রাস্কিন বন্ড ও কিছু কথা
কেয়া চ্যাটার্জী
বিমল, রিয়াজ, ব্রিয়ান এবং রাস্কিন হেঁটে যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। দিনটা রবিবার। বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনার ছুটি। কর্তৃপক্ষ কোনও খেলাধূলার আয়োজন না করলে ছাত্রদের এই একটি দিনেই তারা ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দেন। চলতে চলতে হঠাৎ একজন হোঁচট খেয়ে পড়ল মুখ থুবড়ে। ছেলেটি বিস্মিত হয়ে দেখল একটা প্রায় সদ্যজাত শিশুকে কাপড়ে মুড়ে কে যেন রাস্তায় রেখে দিয়ে চলে গেছে। তারা ঠিক করল এভাবে একটি বাচ্চাকে পথে ফেলে যাওয়া একদম ঠিক হবে না। অতএব তারা শিশুটিকে নিয়েই হাঁটা লাগাল স্কুলের দিকে। তারপর কী হল?
আচ্ছা একটা বই শেষ করার পর কখনও মন খারাপ হয়েছে? মনে হয়েছে, বেশ তো ছিলাম ওদের জগতে, কেন আবার ফিরে এলাম এই রুক্ষতায়? কখনও কান্না পেয়েছে খুব? রাস্কিন বন্ড এমনই একজন লেখক। এমন একজন যে তাঁর কলমের প্রথম আঁচরেই পাঠককে বইয়ের পাতার সাথে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বারবার ধরা পরে তাঁরই জীবন স্মৃতি, অভিজ্ঞতা। নিজেকে সকলের মাঝে রেখেই সকলের গল্প বলেছেন তিনি— মানুষের গল্প, ছোটদের গল্প। ছোটদের মনের খবর দিতেন তিনি পাতার পর পাতা জুড়ে।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে মে ভারতবর্ষের কাসৌলীতে জন্মগ্রহণ করে এডিথ ক্লার্ক এবং অবরে বন্ডের পুত্র রাস্কিন বন্ড। বাবার এয়ারফোর্সে চাকরি করার সুবাদে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে নানান জায়গায়। মা বাবার বিচ্ছেদ ও বাবার মৃত্যু তাঁর জীবনে ও তাঁর লেখনীতে বিশেষ ছাপ ফেলেছে। পিতামহির লালন পালন ও সিমলার বোর্ডিং স্কুলের জীবন তাঁকে গল্প লিখতে শিখিয়েছে। অন্য চোখে, অন্য ভাবে দেখতে শিখিয়েছে চেনা জানা জগৎটাকে। তাঁর জীবন, তাঁর অভিজ্ঞতা গল্প হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে বারবার। রাস্কিন বন্ডের লেখা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর ছোটবেলা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কারণ লেখক হওয়ার সমস্ত রসদ, গল্পের চরিত্ররা, গল্পের ভাবনা, ছোট ছোট মুহূর্ত সবই তাঁর শৈশবে লুকিয়ে আছে। বেড়ে উঠেছে ছোট্ট রাস্কিনের মধ্যে একটা বটবৃক্ষের সম্ভাবনা।
একটি নিঃসঙ্গ ও জটিল শৈশব পাওয়া সত্ত্বেও রাস্কিন তাঁর পাঠকদের উপহার দিয়েছেন এক একটি সদর্থক গল্প। যে জীবন তিনি চেয়েও পাননি, যা তাঁর প্রাপ্য হয়েও অধরা, তা-ই হয়তো উপহার দিতে চেয়েছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে। তাই তো তাঁর চরিত্ররা আমাদের বড় আপন। তারা যেন আমাদেরই কথা বলে, আমাদেরই মাঝে থাকে। তারা আমাদের থেকে দূরের কেউ নয়। আমাদেরই চারপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষ, নিত্য নৈমিত্তিক ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহকে অন্য আঙ্গিক ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখার এক একটি নতুন চশমা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যান গল্পের ফেরিওয়ালা। আমরা অবাক হই। জীবন এত সুন্দর!
তাঁর লেখনীর জীবন লুকিয়ে তাঁর ভাষায়। সাবলীল বাচন ভঙ্গী, শব্দ নির্বাচন, দৃশ্য বর্ণনা, ঘটনা প্রবাহের সজ্জা, চরিত্র চিত্রণ, সহজ সংলাপ এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের সুন্দর বর্ণনা তাঁর লেখনীকে অন্য মাত্রা এনে দেয়। যা কিছু সহজ, যা কিছু সুন্দর শিশু মনকে তা-ই আকৃষ্ট করে। রাস্কিন বন্ড তাই শিশুদের প্রাণের লেখক। আসলে তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি আজও নতুন নতুন বন্ধু বানায়। শিশুরা নিজেদের খুঁজে পায় বইয়ের পাতায়। একটা স্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প, দাদু- ঠাকুমা বা একটা অংকে ভয় পাওয়া ছেলের গল্প — এরা তো অন্য কোনও জগতের বা অন্য কোনও সমাজের মানুষ না। এরা তো আমাদেরই লোক। তারা তো আমরাই। নিজেদের জীবনের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে?
