথা বর্ণনা করা আছে। কিন্তু গ্রন্থটি নয়জন নারীর সম্পর্কে লেখার পরে শেষ হয়ে যায়। এটিকে অসমাপ্ত কাব্য হিসেবেই ধরা হয়। হয়তো সেই সময়েই তাঁর মনে শুরু হয়ে গেছিল বিখ্যাত Canterbury Tales এর প্লটের বুনন।

  Canterbury Tales চসারের জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য কর্ম। তিনি প্রধানত চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সমাজ ও জীবনযাত্রার কথা তারই অধিবাসীরা নিজের মুখে বলুক। তাই তিনি সৃষ্টি করলেন কিছু পর্যটকের যারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সামাজিক স্তরের প্রতিনিধি। এক রাত্রে সকলে কাকতলীয় ভাবে একত্রিত হওয়ার পর শুরু হলো সকলের নিজ নিজ গল্প বলা। এই গল্পগুলির মাধ্যমেই উঠে আসে ইংল্যান্ডের সমাজ, সংস্কার, রীতি-নীতি, ও রাজনীতি। এই কাব্যটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি কিন্তু তাঁর এই অসাধারণ ভাবনাটি আজ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রার এক সুন্দর ও সফল নথি হিসেবে পরিচিত।

  ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। Westminister Abbey তে তাঁর স্মৃতি সৌধ রচিত হয়। চসার ইংরাজি  তথা বিশ্বসাহিত্যের জয়যাত্রার একজন উজ্জ্বল পথ প্রদর্শক। তিনি অবিস্মরণীয়।

শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

বন্ধু

বন্ধু
কেয়া চ্যাটার্জী
মুখটা কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে সোহম। ঠাম্মার কাছে খুব বকা খাচ্ছে। সোহমের স্কুলের গাড়ির ড্রাইভার কাকু নালিশ করেছে যে সোহমকে প্রায়ই ফুটপাথে থাকা কিছু ছেলেমেয়ের সাথে দেখা যাচ্ছে। এই নিয়ে চারদিন হলো। সোহমকে খুঁজতে গিয়ে গাড়ি ছাড়তে দেরী হয়ে যাচ্ছে তার। ওদিকে অন্য অভিভাবকরা রাগারাগি করছে। তাকে মালিক বকছে। এত কিছু অভিযোগ শুনে, সোহম বাড়ি আসার পর থেকে ঠাম্মা অনবরত তাকে বকছেন। সঙ্গে রয়েছে নানা উপদেশ ও নিষেধাজ্ঞা। ফুটপাথের বাচ্চারা খারাপ। ওরা সোহমকে খারাপ করে দেবে। সোহমের লেখা পড়া হবে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তার সঙ্গে চলছে সোহমের হাত পা মুখ ভালো করে সাবান দিয়ে ধোয়ার যুদ্ধ। আট বছরের সোহম তার নিষ্পাপ মস্তিষ্কে এতো জটিল অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছে না। তার অতিরিক্ত টিফিন সে কিছু ছোট ছেলেমেয়েদের খাইয়ে দিয়ে আসে। এতে সে কি খারাপ হয়ে গেল? মা তো বলে খাবার নষ্ট করতে নেই, জল আমাদের সম্পদ। তাহলে? ওরা তো খাবারই পায়না। ওদের হাসি মুখ দেখলে সোহমের খুব আনন্দ হয়।
My first library: Box set of 10 board books for kids.

 সন্ধ্যেবেলা দীপা অফিস থেকে ফিরে সব শোনে শাশুড়ি মায়ের মুখে। রাগ হওয়ার থেকেও কৌতূহল হয় বেশি। অফিসের জামাকাপড় না পাল্টেই চলে যায় ছেলের ঘরে। সোহম তখন টেবিলের ওপর ঝুঁকে এক মনে  ছবি আঁকছে। সোহমের যখন যেটা ইচ্ছে করে দীপা তাকে বাধা দেয়না। পড়ায় মন না বসলে গল্পের বই পড়তে বা আঁকতে বলে। এখানে মাঠ নেই, বিকেলে খেলার অভ্যেসটা তৈরি করতে না পারায় একটু আফশোস আছে দীপার। সোহমের পাশে চেয়ার টেনে বসে দীপা। মাকে দেখে অন্য দিন আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সোহম কিন্ত আজ একটু ভয় পেল। সে জানে ঠাম্মা মাকে সব বলে দিয়েছে। কিন্তু মা এখনো বকছে না কেন!
 দীপা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল, “কি ব্যাপার বলতো? কারা ওরা?”  সোহম মায়ের আশ্বাস পেয়ে উজাড় করে দেয় মনের কথা,বলে, " মা জানো তো, স্কুলের পাশে যে ডাস্টবিনটা আছে, ওখানে একদিন আমি হাফ টিফিন ফেলে দিয়েছিলাম ঠাম্মা বকবে বলে। কিন্তু ঠাম্মা বোঝে না, অতো খাবার আমি খেতে পারি না তো! খাবারটা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার দুটো বাচ্চা খাবারটা ওই নোংরা থেকে তুলেই খেয়ে নিল। আমার না খুব খারাপ লাগল। আমরা খাবার ফেলে দিই আর ওরা কতোদিন না খেয়ে থাকে মা! পরেরদিন স্কুল ছুটি হওয়ার পর গাড়ি আসার আগে হাফ টিফিনটা ওদের হাতে দিলাম, ওরা খুব খুশি হয়ে খেলো। আমি তো ভাত খেয়ে যাই মা, অতো খাবার খেতে পারিনা। ওরা না কতদিন ভাতই খায়না, জানো! ওরা যখন খায় তখন ওদের হাসি দেখলে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু ঠাম্মা যে বলল ওরা নাকি খারাপ। কেন খারাপ মা? ওদের স্কুল যাওয়ার, খাবার কেনার টাকা নেই বলে?" আট বছরের ছেলের মানবিকতা আর্দ্র করলো দীপার চোখ। সত্যিই এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তার কাছে নেই। এক শ্রেণী ধনী হচ্ছে আরেক শ্রেণী ক্রমশ দরিদ্র হচ্ছে। এই ছোট্ট মনে সেই জটিলতা ঢোকানোর কি কোনো প্রয়োজন আছে? একটু চুপ করে ভেবে নেয় কিভাবে ছেলে আর শাশুড়ি মা উভয়কে ব্যালান্স করা যায়। সোহম নিস্পলক তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের সিদ্ধান্ত শোনার জন্য। ছেলের মুখ দেখে দীপা আলতো হেসে ছেলের চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, "কাল থেকে দুটো টিফিন বক্স পাঠাবো, কেমন? একটা তোর, আরেকটা তোর ওই বন্ধুদের।"
নির্মল হাসিতে ভরে গেল সোহমের নিষ্পাপ মুখ।
বন্ধু হওয়ার জন্য একটা সুন্দর মন সরকার এই পৃথিবীতে। আর কিচ্ছু প্রয়োজন নেই। এই বন্ধুত্বের হাত ধরে পৃথিবী হয়ে উঠবে সুন্দর।

মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৯

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস (History of English literature in Bengali)


Old English Literature/ Anglo Saxon Period  [450-1050]

Anglo Saxon যুগের একটি অন্যতম কাব্য Beawulf। কিন্ত old english যুগীয় সাহিত্যকে জানার জন্য আমাদের জেনে নিতে হবে Beawulf সমকালীন আরো কিছু কাব্যর ক
কথা।
Widsith: Widsith বা wanderer বা যাযাবর, সম্ভবত ইংরেজি সাহিত্যের সবথেকে  পুরোনো কাব্য। বইটির লেখক এবং রচনাকাল জানা যায়না। কিন্তু কাব্যের বক্তব্য অনুযায়ী বোঝা যায় যে এটি Saxons দের ইংল্যান্ড আসার আগে রচিত। সম্ভবত চতুর্থ শতকে। যদিও কাব্যটির সঙ্গে পরবর্তীকালে আরো কিছু নতুন লেখা সংযোজিত হয়েছে, এরকমই অনুমান করেন গবেষকগণ।
  কাব্যটি প্রধানত একজন পেশাদার গায়কের  জীবনী যিনি অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে গান করেন। সেই গায়কের অভিজ্ঞতার কথাই বর্ণিত হয়েছে Widsith এ। এই কাব্যটির মাধ্যমে জানা যায়, সাহিত্য বহুকাল আগে থেকেই পেশা হিসেবে গণ্য হতো এবং এতটাই ভালো পরিমানের অর্থ উপার্জন হতো যা জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল।
Deor's Lament: Widsith এর মতো এটিও একজন পেশাদার কবির জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই কাব্যের ভাব Widsith এর তুলনায় বিপরীতধর্মী। Widsith এর গায়ক যেখানে জীবনের জয়গান গেয়েছেন Deor এর কবি দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই ভেবে যে তার জীবন রাজার অঙ্গুলি হেলনের ওপর নির্ভর করছে। রাজা বা তার পৃষ্ঠপোষক যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে রাজ কবি বানান য়
তবে তার জীবনযাপন বিপন্ন হবে। আবার কবি এই ভেবেও আশান্বিত হয়েছেন যে তার তুলনায় আরো অনেক মানুষ আরো বিপন্ন জীবনযাপন করছেন। সবার জীবনেই খারাপ সময় আসে ও চলে যায়, তার জীবনের খারাপ পর্যায়ও একসময় কেটে যাবে।

