ঘরকুণোর বিদেশ যাত্রা
কেয়া চ্যাটার্জি
প্যারিস পর্ব
পর্ব - প্যারিসিয়ান সংসার
আগেই বলেছি ফ্লাইট যখন ল্যান্ড করেছে তখন প্যারিসের ঘড়ি অনুযায়ী সময় সকাল আটটা। কিন্তু কাঁচ ঘেরা এয়ারপোর্টের ভিতর থেকেই দেখে বুঝতে পারছিলাম ফ্রান্স তখন সদ্য ফোটা ভোরের আলো মাখছে। প্রাচ্যে যে ঋতু শরৎ ও হেমন্ত, পাশ্চাত্যে সেই ঋতুই ‘autumn বা falls season’। শীত পড়ার আগের পূর্বাভাস। পাতা ঝরার মরশুম। এই সময় সকাল শুরু হয় দেরি করে। সন্ধ্যেও নেমে যায় সাড়ে ছটার মধ্যে। সেদিন ভোরের প্যারিস আমাদের মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালো।
বাইরে বেরিয়ে একটি মিনি ভ্যান বুক করে আমরা পাড়ি দিলাম মালাকফের উদ্দেশ্যে। যদিও মিনি ভ্যান বুক করা উদ্দেশ্য ছিল না আমাদের। লাগেজের তুলনায় একটু বেশি বড় গাড়ি হয়ে গেছিল। কিন্তু সেই সময় সাধারণ সিদান গাড়ি সেখানে না পাওয়ায় এবং দীর্ঘ ফ্লাইট জার্নির পরে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছে না করায় আমারা বাধ্য হয়েই গাড়িটি নিই। ফলে গাড়ি ভাড়াও সামান্য বেশি লাগে। বলে রাখি, দরদাম কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের দেশেই চলে তা নয়। আপনি চাইলে কি না সম্ভব? গাড়ী চলতে শুরু করার পরে চালক মালাকফ পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেয়ে বসল ৯৫ ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় নয় হাজারের কাছাকাছি। গাড়ি চলমান অবস্থাতেই আমরা সেটিকে টেনেটুনে ৮৫ ইউরোতে নামাতে পেরেছি। অবশ্যই অন্তত বিনয়ের সঙ্গেই দরদাম করতে হয়েছে। Attitude দেখিয়েছেন কি গেছেন! ছোট গাড়ি পেলে হয়তো ভাড়া নেমে আসত পঞ্চাশ বা ষাট ইওরোতে। প্রথমদিন, তাই, একটু লোকসান দিয়েই যাত্রা শুরু হল।
প্যারিস রাজধানী শহর হওয়ায় ভাষার অসুবিধা খুব একটা হয়নি। ফ্রান্সে সবাই ইংরাজি বলতে পারে না। না বলতে পারায় আমাদের মতো হিন্মন্য়তাতেও ভোগে না। তবে চেষ্টা করে বোঝার। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে যাত্রীকে বা নতুন পর্যটককে নিজের বক্তব্য বোঝানোর। তারপর যখন দুপক্ষই নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে অপারগ হয়ে পড়ে তখন ওরা সাহায্য নেয় ট্রান্সলেটারের। প্রসঙ্গত, যাহা আমাদের ম্যাক্সিমাম; তাহা উহাদের মিনিমাম। আমরা আইফোন কেনার জন্য কিডনি বেচার তাল করি, আর ওদিকে আমাদের হৃদয়ে ব্যথা দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার পকেট থেকে ফটাস করে আনল আইফোন (মডেল বৃত্তান্ত জানতে চাইবেন না প্লিজ।)। ফোনের একটি বিশেষ সফটওয়্যারে গিয়ে ফ্রেঞ্চ ভাষায় নানা রকম ফুস ফাস করে এগিয়ে দিল সামনে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইংরাজি বাক্য। এইভাবেই দরদাম সম্পন্ন হল। বাঙালির জয়! রাস্তার যানজট দেখে বুঝলাম শহরে সদ্য ভোর হলেও শহরের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। গাড়ীর সারিতে যোগ দিলাম আমরাও। চললাম মালাকফ।