একটা সাধারণ ঘটনা, তা কিভাবে যেন অসাধারণ হয়ে ওঠে বন্ডের জাদু কলমে। Getting Granny's Glasses একটি ছোট ছেলে মনির তার ঠাকুমাকে মুসৌরিতে চোখের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার গল্প। এই ছোট্ট অভিযানে রাস্কিন বন্ড কি অদ্ভুত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন পথের, ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির, কুয়াশা, রাস্তায় নামতে থাকা ধস ও রাতের মুসৌরি শহরের। পরিশেষে যখন ঠাকুমা তার নতুন চশমা দিয়ে বহুদিনের অস্পষ্ট পৃথিবীকে ফের পরিষ্কারভাবে দেখতে শুরু করলেন তখন তার আনন্দের বর্ণনা, তার উল্লাস পাঠক যেন সচক্ষে দেখতে পায়। মুসৌরি যাওয়ার পথে ঠাকুমা এগারো বছরের মনির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এদিকে ফেরার পথে মনি ঠাকুমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। একই গল্পে দু'জন মনি। একজন অত্যন্ত দায়িত্ববান, আরেকজন নিশ্চিন্ত কিশোর। রাস্কিন বন্ডের এই সরলতায় বাঁধা পরে পাঠকের হৃদয়।
কথায় আছে, যে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারে সে পৃথিবীর সব কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায়। রাস্কিন বন্ড এমনই একজন মানুষ। Roads to Mussoorie গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "Instead of a Forward I'm writing a Backward, because that's the kind of person I've always been...Very backward." এমন অকপটভাবে নিজের ব্যাপারে কে-ই বা বলতে পারে। যেমন অকপট ভাবে তিনি নিজের শৈশবের ব্যাপারে লিখেছেন তাঁর নব্য গ্রন্থে। বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ তাঁকে ততটা নাড়িয়ে দেয়নি যতটা টলিয়ে দিয়েছে বাবার মৃত্যু। মাত্র দুবছর বাবার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিনি। মায়ের ভূমিকা পালন করা বাবা রাস্কিনের জীবনের অর্ধেকটা জুড়ে। আজও একাকী সময়ে তিনি অনুভব করেন বাবার উপস্থিতি। তাঁর আশ্রয়ের ছায়া। বুজে আসা কণ্ঠে তিনি সাক্ষাৎকারীকে বলেন, যে বাচ্চারা ছোট থেকেই একা থাকতে শিখে যায়, যাদের পারিবারিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়, যারা বিচ্ছেদ দেখেছে তারা ভীষণ সংবেদনশীল হয়। এই সমস্যা আর সংবেদনশীলতা তাদের লিখতে অনুপ্রাণিত করে। যেমন তিনি নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আসলে তাঁর গল্প, উপন্যাসে তিনি নিজের কথাই লিখে গেছেন নিরন্তর। সতের বছর বয়সে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস The Room on the Road, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে পেল Llewellyn Rhys Memorial Prize. উপন্যাসটি রচিত হয় একটি কিশোরকে ঘিরে যে তার কঠোর অভিভাবকদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে তার বন্ধুদের সাথে পালিয়ে যায় নিরুদ্দেশের পথে। আচ্ছা, আমাদের কি কখনও মনে হয় না এই কঠিন পৃথিবীর বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে? কৈশোরে কি কখনও মনে উঁকি দেয়নি নিজের একটা জগৎ গড়ার ইচ্ছা? বন্ডের গল্পে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। সুপ্ত ইচ্ছেগুলো এক ম্যাজিক ফুঁয়ে সত্যি হয়ে যায়। পাঠকের মনে তাই চিরন্তন, চির নবীন রাস্কিন বন্ড।
The Blue Umbrella উপন্যাসে একটি নীল রঙের ছাতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সমগ্র প্লটটি।
আঙ্কেল কেন, আন্ট রুবি, বিবিজি, সমি, রঞ্জি, দলজিৎ, রাস্টি— রাস্কিন বন্ডের চরিত্ররা চির অমর পাঠকের হৃদয়ে। তাঁর মননে যেমন ছায়া ফেলেছে জীবন ও অভিজ্ঞতা তেমনই প্রভাব রেখেছেন চার্লস ডিকেন্স, শার্লট ব্রন্টে, রুডইয়ার্ড কিপ্লিংয়ের মতো বরেন্য সাহিত্যিকরা। তাঁর প্রতি গল্পে উঠে আসে মুসৌরির পরিবেশ ও প্রকৃতি, তার ছাত্র জীবন, পিতামহির সাহচর্য ও বন্ধুদের কথা, কৈশোরের স্বপ্ন, যৌবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর সারা জীবন ধরে আহরিত জীবন বোধ তিনি বিলিয়ে দেন তার পাঠক কূলের মাঝে। আমাদের বয়স বাড়লেও আমাদের মন আটকে থাকে কৌশোরে। এক স্বপ্নালু কিশোরের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সুদূরে।
.jpeg)