History of English Literature

The Seafarer: এই কাব্যের দুটি অংশ আছে। প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে Saxon দের জীবনের কথা এবং সেই জীবনে সমুদ্র কতটা গুরুত্বপুর্ণ।  সমুদ্র অভিযান ও সমুদ্রের শত কাঠিন্য ও নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ার পরও মানুষের এই সমুদ্র জীবনকে উপভোগ করার গল্পই The Sea Farer।
দ্বিতীয় খণ্ডটি সম্পূর্ণরূপে রূপকধর্মী। সমুদ্র এখানে মানব জীবনের আরেক রূপ। তার উত্তাল ঢেউয়ের ওঠা নামা জীবনের চড়াই উৎরাই এর সমান যা পরবর্তীকালে মানুষকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। অনুমান করা হয় কোনো এক সন্ন্যাসী বা সমুদ্রপ্রেমী খ্রিস্টান প্রথম খণ্ডের সাথে সাযুজ্য রেখেই পরবর্তী খণ্ডটি রচনা করেছেন।

The Fight at Finnsburgh: Old English Period  এর আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো The Fight at Finnsburgh. তবে এটি  একটি ৫০ লাইনের কবিতা যা আরেকটি ধর্মীয় বইয়ের চামড়ার মলাটের সঙ্গে পাওয়া গেছিল। এটি একটি যুদ্ধের গান বা কবিতা। Hnaef নামক এক রাজার যুদ্ধ বিবরণী পাওয়া যায় এই কবিতায়।
এক রাত্রে যখন Hnaef তার ষাট জন সৈন্য নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন তখন Finn তার সহচরদের নিয়ে তাকে আক্রমণ করেন। Hnaef তৎক্ষণাৎ সকলকে জাগিয়ে তুলে যুদ্ধ শুরু করেন। কিন্তু এই যুদ্ধের পরিণতি আমরা জানতে পারিনা কারণ বইটির পরবর্তী অংশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
Waldere : এটিও একটি অসম্পূর্ণ কবিতা। এই কবিতায় Walter ও তাঁর স্ত্রী Hildgund এর কথা জানা যায়, যাঁরা Attila এর সভায় বন্দী হয়েছিলেন। পরে তারা প্রচুর সম্পত্তি নিয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু একটি পাহাড় অতিক্রম করতে গিয়ে তারা এক দস্যু Gunther ও তার সহচরদের সম্মুখীন হন যাদের মধ্যে Walter এর এক সৈনিক Hagen ছিল। Walter তাদের সাথে যুদ্ধ করে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
এই একই গল্প Latin ভাষায় রচিত হয়েছিল দশম শতাব্দীতে। তাছাড়া জার্মান কবিতা Nibelungenlied এও একই গল্প দেখা যায়। যদিও এটি Anglo Saxon যুগের কবিতা নয়, ওই যুগের অনেক পরে লেখা তবু প্রাচীন যুগীয় কাব্যগুলির এটি একটি অন্যতম নথি।

মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৯

ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস


Anglo-Saxon Period/Old English Period [450-1050]
পরিচিতি
Anglo-Saxon যুগের সাহিত্য সম্বন্ধে জানার আগে জানতে হবে এই anglo-saxon আসলে কারা। এরা জার্মানীর তিনটি উপজাতি― জুটস(jutes), এঙ্গেলস(Angls) এবং সাক্সনস (saxones), যারা ব্রিটেন অধিগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনের উপকূলবর্তী অঞ্চল অধিকার করে।
Angul বা Ongul শব্দটির অর্থ hook এবং ইংরাজি শব্দ Angle মাছ ধরা অর্থে ব্যবহার করা হতো। দুটি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে Angle প্রজাতির জীবিকা ছিল প্রধানত মাছ শিকার। এদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটতো সমুদ্রে
Seax, sax শব্দ দুটি থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ Saxon যার অর্থ ছোট ছুরি। এরা ছিল সাহসী, রাগী ও শক্তিশালী। এরা প্রধানত ছিল যোদ্ধা। এদের নামানুযায়ী ঐ বাসভূমির নামকরণ হলো Anglalond এবং তা ধীরে ধীরে লোকমুখে পরিবর্তিত হলো Englelond তারও পরে বর্তমান নাম England।
Jutland এর বাসিন্দাদের বলা হতো jutes। পরবর্তীকালে এই তিন উপজাতি রচিত সাহিত্যকে একসাথে বলা হল Anglo-Saxon Literature।

https://www.amazon.in/MARUTINANDAN-NX-Georgette-Embroidered-Stitched/dp/B07VKB69XZ/ref=as_sl_pc_qf_sp_asin_til?tag=keya230b-21&linkCode=w00&linkId=d007116a994e6723a0d7644a9f58e1c9&creativeASIN=B07VKB69XZ


জীবন:-
উপরোক্ত বর্ননা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই উপজাতির জীবন একেবারেই সহজ ছিল না। বরং কঠোর পরিশ্রম আর ব্যর্থতা ছিল এদের নিত্যসঙ্গী। একদিকে দুর্গম জঙ্গল জীবন ও হিংস্র পশুদের আক্রমণ, আরেকদিকে ছিল সুবিশাল সমুদ্র যার কুয়াশা, ঝড় ও তুষারপাত বারবার তাদের জীবন বিপন্ন করেছে। তবুও তারা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে অকুতোভয় হয়ে জীবনকে উপভোগ করেছে। তার থেকেও বেশি ভালোবাসতে শিখেছে সেই প্রতিকূল, অবাধ্য সমুদ্রকে। তাদের সেই ভালোবাসাই বারংবার ফুটে উঠেছে তাদের কাব্য, সাহিত্য ও ছবিতে।
সাহিত্য:
Beawulf:
Anglo-Saxon যুগের সাহিত্যের প্রসঙ্গ এলে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে সে যুগের প্রধান এবং অন্যতম রচনা Beawulf এর কথা। এটি আসলে একটি নিগৃহীত, শোষিত সমাজের পুনরুত্থানের গাঁথা, যা ঘটেছিল এক বীর যোদ্ধা Beawulf(বেউলফ)এর হাত ধরে। 
        গ্রেন্ডেল (Grendel) নামক এক নৃশংস রাক্ষস প্রতি সন্ধ্যেবেলা Danes (ডেন্স) এর রাজা Hrothgar (রথগার)এর সভাঘরে হামলা করতো এবং চারিদিক ক্ষয়ক্ষতি করা ছাড়াও আহার হিসেবে তুলে নিয়ে যেত এক একটি মানুষকে। এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাজা বহু চেষ্টা করেন। প্রায় বারো বছর ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ করে শুধু ক্ষয় হয়েছে সৈন্য বল ও অস্ত্র নষ্ট হয়েছে। অবশেষে রাজার এই দুর্দশার খবর সাগর পেরিয়ে এসে পৌঁছলো বীর বেউলফ এর কানে। তিনি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হলো রাজার দরবারে। সন্ধ্যেবেলা যখন গ্রেন্ডেল আবার হামলা করলো, তাকে সম্মুখীন হতে হলো বেউলফ ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর। বলাবাহুল্য গ্রেন্ডেল মৃত্যুমুখে পতিত হলো। সকলে যখন রাক্ষসের মৃত্যুর জন্য উল্লাসে মেতে উঠেছে, নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেছে নিশ্চিন্তে, ঠিক তখনই আক্রমণ করলো আরেকটি রাক্ষস বা monster। এটি গ্রেন্ডেলের মা। পুত্র শোকে কাতর হয়ে সে হামলা করেছে মনুষ্য প্রজাতির ওপর। এবারেও বেউলফ রক্ষাকর্তা হয়ে এগিয়ে এলো এবং রাক্ষসের পিছু পিছু সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। সমুদ্র রক্তে লাল হয়ে উঠল। সকলে যখন বেউলফের বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন বিশ্বাস রেখেছে শুধুমাত্র তাঁর অনুগামীরা। অবশেষে বেউলফ সেই রাক্ষসের কাটা মুন্ডু হাতে উঠে এলো তীরে। প্রথম খণ্ড এখানেই সমাপ্ত।
     এরপরের খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে  পঞ্চাশ বছর পরের ঘটনা। এই খণ্ডে বেউলফ বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর রাজত্বে সকল প্রজা সুখে রয়েছেন। রাজা তাঁর সব শত্রুদের বিনাশ করলেও একটি ড্রাগনকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। অবশেষে একসময় যখন সেই শত্রু হত্যালীলার নেশায় মেতে উঠেছে তখন বেউলফকে অস্ত্র হাতে নামতে হয়েছে ময়দানে। ড্রাগনের গুহায় যুদ্ধ করতে করতে উদ্ধার হয় প্রচুর মণি মাণিক‍্য। কিন্তু এই যুদ্ধে ড্রাগন নিহত হলেও, বেউলফ চরম আহত হন। রাজা দেখে খুশি হন যে তাঁর অনুচর ও অনুগামীরা ধন রত্নের লোভ না করে তাঁর সুস্থতার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অবশেষে বেউলফের মৃত্যু ঘটে এবং দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি হয়।
Beawulf ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি। এই একটি কাব্যগ্রন্থের মর্মার্থ উদ্ধারের নেশায় তৈরি হয়েছে একটি গোটা লাইব্রেরি। বহু গবেষক গবেষণা করেছেন এই কাব্যটি সম্পর্কে। কেউ মনে করেছেন সত্যিই সেই সময় বেউলফ ও গ্রেন্ডেলের মতো শক্তিশালী মানুষ ও দানব ছিল। কেউ আবার এই যুক্তি নস্যাৎ করে বলেছেন, গোটাটাই একটা রূপক কাহিনী। এই কাহিনীর প্রত্যেকটি পংক্তি ও ঘটনা মানুষের লড়াইয়ের চিত্র। কারুর মতে বেউলফ হলো আসলে মানব জাতি স্বয়ং যার অদম্য মানসিক জোর, সাহস ও পরিশ্রমের সামনে গ্রেন্ডেল রূপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূলতা হার মেনেছে বারবার। এই যুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ বলেছেন বেউলফের তিনটি শত্রু হলো তিনটি বাধা। সমুদ্র, সমুদ্রে পারি দেওয়া ও সেই সমুদ্রকে নিজের জীবন নির্বাহের মাধ্যম বানানো। বলাবাহুল্য মানুষ এই তিনটি কর্মেই সফলতা অর্জন করেছেন।  এছাড়াও, লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, anglo saxon উপজাতির জীবনে সমুদ্র যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা বারবার ফুটে উঠেছে এই কাব্যে।
বেউলফের ছন্দ, বাক্যগঠনশৈলী ইত্যাদি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। এছাড়াও, Old English যুগীয় আরো কিছু কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। যাদের নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে।



রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯

ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস

 ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস

সাহিত্য কি ও পড়বো কেন?

  সাহিত্য পৃথিবীর একমাত্র বস্তু যা কোনো সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনা। একটি সাহিত্য সৃষ্ট হয় এই পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জন্য। 

  সাহিত্যের কথা শুরু করলে প্রথমেই চলে আসে মানবজাতির অগ্রগতির ইতিহাসের কথা। এই আধুনিক পৃথিবীর অধিবাসীরা মনুষ‍্যেতর প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার সফরের মাধ্যমেই অর্জন করেছে জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, অনুভব ক্ষমতা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা। এই ক্ষমতা গুলিই ক্রমে ব্যক্ত হয়েছে সাহিত্য হিসেবে।

  মানুষ গুহা জীবন থেকে বেরিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করার মাধ্যমে পার করেছে সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত গুহাচিত্র তৎকালীন জীবনযাত্রার ছবি তুলে ধরে। আসলে সাহিত্য হলো সমাজের আয়না। আমরা যে যুগে বাস করছি তার লিখিত পটচিত্র বা যে যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে তার সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে পারি একমাত্র সমকালীন সাহিত্যের সাহায্যে।

  তাই সাহিত্য বুঝতে গেলে অবশ্যই বুঝতে হবে ইতিহাস। মানুষের স্বপ্ন, আশা, আশাভঙ্গ, সামাজিক আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, রীতি-নীতি ইত্যাদি বোঝার জন্য যেমন সাহিত্য এক মাধ্যম তেমনই ইতিহাসও আরেকটি মূল মাধ্যম। এরিস্টটল বলেছেন, “Poetry is more serious and philosophical than history.” আবার গোথ সাহিত্যকে বলেছেন, “the humanization of the whole world.”

  একটি সাহিত্য তখনই অমরত্ব লাভ করে যখন তার বক্তব্য স্থান, কাল, পাত্রের গন্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনীন ও সর্বকালীন হয়ে ওঠে। যেভাবে বর্ষায় ঠোঁটে গুনগুনিয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ, সেভাবেই পাখির ডাকে মনে পড়ে যান কবি কিটস, আবার বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলতে থাকা তারুণ্য অনুধাবন করতে পারেন John Osborne এর নাটক “Look Back in Anger” এর মর্মার্থ। বিশ্বাস ঘাতকতার কথা উঠলে যেমন আসে মীরজাফরের উদাহরণ তেমনই আসে Mackbeth এর প্রসঙ্গ।

 আরেকটি বিশেষ আঙ্গিক যেকোনো সাহিত্যকে প্রাচুর্য প্রদান করে তা হলো লেখকের নিজস্ব ও অভিনব স্টাইল। যখন একজন লেখক তাঁর কলমের মাধ্যমে পাঠককূলের সামনে সমাজের চিত্র তুলে ধরেন তখন সেই চিত্রে মিশে থাকে সেই লেখকের নিজস্ব চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গী। কারুর দৃষ্টিভঙ্গী হতে পারে সদর্থক কারুর বা নঞ‌র্থক। এই দুই ধারার চিন্তাভাবনাকে পাশাপাশি রেখে বিচার করাকেই বলা হয় “food for thought”।

 শুধুমাত্র ইতিহাস বা সমাজ নয়, সাহিত্য কর্মের আরেকটি বিশেষ কাজ হলো মানুষকে চেনা বা চেনানো। রবিঠাকুর তাঁর “ঘরে বাইরে” উপন্যাসের শুরুতেই বলেছিলেন মানব চরিত্র বহুমুখী। একজন মানুষকে আমরা যেভাবে দেখি সেই মানুষ স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে পারেন। মানব চরিত্র বিশ্লেষণ সবথেকে কঠিন ও দুরূহ কাজ যে কর্মযজ্ঞে ব্রতী হয়েছে শত শত কলম। 

 সাহিত্য আসলে শব্দ দ্বারা রচিত জীবনের এক সুন্দর ছবি। এটি মানুষের চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও অনুধাবন ক্ষমতার এক ও একমাত্র লিখিত নথি। মানব জীবনের উত্থান পতনের ইতিহাস থেকে আধুনিক সমাজ গঠন ও সেই সমাজের জীবনযাত্রা, মানসিক ও তাত্ত্বিক গতিবিধির বর্ণনায় মুখরিত হয় আধুনিক সাহিত্যের বক্তব্য। সাহিত্য এমন এক বহতা নদী যার জোয়ার আছে কিন্তু ভাঁটা নেই।

[ পরবর্তী পর্ব: Old English/ Anglo-Saxon Period]





বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৯

নিখোঁজ

নিখোঁজ?
কেয়া চ্যাটার্জী
দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো একটি মেয়ে। চুলগুলো এলোমেলো, বিধ্বস্ত চেহারা, চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় আগের রাতে ঘুমায়নি। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা তড়িঘড়ি বের করে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, "এই ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ কিছু করুন।" কদমতলা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অতনু বিশ্বাস ভীষণ শান্ত স্বরে বললেন, "বসুন। জল খান। তারপর ঠান্ডা মাথায় সব কিছু বলুন। আগে অভিযোগ লিখি। সব কিছুরই তো একটা নিয়ম আছে।"  মেয়েটি একটু স্থিতু হওয়ার পর বলতে শুরু করলো, “আমি পরমা লাহা। ছবিটা আমার বন্ধু অপূর্ব নাথের। আমরা একই কলেজের বন্ধু।”
― বন্ধু না বয়ফ্রেন্ড? বলে রাখলে সুবিধা হয় আর কি।
অফিসারের প্রশ্নে একটু ইতস্তত করে পরমা বলল, “হ্যাঁ, বয়ফ্রেন্ড। পাঁচ বছরের সম্পর্ক। গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি ব্যাঙ্গালোর যাই একটা কোর্সের জন্য। আর অপূর্ব এখানেই থেকে যায়। একটা চাকরি পেয়েছিল। আমাদের প্রায়ই কথা হতো ফোনে, মেসেজে। গত দু বছরে চার-পাঁচ বার কলকাতা এসে দেখাও হয়েছে। কিন্তু লাস্ট একসপ্তাহ কিছুতেই ওর কোনো ট্রেস পাচ্ছি না। ফোন বন্ধ, মেসেজ বা ভিডিও কলের তো প্রশ্নই ওঠে না।” গলা কেঁপে ওঠে পরমার।
― বাড়িতে ফোন করেছেন? বা অন্যকোনো বন্ধুদের?
― ওর বা আমার বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা জানে না। তবে একজন বন্ধুকে দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। ওখানেও নেই। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কারুর কাছেও ওর কোনো খোঁজ নেই।
― ছেলেটির ঠিকানা দিন।
পরমা ফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করে বলল, "আসল বাড়ি কৃষ্ণনগর। ওখানকার ঠিকানা জানিনা। এখানে চেতলায় থাকতো। ভাড়া বাড়ির ঠিকানা এটা।”
অতনু বাবু দেখলেন স্ক্রিনে ভাসছে একটি তেইশ চব্বিশ বছর বয়সী ছেলের ছবি। খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি আর জিন্সে, তার এলোমেলো চুল আরো মোহময়ী। একটি দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে, দেওয়ালে একটি শ্বেত পাথরের ফলকে খোদাই করা ঠিকানা ২/২এ, গোবিন্দ আঢ‍্য রোড।
দিন সাতেক কেটে গেছে। হাতে কিছু ছোট খাটো কেস মিটিয়ে অতনু বাবু অপূর্বর কেসে মনোনিবেশ করলেন। বাড়িটা পুরোনো আমলের। সমস্ত প্রটোকল ভেঙে রাস্তার ধার ঘেঁষে উঠে গেছে বাড়ির দেওয়াল, সামনেই দরজার দুধারে লাল সিমেন্টে বাঁধানো রক। কলিং বেল নেই। লম্বা দরজার গোল লোহার কড়া বার তিনেক নাড়াতেই খট করে ভিতর থেকে খুলে গেল দরজাটি। সামনে দাঁড়িয়ে একজন বয়স্ক লোক। গাল ভর্তি সাদা দাঁড়ি-গোঁফ, পরণে একটি ফতুয়া আর হাঁটু অবধি ওঠানো ধুতি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পুলিশ দেখে একটু হকচকিয়ে গেছেন। শীর্ণ শরীরে একটু বল এনে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার?” অতনু বাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বললেন, "একটি ছেলের খোঁজে এসেছি। বসে কথা বলা যাক?” উঠোনেই একটি চেয়ারে বসার ব্যবস্থা হলো। উঠোনের একপাশে কুয়োতলা ও বাথরুম। বাড়িটি দুতলা তবে জীর্ণ। আয়তন ও পজিশনের জন্য যেকোনো প্রোমোটারের কাছে অতি লোভনীয়। অপূর্বর ছবি দেখে বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “হ্যাঁ ও তো এখানেই থাকতো। প্রায় পাঁচ বছর ছিল। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে। মাঝখানে একটা চাকরিও পেয়েছিল। ভাড়া সময় মতোই দিত।” অতনু বাবু বললেন, “তারপর? ভাড়া তুলে দিলেন, নাকি নিজেই চলে গেল?” বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “আমি কেন তুলবো স্যার? ঝামেলা তো কিছু ছিল না ছেলেটার। সকালে বেরোত, রাতে ফিরত। আরো পাঁচ ঘর ভাড়া থাকে নীচ-ওপর মিলিয়ে। অপূর্ব নিজেই এক সন্ধ্যেবেলা এসে বলল, “কাকু অফিস মুম্বাইতে পোস্টিং দিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে দেবো।” আমার একটু খারাপই লাগলো। এতদিন ছিল ছেলেটা। তার দুদিন পরেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।” অতনু একবার তার ঘরটা দেখে এলেন। নেহাতই ছোট একটা আদ্দিকালের ঘর, তার কোথাও কোনো রহস্য নেই। নতুন ভাড়াটের জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে, ফলে কোনো রকম ক্লু পাওয়ার ভাবনাও অলীক। অতনু বেরিয়ে এলেন। বৃদ্ধকে বললেন, “কোনো রকম খবর যদি পান আমায় ফোন করবেন।” বৃদ্ধ একটা কাগজে অতনুর মোবাইল নম্বর লিখে নিয়ে ঘাড় নাড়লেন।