মালাকফ,প্যারিস সিটি সেন্টার থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি টাউন। টাউন শুনে অনেকেই নাক কুঁচকে, হাসতে পারেন। তাই বলে রাখি, এটি ফ্রান্সের একটি ঐতিহাসিক এবং বৃহৎ শহর। তাছাড়া, The European Organisation for Civil Aviation Equipment এই মালাকফেই অবস্থিত। এখানেই বুক করা হয়েছে আমাদের আগামী তিনদিনের সংসার। প্রসঙ্গত, হোটেল নয় বুক করেছি এয়ারবিএনবি। এই এয়ারবিএনবি সম্পর্কে অনেকেই জানেন। আবার অনেকেই জানেন না। Airbnb হল একটি online marketplace যেখানে একটি প্রপার্টি ভাড়া দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, নির্দিষ্ট মুল্যের বিনিময়ে। Google playstore থেকে AirBnb app ডাউনলোড করে সাইন আপ করলেই নিজের পছন্দ মতো দেশে, বা নিজের দেশেও পছন্দসই লোকেশান ও মূল্যে এপার্টমেন্ট বুক করে নেওয়া যায়। হোটেলে রুমের ভাড়ার পাশাপাশি, খাওয়া দাওয়ার খরচটাও কিন্তু বিশাল অঙ্কের। বিদেশে এসে বিদেশী খাবার কতটা সহ্য হবে সেই ভেবেই এয়ারবিএনবি নিলাম। তাছাড়া, শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় তিনদিনের ভাড়াও পেয়ে গেলাম বেশ কমের মধ্যেই। তিনদিনের জন্য ২৮০ ইউরো। বড় একটি এপার্টমেন্টে– বাগান, রান্নাঘর, বেডরুম, লিভিং রুম, বাথরুম সহ পেয়ে গেলাম। শুধুমাত্র ঘর নয় সঙ্গে ছিল রান্না করার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মশলাপাতি, ডিশ ওয়াশার, রেফ্রিজেরেটার, ওয়াশিং মেশিন, টিভি, সোফা, দুটি বেড ইত্যাদি। (একটা সম্যক ধারণা পেতে হলে নিচের ইউটিউব লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন আমাদের এপার্টমেন্টের ভিডিওটি। লাইক, সাবস্ক্রাইব ইত্যাদি ইত্যাদি করতে বলছি না কিন্তু।) আমাদের হোস্টের নাম ছিল মার্ক। আমাদের জন্য বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিল তার সহকারি ‘মামাদো’। ইশারায়, অল্প ইংরাজি, কিছুটা স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ মিশিয়ে সে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল কীভাবে কম্বিনেশন লকের মাধ্যমে মেইন গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে হবে। তারপর দেখিয়ে দিল চাবির বাক্স। সেখানেও কম্বিনেশন লক করা। ঠিকঠাক নম্বর মেলাতে পারলেই ঘরের চাবি পাওয়া যাবে হাতে। একে একে সে দেখিয়ে দিল ওভেন, মাইক্রোওয়েভ, রুম হিটার চালানোর পদ্ধতি।
মামাদোকে বিদায় জানিয়ে আমরা লেগে পড়লাম কাজে। চাল, ডাল, নুন, ঘি, আলু ভাজা, রেডিমেড তরকারি, রেডিমেড বিরিয়ানি, ম্যাগি, পোহা, সুজি – অনেক রেডি টু ইট খাবারই নিয়ে গেছিলাম। ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে একটি উবের বুক করে চললাম বিশ্বের সবথেকে বড় মিউজিয়াম গ্র্যান্ড ল্যুভ দেখতে।
ক্রমশ…
youtube link:
https://youtu.be/r1r_IGu0CxU?si=krbOlsHw1-AUccY0

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thank you for your valueable comment.