https://www.amazon.in/Avengers-Kidsville-Sweatshirt-STY-18-19-005851_Blue_13-14-Years/dp/B07SL43J6T/ref=as_sl_pc_qf_sp_asin_til?tag=keya230b-21&linkCode=w00&linkId=74812a4b834d1bdd2e6ce0303a64cd07&creativeASIN=B07SL43J6T

  এরপর যেতে হবে ছেলেটির অফিসে। পরমার কথা অনুযায়ী অফিসটা রাজারহাটে। ঠিকানা অনুসরণ করে অতনু এসে পৌঁছলো একটি চারতলা বাড়ীর সামনে। দেখলেই বোঝা যায় বাড়ীটা পুরোপুরি কমার্শিয়াল। বাড়ীটির তিনতলায় রিসেপশনে এসে অপূর্ব নাথের নাম নিলে মেয়েটি কিছুক্ষন ভ্রূ কুঁচকে ভেবে নিয়ে কম্পিউটারে ডেটাবেস দেখে বলল, “হ্যাঁ, এই ছেলেটি এখানে কাজ করতো, কিন্তু প্রায় দেড়-দু সপ্তাহ হলো ও কিছু না জানিয়েই আসছে না। আমরা মেইল করি, ও রিপ্লাই দেয় না, ফোনও বন্ধ। অগত্যা ওর পোস্টে নতুন ছেলে এপয়েন্ট করা হয়।” অতনু বললেন, “ওকে কি মুম্বাই ট্রান্সফার করা হয়েছিল এর মধ্যে?” মেয়েটি আবার কম্পিউটারে চোখ বুলিয়ে বলল, “না তো স্যার। সেরকম কোনো ইনফরমেশন এখানে নেই। আর ছেলেটি কাজে join করেছে মাস দুই হয়েছে। এর মধ্যে হেড অফিসে পোস্টিংয়ের কোনো চান্সই নেই।” অতনু কিছুক্ষন চুপচাপ চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে ম্যাডাম, ওর বাড়ীর ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিন। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।” অফিস থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ও তাঁর সহযোগী মৃণাল রায়কে ফোন করে সব ডিটেইলস দিয়ে খোঁজ নিতে বলে অতনু চললেন পরমার বাড়ী।

 “দেখুন অফিসার, এটা তো আর আমরিশ পুরী আর শাহরুখ খানের সিনেমা নয় যে ভিলেনের মেয়ের সাথে প্রেম করছে দেখে ভিলেন হিরোকে সরিয়ে দিলো। আপনি যদি আমায় সন্দেহ করে থাকেন তাহলে আপনি ভুল করছেন। আমি ছেলেটিকে চিনিনা।” গরম কফি খেতে খেতে সাততলার বিশাল এপার্টমেন্টের ড্রয়িং রুমে বসে জানালেন বিশ্বজিৎ লাহা, পরমার বাবা। একটু দূরেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে পরমা। পাশের সোফা আর চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসে আছে আরো জনা কয়েক সমবয়সী ছেলেমেয়ে। তারা সকলেই পরমা আর অপূর্বর ক্লাসমেট বা ব্যাচমেট। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “অপূর্বর সাথে অনেকদিনই কোনো যোগাযোগ ছিল না আমাদের। আসলে ও নিজেই যোগাযোগ রাখতে চায়নি বলা যায়। কিছু একটা লুকিয়ে রাখতো আমাদের থেকে। আমরাও ওর ব্যবহারে খুব বিরক্ত হতাম। ওর অফিস বা কাজ সম্পর্কে কিছুই বলতে চাইতো না। ধীরে ধীরে, যা হয় আর কি, সম্পর্ক রইল না।” অতনু পরমার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনিও কি কিছুই জানতেন না পরমা?” পরমা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। অতনু বোঝেন অপূর্ব কোনো এক চক্রে আটকে পড়েছে যার ব্যাপারে সে কাউকে কিছুই বলতে চায়নি বা পারেনি। লোক দেখানো একটা চাকরি সে জুটিয়ে রেখেছিল কিন্তু তলে তলে জড়িয়েছে আরো বড় কোনো জালে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়লেন তিনি। কেসটা একটু জটিল। কোনো সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না এই রহস্যের কিনারা করার মতো। বাইকে করে বেশ কিছুটা চলে এসে অনুভব করলেন পিছনে যেন আরেকটা বাইক তাকে অনুসরণ করছে। ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে দিতে পিছনের বাইকটা কাছাকাছি এসে পড়ল। অতনু দেখলেন অপূর্বর বন্ধুদের একজন। কাছে এসে সে বলল, “ভালো করেছেন বাইকটা থামিয়ে, আপনাকে ডাকতেও পারছিলাম না, আবার আপনার বুলেটের সঙ্গে পাল্লা দিতেও পারছিলাম না।” বলেই হাসল ছেলেটি। মুখটি বেশ গোলগাল ও হাসিখুশি।অতনু বললেন, “এমন কিছু কি বলতে চাও যেটা ওখানে বলতে পারছিলে না?” ছেলেটি এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “কোথাও গিয়ে বসলে ভালো হয় স্যার। রাস্তায় এভাবে বলা যাবেনা।” অগত্যা অতনু তাকে তার বাড়ীতেই নিয়ে এলেন। একে অবিবাহিত, তার উপর কিছুদিন আগে মা-ও ছেড়ে চলে গেছেন। রাত দশটায় তার বাড়ীতে অতিথি এলে কেউ রুষ্ট হওয়ার নেই। বাবার তৈরি একতলা বাড়ীতেই তিনি তার ত্রিশটা বছর কাটিয়েছেন। আগামী বছর গুলোও হয়তো এভাবেই কাটবে। বসার ঘরে পুরোনো একটি সোফায় গা এলিয়ে দিল ছেলেটি। হেসে বলল, “আমার নাম স্যার জিমুত রায়। আমি অপূর্বর সাথে স্কুল আর কলেজ যুবন দুটোই কাটিয়েছি তাই ওকে পরমা বা ওর অন্যান্য বন্ধুদের থেকে একটু হলেও বেশি চিনি।” একগ্লাস জল জিমুতের দিকে এগিয়ে দিয়ে অতনু বললেন, “পুরোটা বলো জিমুত। তোমাকে খুব দরকার।” জলটা ঢকঢক করে খেয়ে জিমুত বলল, “আমরা ক্লাস নাইন থেকে একসাথে। একসাথে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, গ্রাজুয়েশন।” অতনু বললেন, “তুমিও কি কৃষ্ণনগরের?” জিমুত মাথা নেড়ে বলল, “ওর বাড়ি কৃষ্ণনগর ঠিকই কিন্তু অপূর্ব এখানে যখন আসে ও তখন ক্লাস নাইন। ওর বাবার কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর পড়াশুনা চালানোর জন্য ওকে ওর মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেয় ওর বাড়ির লোক।” অতনু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তাই নাকি? ওর মামাবাড়ি কোথায়?” জিমুত গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, “চেতলার আশেপাশেই। পরে যখন কলেজে ওঠে তখন মামাবাড়ি ছেড়ে দিয়ে একটা ভাড়াবাড়িতে ওঠে। আসলে ওর মামীমা খুব অশান্তি শুরু করেছিলেন ওর থাকা খাবার খরচ নিয়ে। খুব আত্মাভিমানী ছেলে ও।” অতনু বেশ আগ্রহ বোধ করেন এবার, বলেন, “তারপর? ওর মধ্যে কি কিছু অস্বাভাবিকত্ব ছিল?” জিমুত একটু চুপ করে রইল। যেন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। তারপর বলল, “অস্বাভাবিকত্ বলতে যা বোঝায় তা সকলের চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু দারিদ্র ওকে বুঝিয়েছিল যে জীবনে টাকাটাই সব। আর সেই বোধ থেকে ও ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ থেকেই রোজগারের পথ খুঁজে নেয়। ওর হাতে আসে প্রচুর কাঁচা টাকা।” অতনু অবাক হয়ে বলেন, “কাঁচা টাকা! সতের আঠারো বছর বয়সে কি করে কাঁচা টাকা হাতে আসে? ও কি কোনো এন্টিসোশ্যাল চক্রে জড়িত হয়ে পড়েছিল?” জিমুত মাথা নেড়ে বলল, “জানিনা স্যার। জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাইনি। বেশি প্রশ্ন করলে বরং এড়িয়ে যেত।” অতনু নিচের ঠোঁটে বুড়োআঙুল ছুঁইয়ে কিছু ভাবলেন তারপর বললেন, “লাস্ট কবে দেখা হয়েছে তোমার সাথে?” জিমুত বলল, “মাসখানেক আগে। নিজেই দেখা করে একটা ব্যাগ দেয় আমাকে। বলে ও নিজে এসেই নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এলো না। আমি কখনো খুলে দেখিনি কিন্তু ব্যাগের ওপর একটা নার্সিং হোমের নাম আর ঠিকানা লেখা। যেদিন ব্যাগটা দেয় সেদিন খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে। বলেছিল ও ছাড়া যেন কাউকে ব্যাগটা না দিই আর কাউকে যেন ভুলেও না বলি যে ব্যাগটা ও আমায় দিয়েছে। আমার মনে হয় ও কোনো চক্রে আটকে পড়েছে স্যার। একটু দেখুন।” জিমুত একটা ব্যাগ হাতে দেয় অতনুর। কালো রঙের একটা সাদামাটা ব্যাগ। ওপরে লেখা 'উই কেয়ার নার্সিং হোম' ট্যাংরা এলাকায় অবস্থান। জিমুতকে বিদায় জানিয়ে ডিনার সেরে ব্যাগটা নিয়ে বসেন অতনু।
  ব্যাগের মধ্যে রয়েছে অনেক কাগজ। সবই মেডিক্যালের কাগজ। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট, এক্স-রে রিপোর্ট, ইউ-এস-জি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কমার্সের ছাত্র অপূর্ব এই সমস্ত কাগজ নিয়ে আসলে কি করতে পারে? এগুলো কি তার পরিচিত কারুর রিপোর্ট? কিন্তু এমন কি আছে এই কাগজে যা সে কাউকে বলতেই বারণ করে দিল? মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করতে শুরু করলো তার। আজ সারাদিন এই একটা কেস নিয়ে বেশ মাথা ঘামাতে হয়েছে। এক পেগ হুইস্কি খেয়ে নিদ্রামগ্ন হলেন অতনু বিশ্বাস।
 ঘুম ভাঙলো সিনিয়ার অফিসারের ফোনে। সকাল সাতটা। “অতনু তোমার এলাকায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। স্পটে যাও তাড়াতাড়ি।” এরকম ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবুও অতনুর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কাল রাতে জিমুত একাই বেরিয়েছিল। বাড়ি ফিরেছে কিনা জানা হয়নি আর। রাস্তার ধারে বিশাল ফাঁকা জমি, ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি। তার মধ্যেই উল্টে পরে আছে একটা বাইক। বডিটা তুলে আনা হয়েছে। সারা গায়ে চাপ চাপ রক্ত জমে, রাস্তার সাথে ঘষা লেগে চামড়া উঠে গেছে শরীরের অনেক জায়গায়। তবু মুখটা স্পষ্ট। জিমুত। “বাইকের ব্রেকের তার কাটা ছিল স্যার। স্পিড বাড়াতেই স্কিট খেয়ে উল্টে পড়েছে বোধহয়।” একজন কনস্টেবল কথাটা বলেই আবার বাইকটি উদ্ধারের কাজে লেগে পড়ল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অতনুর। কিছু লোভী, স্বার্থপর মানুষের জন্য কতো নিরপরাধীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বাইক ঘুরিয়ে আবার চলল সে বাড়ির দিকে। দোতলায় উঠে এসে চমকে উঠলো অতনু, সেন্টার টেবিলে রাখা ব্যাগটা নেই। কাল রাতে এখানেই রেখেছিল সে ব্যাগটা। ছিঃ ছিঃ এতো বড় ব্লান্ডার কেউ করে! নিজের অজান্তেই একটা ঘুষি ঠুকে দিল সে দেওয়ালে। মাথার শিরা দুটো দপদপ করছে, অপরাধী তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এই কেসের নিষ্পত্তি সে করবেই।
 কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে একটা রিকশা করে পৌঁছে যাওয়া যায় লোকাল থানায়। অপূর্বর ছবি ও পরিচয় দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তার কেস হিস্ট্রি হাতে চলে এলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, অপূর্বর নামে মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে প্রায় মাসখানেক আগে। ওর দাদা এসে করে গেছে। কিন্তু তারপর আর কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। এভাবে একটা পরিবার একটা ছেলেকে কি ভুলে যেতে পারে? থানার এক অফিসারের বাইকে চেপে অতনু এসে পৌঁছায় অপূর্বর বাড়ি। বড় রাস্তার পাশেই দুতলা, ছিমছাম, বাগান ঘেরা বাড়ি। ছোট্ট একটা লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢোকার আগেই গেটের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন ভদ্রমহিলা। পরণে ছাপা শাড়ি, আঁচলটা কোমড়ে গোঁজা, কপালের সিঁদুর ঘামে লেপ্টে গেছে, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ-বাহান্ন। স্বরূপের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। স্বরূপ পকেট থেকে কার্ড বের করে বললে, “কলকাতা পুলিশ।” কথাটা শুনে একটু থমকে গেলেন ভদ্রমহিলা। যেন এটা কোনোদিন আশা করেননি। একটু ইতস্তত করে বললেন, “এই বারান্দাতেই বসুন, বাড়িতে কেউ নেই। কি জানার আছে বলুন?” অপমানিত হলেও এগুলো সহ্য করা অভ্যেস হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলো, “অপূর্বর সম্পর্কে জানতে এসেছি।” মহিলা তেমনই কঠোর মুখে বললেন, “বলুন কি জানতে চান?” স্বরূপ একটু অবাক হলো। মহিলা যেন সব জেরার জন্যই প্রস্তুত। বলল, “ও কবে থেকে কলকাতায় আছে? কিভাবে নিজের পড়াশোনা চালাতো ওখানে? কোথায় থাকতো? কি চাকরি করতো? এইসব উত্তর আমার বিস্তারিত ভাবে চাই। আপনারা তো মিসিং ডায়েরি করেছিলেন। কলকাতায় কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি? কেন এখানে একটা ডায়েরি লিখিয়ে চুপ করে গেছেন?” মহিলা এবার মোড়া এনে বসলেন। একটু যেন ক্লান্ত লাগছে তাকে। কপালের মাঝখানটা চেপে ধরে কিছুক্ষন বসে থাকলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, “আমার দুই ছেলে। রূপ ও অপূর্ব। অপু যখন ক্লাস নাইনে তখন ওর বাবার একটা স্ট্রোক হয়ে বাঁদিকটা পরে যায়। কারখানার কাজটা যেতে বসেছিল, বড়বাবুকে হাতপায়ে ধরে বড় ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দিই। উচ্চমাধ্যমিকের পর ওর পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ছোটটাকে মাধ্যমিকের পর দাদার কাছে পাঠিয়ে দিই। কলকাতায়। কলেজের গন্ডীটা পেরোলেও তো অনেক মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু সহজ সরল ছেলেটা বড় শহরে গিয়ে কেমন পাল্টে গেল। মাস ছয়েকের মধ্যে টাকা পাঠাতে শুরু করলো। কখনো দশ হাজার, কখনো বিশ। সবই অপূর্ব নাথের কলকাতার একাউন্ট থেকে। আমাদের বুক কাঁপলো। ও তো তখনও স্কুল পাশ করেনি। দাদা একদিন ফোন করে বলল, অপুকে নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি হচ্ছে। বৌদি ওর হাবভাব চালচলন কিছুই মেনে নিতে পারছে না। ভীষণ উদ্ধত হয়ে পড়েছে ও। আমি তো অবাক। আমার ছেলে তো এমন ছিল না।” এইটুকু বলে মহিলা একটু থামলেন। হয়তো দম নিতে। হয়তো কান্নার বেগ সামাল দিতে। হঠাৎ গেট খোলার শব্দে দুজনেই সামনে তাকালো। একটি বছর ছাব্বিশ-সাতাশের ছেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। বারান্দায় উঠে এসে অতনুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনি পুলিশ? কি চাই?” অসন্তোষ চেপে অতনু বলল, “আপনার ভাইয়ের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে এসেছি।” ছেলেটি ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার কোনো ভাই নেই। আপনি আসতে পারেন।” হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল অতনুর। ওপার থেকে কিছু শুনে উঠে বসলো সে। রূপের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন আমার সাথে।” রূপ অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
  একটা জানালাবিহীন ঘরে বসে আছে তিনটে প্রাণী। রূপ, পরমা আর অতনু। একটু আগে একটা মৃতদেহ সনাক্ত করে এসেছে ওরা। দুজনেই বলেছে ওটা অপূর্বর লাশ নয়। অতনু টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “উই কেয়ার নার্সিংহোম।” শব্দ তিনটি শুনেই যেন চমকে উঠল সামনের দুজন। অতনু ঠিক এটাই চেয়েছিল। ঠোঁটের কোণে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলল, “নামটা ভীষণ চেনা তাই না?” রূপ ইতস্তত করে বলল, “ভাই ওখানে কাজ করতো।” অতনু উঠে দাঁড়িয়ে রূপের সামনে টেবিলে হেলান দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “শুধু অপূর্ব কাজ করতো?” রূপ আড় চোখে পরমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনো অপরিচিতর সামনে কিছু বলতে পারবো না স্যার।” অতনু সেরকমই ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলল, “পরমা আপনার অপরিচিতা নাকি?” রূপ বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মতো তাকালো অতনুর দিকে, পরমাও ঘামছে। অতনু হঠাৎ রূপের কলার ধরে তুলে একটা জোর ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, “সত্যি কথাগুলো ভালোয় ভালোয় বলবি নাকি লাঠি আনবো? কেন নিজের ভাইকে মেরেছিস বল?” এমন বিনা মেঘে বজ্রপাতে রূপ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো, “বলছি স্যার বলছি। মারবেন না। এই মেয়েটা আমায় ফাঁসিয়েছে।” পরমা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বলল, “রূপ! আমি তোমায় ফাঁসিয়েছি? প্ল্যানটা তোমার ছিল, আর আমি তোমায় ফাঁসিয়েছি?” অতনু মনে মনে স্বস্তি পেল। তীর ঠিকঠাক চাকে গিয়ে লেগেছে। ধমকের সুরে বললো, “এসব দোষারোপ পর্ব জেলে বসে করবে দুজনে। আগে পুরো ঘটনা বলো। ঠিক আছে আমিই বলছি। তার আগে একজনকে ডেকে নেবো।” অতনুর কথা শেষ হতেই একজন অফিসার ঢুকে এলেন ঘরে সঙ্গে বিশ্বজিৎ লাহা। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু বিড়বিড় করে বলে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। অতনু হাসি চেপে বলল, “বলুন মিস্টার আমরিশ পুরী কেমন চলছে আপনার নার্সিংহোমের ব্যবসা?” মিস্টার লাহা উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল।


অতনু সামান্য হেসে বলতে শুরু করলো, “ একটা থ্রিলার গল্পে দু ধরণের অপরাধী থাকে জানেন তো। এক, মাথা মোটা যে ভাবে অপরাধ করে ফেলে প্রমান লোপাট করলেই হলো। বোকা পুলিশ কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। আর এক ধরণের আছে যে অপরপক্ষকে সমান শক্তিশালী ভেবেই অপরাধ করে। এরা খুব ধূর্ত, এদের ধরতে পারাটা খুব চাপের। কিন্তু এরা যদি একত্র হয় তাহলেও কিন্তু কেস বেশ জটিল হয়ে যায়।” মিস্টার লাহা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনার গল্প গাছা শোনার জন্য এখানে বসে থাকতে পারবো না মিস্টার বিশ্বাস। আমি আসছি।”  বিশ্বজিৎ বাবু ওঠার উদ্যোগ করতেই অতনুর বন্দুকের ঠান্ডা নল তার কানের লতি ছুঁলো, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজিৎ লাহা আবার স্বস্থানে বসে পড়লেন। অতনু আবার ঠোঁটে হাসি এনে বলল, '' গুড। কিন্তু মিস্টার লাহা গল্পটা যে আপনাকে শুনতেই হবে। কারণ আপনি তো এই গল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। আচ্ছা এতো পাকা খেলোয়াড় হয়ে এরকম আনাড়ির হাতে খেলার শেষটা দিলেন কি করে বলুন তো?” বিশ্বজিৎ লাহা একবার রূপের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনেই অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন, “যা বলতে চান স্পষ্ট করে বলুন।” অতনু এবার তার গাম্ভীর্য পরিধান করে বলতে শুরু  করলো, “জিমুতের মৃত্যুর পর আমার এই কেসটা নিয়ে একটা রোখ চেপে গেছিল। একজন নিরপরাধী মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তার ওপর বাড়ি এসে দেখি জিমুতের দেওয়া ব্যাগটা আমারই বাড়ি থেকে চুরি গেছে। মাথাটা গেল আরো গরম হয়ে। বুঝলাম এই ঘি সোজা আঙুলে উঠবে না। তাই সিভিল ড্রেসে চলে গেলাম কৃষ্ণনগর। আর এখানে রেখে গেলাম আমার ক্রাইম ব্রাঞ্চ এসিস্টেন্ট তপন বসুকে। সঙ্গের অফিসার মাথা নাড়লেন। তপন উই কেয়ার নার্সিংহোমে পেট ব্যথার অভিনয় করে পেশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়। তাকে সকালবেলা ভর্তি নিয়ে নেওয়ার পর, সারাদিনে বিভিন্ন টেস্ট করার পর সন্ধ্যেবেলা জানানো হয় তার কিডনি ড্যামেজ হয়েছে তাই ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিতেও বলা হয়। আমাদের অফিসাররা পেশেন্ট পার্টির কর্তব্য সেরে সেই রাতে তপনকে ও আরো একজন অফিসারকে পেশেন্ট পার্টি হিসেবে ওখানে রেখে বাইরে টহল দিতে থাকেন আর ভেতরে তপন ও তার সহকর্মী তার কাজ করতে থাকে। ওরা মাঝরাতে ওদের মিশন শুরু করে। প্রথমত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলিকে মিটার রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিকল করে। এই সুযোগে অফিসে ঢুকে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে নার্সিংহোমের মালিক হিসেবে ওদের সামনে উঠে আসে বিশ্বজিৎ লাহার নাম। আরো কিছু কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে এই নার্সিংহোম অর্গান ট্রাফিকিং চক্রের একটি মূল পান্ডা। অর্থাৎ রুগীর সামান্য রোগকে কোনো একটি অর্গান ফেইলিওর বলে, ভুল রিপোর্ট দেখিয়ে প্রচুর টাকা হাতানো ও সাথে সাথে ভালো অর্গান পাচার করার কাজ করা হয় এই নার্সিংহোমে। আমাদের টিম অনেকদিন ধরেই এই চক্রের সন্ধানে ছিল কিন্তু কোনো সূত্র না পাওয়ায় এগোতে পারছিল না। সূত্রটি দিয়ে গেল জিমুত। এদিকে আমি  আমার কৃষ্ণনগরের অফিসার মৃণাল রায়কে সব কিছু জানিয়ে অপূর্বর বাড়ি আর বাড়ির লোকের ওপর নজর রাখতে বলে দিয়েছিলাম। অপূর্ব নাথের বাড়িতে থাকেন একজন অসুস্থ বাবা, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা মা আর তার দাদা, রূপ নাথ। আমার প্রথম থেকেই ভীষণ খটকা লেগেছিল এই ব্যাপারে যে একটা ছেলের মিসিং হওয়ার পর তার বাড়ির লোক দ্বিতীয়বার কেন তার খোঁজ করল না? আমার অর্ডারের পরেরদিন  সকাল থেকে মৃণাল সিভিল ড্রেসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টহল দিতে থাকে। সকাল দশটা নাগাদ রূপ বেরোয় স্কুটার নিয়ে। তার পিছু নিয়ে জানা যায় তার কারখানার ঠিকানা। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি রূপ ওখানেই থাকে। তারপর সে যায় আরেক জায়গায়। আরেকটা অফিসে। মৃণাল পিছু নিয়ে যায় সেখানে। একটা টিনের চালের বাড়ি অফিসের নাম নেই, অফিস সুলভ চাকচিক্য বা কাঠামো নেই, মাত্র একটি ঘর। সন্দেহ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই তবু সন্দেহ প্রবল হলো। সারা সন্ধে ওই বাড়ির কাছাকাছি লুকিয়ে থেকেও রূপকে একবারের জন্যও বেরোতে দেখা গেল না। আশেপাশের লোকজনের থেকে জানতে পারল ওই বাড়িটি সম্বন্ধে তারা খুব বেশি কিছু জানেননা। শুধু রোজ একটি ছেলে এসে দরজা খুলে ঢুকে পড়ে, বেরোয় সেই রাত্রে। আর অন্য কাউকে যেতে বা আসতে দেখা যায়নি। রাত দশটা নাগাদ রূপ বেরিয়ে আবার স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মৃণাল সবটা জানিয়ে আমায় ফোন করলো। আমি পরেরদিনই পৌঁছই। জিমুতের মৃত্যুর সঙ্গে কোথায় যেন যোগসূত্র পাচ্ছিলাম। রাত দশটায় রূপ বেরোল, আমি সুন্দর সুযোগ পেলাম ঘরটা সার্চ করার। তালা খুলতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। রূপ সিকিউরিটির ব্যবস্থা বেশ ভালোই করেছিল। যাইহোক, ভেতরে ঢুকে শুধুই দেখলাম কাগজ আর কাগজ। আলমারি, টেবিল, বাক্স ভর্তি কাগজ। কিসের কাগজ? ঘেঁটে পেলাম সেই একটাই নাম। উই কেয়ার নার্সিংহোম। সেই একই ধরনের রিপোর্ট প্রত্যেকটি ফাইলে, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট , usg রিপোর্ট যেমনটা জিমুতের দেওয়া ব্যাগে ছিল। দেখে যতটুকু বুঝলাম অর্গান ট্রাফিকিংয়ের সমস্ত নথিপত্র এখানে লোকানো রয়েছে। বুঝলাম অপূর্ব আর রূপ একই সংস্থার হয়ে কাজ করতো, একজন কলকাতায় আর একজন এখানে। কিন্তু আমার কাছে কোন ব্যাগটা ছিল বুঝতে পারছিলাম না। ওখানে একই ধরনের অনেকগুলো ব্যাগ। সার্চ করতে করতে একটা নাম চোখে পড়ল, পলাশ নাথ। জিমুত আমায় যে ব্যাগটা দিয়েছিল তাতে এই নামের ব্যাক্তির রিপোর্ট ছিল, দেখেছিলাম। বুঝতে বাকি রইল না এই ব্যাগটাই আমায় দেওয়া ব্যাগ এবং আমার বাড়ি থেকে চুরি গেছিল। পরের দিন সকাল সকাল পৌঁছলাম রূপের বাড়ি। ওর মায়ের কাছে থেকে আরো কিছু কথা জানতে। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে দুই ছেলের কার্যকলাপ সম্পর্কে উনি কিছুই জানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপ ফিরে এলো। ওর চেহারা দেখে বুঝলাম ব্যাগটি যে নেই এবং পুলিশ যে অপূর্বর খোঁজে এতো দূর চলে এসেছে এই খবর ও পেয়েছে। ওর কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন লাগল। ও যেন কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর সম্পর্কে কোনো কথাই বলতে চাইছে না। অনুমান করলাম যে অপূর্বর সম্পর্কে কোনো কথা ও যদি বলে ফেলে তাহলে ও নিজেও ফেঁসে যাবে। মনে মনে ঠিক করলাম ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে, তাহলে যদি কোনো কথা বের করা যায়। সুযোগও এসে গেল। কিছুক্ষন পরেই ফোন আসে তপনের। সে জানায় নার্সিংহোম সম্পর্কে সব খবরাখবর এবং ওরা দুজন কর্মচারীকে গোপনে আটক করে আরো কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। আমি তৎক্ষণাৎ ওকে একটা মেসেজ করলাম মর্গে একটা বডি ঠিক করার জন্য। লাশ সনাক্তকরণের অছিলায় রূপকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। এরপরে যে প্রশ্নগুলি করবো তার উত্তর আশা করি বাকিদের থেকে পাবো। তাই তো রূপ, পরমা?” অতনু এবার থামল। রূপ, পরমা মাথা নিচু করে বসে আছে।

 রূপ ধীরে ধীরে মাথা তুলে একবার পরমার দিকে তাকালো। মেয়েটি তখন থরথর করে কাঁপছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে নার্ভ ঠিক রাখতে পারছে না। রূপ বলতে শুরু করে, “বাবার অসুস্থতার পর মা ভাইকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিলো আর আমায় লেখাপড়া বন্ধ করে ঢুকে পড়তে হলো কারখানায়। কষ্ট হয়েছিল কিন্তু ভাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মেনে নিলাম সব। কলকাতায় এসে ভাই কদিনের মধ্যে প্রচুর টাকা পাঠাতে শুরু করে মায়ের একাউন্টে। এদিকে আমার মাইনে ছয়-সাতের ওপর ওঠে না। ভীষণ হিংসা হলো, ভাই বরাবর বুদ্ধিতে, কাজে আমার থেকে এগিয়ে। আবার চিন্তাও হলো, কোথায় পাচ্ছে এতো টাকা? বারবার প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছে। হেসে বলেছে, “কলকাতায় টাকা ওড়ে রে দাদা।” চিন্তা আরো বেড়ে গেল যখন মামা ফোন করে বলে ভাইকে নিয়ে বাড়িতে খুব সমস্যা হচ্ছে। ও নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি আসি কলকাতায় সবকিছু জানতে। এসে জানতে পারি ভাই চেতলার কোনো একটা বাড়িতে ভাড়া রয়েছে। সেখানেও পৌঁছে যাই। কিন্তু ওকে বাড়িতে পাইনি। সারা দুপুর আর সন্ধ্যে ওই বাড়ির চাতালে কাটাই। রাত এগারোটার সময় ভাই ফেরে। আমাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে হকচকিয়ে যায়। আমি ওর বেশভুষা দেখে তো অবাক। এতো দামী জামা কাপড়, জুতো! ঘরে ঢুকে ওকে চেপে ধরলাম― বল বল কি করছিস তুই? কোথায় পাচ্ছিস এতো টাকা? প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে ধীরে ধীরে সব বলে। ও বলে যে একটা নার্সিংহোমে কিছু একটা কাজ ও করছে যার জন্য এত পরিমান টাকা অর্জন করছে। আমায় বলে এসব কারখানায় কি আছে দাদা? আমার সাথে আয় দেখবি কতো টাকা চারিদিকে ছড়িয়ে। পরের দিন আমাকেও মিস্টার লাহার কাছে নিয়ে যায় ও। মিস্টার লাহা আমায় নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন আগে কিছুদিন সার্ভিস দেখে পুরোপুরি আপয়েন্ট করবেন। বিশ্বাস করুন তখনও জানতাম না আসলে কি কাজে জড়িয়ে পড়ছি।” রূপ একটু দম নেওয়ার জন্য থামল। সামনে রাখা গ্লাস তুলে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করলো, “ধীরে ধীরে আমিও এই কাজে লেগে পড়ি। দারিদ্রের ঝড়ের পরে অর্থের বৃষ্টি লোভের জোয়ার এনে দেয়। এই সময় আমার পরিচয় হয় পরমার সাথে। ও ভাইয়ের বন্ধু ছিল। ভাই ওকে পছন্দ করতো। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম পরমার ভাইয়ের প্রতি সেই অনুভূতি নেই।” রূপ থামে। পরের কথাগুলো বলে পরমা, “অপূর্বর সাথে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না। ও নার্সিংহোমে কাজ করতে শুরু করার দুবছর পর একই কলেজে ভর্তি হই আমরা। ও নিজে থেকেই আমার কাছাকাছি থাকতো কিন্তু রূপের সাথে আলাপ হওয়ার পর আমি রূপকে পছন্দ করতে শুরু করলাম। রূপ ততোদিনে নার্সিংহোমে আর বাড়িতে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে অপূর্বর সাথে। অপূর্বই আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।” অতনু  জিজ্ঞেস করল, “তারপর?” রূপ ধীরে ধীরে তাকালো মিস্টার লাহার দিকে। তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। রূপের দিয়ে তাকিয়ে সে ফেটে পড়লো, “আমার দিকে কি তাকাচ্ছ স্কাউনড্রেল? আমি তোমায় বলেছিলাম অপূর্বকে খুন করতে?” তারপর অতনুর দিকে ফিরে বলল, “শুনুন অফিসার। আমি একটা নার্সিংহোম খুলে অর্গান ট্রাফিকিং করেছি, স্বীকার করছি কিন্তু এই দুটো খুনে আমার কোনো হাত নেই। অপূর্ব আমার কাছে কাজ চেয়েছিল। হি ওয়াস এ ব্রিলিয়ান্ট বয়। পড়াশুনা করলে এগোতে পারতো। কিন্তু সেই সময় আমার এমন একজন এজেন্টের দরকার ছিল যাকে দেখে কেউ সন্দেহ করবে না। একজন স্কুল বয়ের থেকে বেটার ইনোসেন্ট কে আর হতে পারে। আমি কাজ দিয়েছিলাম। ও শুধু ক্লায়েন্ট আনত আর যোগাযোগ করাতো ব্যাস। হি ওয়াস আ রেস্পন্সিবল গাই। বাট দিস ফেলো ইস আবসার্ড। ওকে শুধুই কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার কাজে রেখেছিলাম। লাস্ট টাইম ও ওর বাবাকে নিয়ে আসে হসপিটালে। এমন চামার ছেলে জীবনে দেখিনি। বাবার কিডনি ও নিজে ক্লায়েন্ট এনে বিক্রি করে। অপূর্ব এটা জানতো না। জানতে পেরে ক্ষেপে যায়। ওই কেসের সব কাগজ ও নিজের কাছে রেখে হুমকি দেয় যে ও এই চক্র সম্পর্কে সব পুলিশকে জানিয়ে দেবে। আমি বলেছিলাম তোমার ভাই তুমি কিভাবে ম্যানেজ করবে তোমার ব্যাপার। দুদিন পরে শুনি অপূর্বকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।”  পরমা রূপের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলতে থাকে, “অপূর্বকে বাবা মুম্বাই চলে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়েছিলাম। সেই মতো ও ব্যাগ পত্রও গুছিয়ে রেখেছিল। ওর যাওয়ার কদিন আগে ও ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দেয়। কোথায় যায় জানি না। ফোন করেও পাইনি। হঠাৎই একদিন ওকে এসপ্লানেড এর একটা হোটেল থেকে বেরোতে দেখে আমার কলেজের এক বন্ধু। অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু অপূর্ব শুনতে পায়নি। ভিড়ে মিলিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমি যাই ওখানে, রূপও যায় ওকে বোঝাতে। হোটেলে গিয়ে ওকে পাইনি। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিল। রেজিস্ট্রার চেক করে দেখলাম চেক আউট করেনি। তার মানে ফিরে আসবে। আমরা দুজন হোটেলের বাইরেই একটু আড়ালে অপেক্ষা করতে থাকি। রাত প্রায় বারোটা নাগাদ অপূর্বকে দেখা যায় হোটেলের গেটে। আমরা ওকে গেটের সামনেই ধরি। সেইসময় ও পুরোপুরি ড্রাঙ্ক। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। রূপকে আমার সাথে দেখে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। ওকে মুম্বাইয়ের টোপ দিয়ে কলকাতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা ও বুঝতে পেরেছিল তাই বলতে থাকে যদি কলকাতা ছাড়তেই হয় ও  সব কিছু পুলিশকে জানিয়ে তবে কলকাতা ছাড়বে। একটা ট্যাক্সি ডেকে আমরা তিনজন বাইপাসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হই। রূপ সেই সময় অপূর্বকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বারণ করে। কিন্তু অপূর্ব কিছুতেই মানতে চাইছিল না। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না যে ওর পঙ্গু বাবাকেও রূপ হার্ট সার্জারির নাম করে ওর লালসার শিকার বানিয়েছে।  দুজনের ঝগড়া শুরু হয়, ক্রমে তা  হাতাহাতিতে পরিণত হয়। রূপ একসময় সঙ্গে আনা দড়ি আর কাপড় দিয়ে  অপূর্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। ফোন করে অফিস থেকে গাড়ি ডাকা হয়। ওই গাড়িতে চাপিয়ে অপূর্বকে কলকাতার বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি এর বেশি আর কিছুই জানিনা স্যার। রূপ ওকে কোথায় রেখেছে তাও জানিনা। রূপের কথা মতো কেসটা ঢাকা দেওয়ার জন্য মিসিং ডায়েরি করি পরেরদিন।” অতনু এবার চোয়াল শক্ত করে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলো, “জিমুতকে কেন মারা হলো? কেই বা মারলো?” পরমা এবার খানিকটা জল খেল। কপালের ঘাম মুছল ওড়না দিয়ে। কিছুটা দম নিয়ে বলল, “সেদিন রাতে জিমুতকে আপনার পিছুপিছু যেতে দেখে সন্দেহ হয়। ওকে আমার স্কুটি নিয়ে ফলো করে আপনার বাড়ি পৌঁছই। জিমুতের হাতে একটা ব্যাগ দেখেই পুরোটা আন্দাজ করে ফেলি। রূপের সেদিন রাতের ট্রেনে কলকাতা আসার কথা। ওকে ফোন করে জানতে পারি কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই চলে আসতে বলি আপনার এলাকায়। কিন্তু আমরা ভেতরে কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু অপেক্ষা ছিল জিমুতের আপনার বাড়ি থেকে বেরোনোর। জিমুত বেরোতেই ওকে ফলো করে কিছুটা দূরে এসে রাস্তা আটকে দাঁড়াই। ও প্রথমে কিছুটা অবাক হয় আমাকে আর রূপকে একসাথে দেখে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ও কিছুই বটে চায়নি। বরং আপনাকে কল করে বসে। সেই সময় রূপ ওর ফোন কেড়ে নিয়ে ওকে ফেলে দেয় পাশের পুকুরে। জিমুত সাঁতার জানতো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও মারা যায়। ওর বডি তুলে বাইকে বসিয়ে আরো দু কিলোমিটার দূরে এক জলাভূমিতে ফেলে দিল আর বাইকের ব্রেকের তার কেটে দিল যাতে গোটা ব্যাপারটা একসিডেন্ট মনে হয়। সকালে যখন আপনি বাড়ি ছেড়ে বেরোন ঠিক তখনই ব্যালকনির গ্রিল বেয়ে ব্যাগটা নিয়ে ও পালিয়ে আসে।” অতনু মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করে। পিছনে ডুকরে কেঁদে ওঠে রূপ-অপূর্বর মা, যিনি এতক্ষন সব শুনছিলেন। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঘরে। রূপ মাকে এতক্ষন খেয়াল করেনি। মায়ের উপস্থিতি তাকে বিচলিত করে তোলে। সে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলে ওঠে, “আমায় এরেস্ট করুন অফিসার। আমার লোভ থেকে বাবাও বাঁচতে পারেনি। ওই যে পলাশ নাথ, আমার বাবা। আমি আমার বাবার কিডনি বিক্রি করেছি। আমায় শাস্তি দিন।” অতনু রূপের দুগালে দুটি সশব্দ চড় মেরে তার চুলের মুঠি ধরে প্রশ্ন করে, “অপূর্বকে কোথায় রেখেছিস বল?” রূপ ঢোঁক গিলে কোনোমতে বলে, “অপু নেই?” রূপের মা চিৎকার করে ওঠেন, “নেই মানে? কি করেছিস তুই?”  রূপ একটা পৈশাচিক হাসি হেসে বলে ওঠে, “কবর দিয়েছি। একটা নির্মীয়মান বাড়ির নিচে কবর দিয়ে এসেছি। ছোটবেলা থেকে আমার পথের কাঁটা হয়ে বসেছিল। পৃথিবীর সব ভালো কি একজনের জন্যই বরাদ্দ? আমার টাকা চাই। ওতো এথিক্স কপচে পেট চলে না মা। বাবার আর কদ্দিন বাকি ছিল বলতো? কেন বেকার আটকালো আমায়? ও যেন কতো সাধু পুরুষ!” রূপের কথা শেষ হওয়ার আগেই এলোপাথাড়ি কিল চড় মারতে শুরু করেন রূপের মা। তার চোখ ভরা জল। দুই ছেলের অমানুষিক আচরণে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওঁর হৃদয়। মহিলা পুলিশ দিয়ে ওঁকে বিরত করে রূপের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেন তপন। অতনু অর্ডার দেন, “এই সাইকো ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানুন বডিটা কোথায় পুঁতেছে। আর নার্সিংহোম ও তার যাবতীয় নথিপত্র সিজ করুন। এই একটা সূত্র ধরে আমরা আরো অনেক কালপ্রিটদের ধরতে পারবো। সো বি কেয়ারফুল তপন।” তপন রূপকে নিয়ে চলে যায়। একে একে পরমা ও বিশ্বজিৎ লাহাও হ্যান্ডকাফ পরে এগোতে থাকেন। অতনু মিস্টার লাহার সামনে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আপনার টিমটা বেশ ভালোই ছিল জানেন তো। কিন্তু সমস্যা বাধল দুটো পেয়াদাকে নিয়ে। ওদের একজনের বিবেক জেগে উঠেছিল আরেকজনের চিরতরে মরে গেছিল। এবার আপনি হাজতে বসে ভেবে দেখুন বাকি জীবনটা আপনার বিবেক আপনাকে কোন রাস্তায়  নিয়ে যেতে চায়। নিজের কপাল তো পোড়ালেন সাথে মেয়েটাকেও নিলেন।” বিশ্বজিৎ লাহা তির্যক হাসি হেসে বলল, “দেখা যাক কতদিন হাজতে বসতে পারি।” অতনু তার ইঙ্গিত বুঝেও পাত্তা দিল না, বলল, “কনস্টেবল ওদের নিয়ে যাও।”
  সবার চলে যাওয়ার পর অতনুর চোখ পড়ল ঘরের এক কোণে বসে থাকা রূপ-অপূর্বর মায়ের দিকে। একমাত্র ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে সে কিছু বিড়বিড় করে যাচ্ছে। অতনু তার কাছে গিয়ে বলল, “ম্যাডাম আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।” তিনি তার উদ্বেগহীন চোখ দুটি অতনুর দিকে মেলে ধরে বললেন, “একটা ইট কাঠের খাঁচা ওটা। ঠিক পৌঁছে যাবো। অন্তত এই খবর টুকু দিতে তো যেতেই হবে যে আমি দুটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলাম।” তিনি চলে গেলেন। অতনু তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। গ্রীষ্মের গনগনে রোদে তার ক্লান্ত অবয়ব মিশে গেলো অবলীলায়। এভাবেই নষ্ট হয়ে যায় কতো স্বপ্ন, কতো জীবন। এই মৃত্যু গুলির কেউ হিসেব রাখেনা।
সমাপ্ত।

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা #কেয়া_চ্যাটার্জি প্যারিস পর্ব • #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস...