রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২০

বিয়ে বাড়ির গপ্পো


বিয়ের মরসুম চলছে। তাই স্মৃতি হাতড়ে কিছু বিয়ের গল্প বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আসলে গল্প তো না, স্মৃতি রোমন্থন।

বাড়ির সব থেকে ছোট হওয়ার সুবাদে আমি আমার ছোটবেলায় তিন দিদির বিয়ে দেখেছি। নব্বই দশকে পাড়ায় কোনো বাড়িতে বিয়ে লাগলে সেই অনুষ্ঠান শুধু সেই বাড়িতেই আটকে থাকত না, গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তো। বাড়ির সামনে ডেকোরেটর এনে প্যান্ডেল টাঙানো হতো। এখনকার মতো বাহারি ফুল, কাপড় সাজানো প্যান্ডেল না, লাল-হলুদ-সাদা কম্বিনেশনের কাপড়। গেটে বসতো একটি বৃহৎ প্রজাপতি, পাত্র-পাত্রীর নাম লেখা থাকত বাংলায়। সকাল থেকে সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙতো। সূর্য ওঠার আগে মা-জেঠিমা আর পাড়ার অন্যান্য কাকিমারা যেতেন জল সইতে। গঙ্গা দেবীকে নিমন্ত্রন করে আসতেন। তারপর হতো খই দই খাওয়ার পর্ব। সে সব পর্ব যদিও আমি দেখিনি। ঘুম থেকেই উঠতাম না। সকালের নানা পর্ব তো বড়দের ব্যাপার। সেসব আমাদের পোষাত না। বিয়ে  মানেই তো খাওয়া-দাওয়া তাই আমরা নজর রাখতাম হেঁসেলের দিকে। সকালবেলা লুচি আর সাদা আলুর তরকারি দিয়ে সারা হতো প্রাতঃরাশ। আহা! সে কি স্বাদ সেই আলু চচ্চড়ির। দুপুর হতেই গন্ধ আসত মাছের কালিয়ার। ততক্ষণে পাড়ার দাদারা আর দাদাদের বন্ধুরা কোমরে গামছা বেঁধে শুরু করে দিত পরিবেশনের আয়োজন। কাঠের লম্বা টেবিল তার সামনে সারি দিয়ে বসানো হতো কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। সেই চেয়ারে বসা একটু বিপদজনক ছিল বটে। বেশ কয়েকবার কব্জায় হাত রেখে আঙুলে চাপা খেয়েছি। তা সে যাইহোক, ছোট হওয়ার একটা সুবিধা ছিল, কোনো কাজ দেওয়া হতো না। উল্টে তাড়াতাড়ি খেতে বসিয়ে দেওয়া হতো। শালপাতার থালা আর মাটির গ্লাস। সেই গ্লাসে জল ঢাললে একটা অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ পেতাম। নুন লেবুর পর এল গরম ভাত আর ঘি , তারপর বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, ঝুরি ঝুরি আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ঝাল ঝাল শুকনো আলুপোস্ত, সেই পোস্ত গা বেয়ে গড়িয়ে পরতো লালচে হলুদ সর্ষে তেল আর শেষে মাছের কালিয়া, টমেটোর চাটনি।
 এরই মাঝে মন খারাপের সুর বাজত ভিতর ঘরে। দিদিকে সাজাতে আসত কোনো এক বিউটিশিয়ান বান্ধবী বা তার পার্লারের কর্মী। সাজার আগে একপ্রস্থ কান্নাকাটি মাস্ট। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। জেঠু বাবা ভীষণ গম্ভীর হয়ে কাজে ব্যস্ত, যতই হোক, মর্দ কো দর্দ মানায় না। আমি বরাবরই ভ্যাবলা গোবিন্দ টাইপ। দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখতাম সবার কান্না। ছোড়দির বিয়ের সময়, আমার থেকে তিন বছরের ছোট বোনপো এসে বলল, ও মাম্পি মাসি তুমি কাঁদবে না? (যেন না কাঁদলে ঠাকুর পাপ দেবে) আমি বললাম, কাঁদবো কেন? সে বলল, পুচি মাসি তো কাল থেকে আর আসবে না।
 কথাটা তখন মাথায় ঢোকেনি। বাচ্চা ছেলের কথায় পাত্তাও দিইনি। তখন মনে মনে জল্পনা রাতে কি হবে। এর মাঝে নিমপাতার মতো একটা দুপুরের অপরিহার্য ঘুমের ব্যবস্থা করা হতো। ফলে দূরদূরান্ত থেকে যত কাছাকাছি বয়সের দিদি ভাই বোনপো বোনঝি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হতো।
  সন্ধ্যে বেলা একবার ঢুঁ মারতাম দিদির ঘরে। সেই দুপুর থেকে সাজতে বসেছে। সন্ধ্যে বেলাও ফাইনাল টাচ বাকি। মাথা চুলকে ভাবতাম, দেখতে তো ভালোই এত সাজের কি আছে বাপু। ঘরের পিছনে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লুচি ভাজা। তখন এত শত স্টার্টার মকটেল ছিল না। বরযাত্রীর হাতে দেওয়া হতো লুচি,তরকারি আর মিষ্টির প্যাকেট। অন্যান্য অতিথিরা খেতেন চা বা শরবত। এই শরবত ব্যাপারটা বেশ লোভনীয় ছিল। একটা বিশাল এলুমিনিয়ামের ড্রামে লিটার লিটার জলে ঢালা হতো প্যাকেট প্যাকেট রসনা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই যে i love you Rasa, সেই রসনা। দেখে তো চোখ চকচক, জিভ লকলক। বাবার মামাতো ভাই একটা জগ হাতে সেই রসনা ঘুটছেন আর গ্লাসে ঢেলে অতিথিদের জন্য রেডি করছেন। পাড়ার দাদারা সার্ভ করছে। জনা পাঁচেক বাচ্চাপার্টি দু তিনবার ঘুর ঘুর করে সুযোগ বুঝে ঝুলে পড়লাম, ও ভোলা কা রসনা দাও না গো। সে চোখ পাকিয়ে বলে দিল, বরযাত্রী না এলে কিচ্ছু পাবি না। যে খেল গিয়ে।
  কি ভীষণ অপমান! সবার মুখ ভার। মনে মনে ভাবলাম, কবে যে দাদাগুলো বিয়ে করবে আর আমরা বরযাত্রী হয়ে একটু খাতির পাবো। বর বা জামাইবাবু আসার সময়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। সবাই ছুটে যায় বর এসেছে এসেছে। তাদের বর দেখার আগ্রহে এই ছোট্ট শরীর গলিয়ে কোনোদিনও জামাই বরণ দেখতে পেলাম না। বরযাত্রীর হাতে হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভার পড়ে গেলে তো ব্যস্ততার শেষ নেই। দিদির বিয়েতে আমরাও কিছু কাজ করেছি। যা হোক তেড়ে খেলার ফলে ক্ষিদে পেয়ে যেত জবর। ফার্স্ট ব্যাচে দূরের অতিথিদের একাধিপত্ব। তারা খেয়েই বেরিয়ে যাবেন। ততক্ষণে বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। দাউদাউ আগুনের সামনে দুই পাঁঠ...থুড়ি পাত্র পাত্রী হাফ সিরিয়াস হয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ছে। আমরা কজন ফাঁক ফোকর গলে পাশে দাঁড়িয়ে পরতাম, ছবি উঠবে যে। একবার ফ্লাস হয়ে গেলে কি আর বাদ দিতে পারবে? হিঃহিঃহিঃ।
 এবার রাতের খাওয়ার পালা। লুচি, ছোলার ডাল, বাঁকা বাঁকা ফিস ফ্রাই, ভাত, মুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, ধোঁকার ডালনা, মাছ, খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি, দই, পান। শালপাতাটা অনুগ্রহ করে চেবাবেন না। এখানেও কিন্তু একটা হালকা পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টভাবে চোখে পড়তো। যে দিদি বা পিসি একটু বেশি সুন্দরী, সে না খেতে পারলেও তার পাতেই খাবার গুলো বেশি বেশি করে পড়ত।কেন যে দাদারা তাদের সামনেই বেশি ঘুরঘুর করতো কে জানে বাবা! তারপর? তারপর আর কি, চোখ ঢুলু ঢুলু। সিঁদুর দান শেষ হতে ঘুম। বাসর ব্যাপারটা কি কোনোদিনও বুঝিনি। এই বাসরে নাকি ভালো ভালো গান হয়, দুস্টু মুসটু ইয়ার্কি হয়। হলে হয়, ঘুমের থেকে ভালো কিছু হয় নাকি! আমার বিয়ের বাসর রাত জেগেছিল আমার বোনপো, বোনঝি আর সবেধন নীলমনি একমাত্র বৌদি। ফলে সেই যে একটা মিথিকাল বিবাহ বাসর আমার দেখা হয়নি এখনও।
  যাকগে, বিয়ে শেষ। বিয়ের গল্পও শেষ। বৌভাত তো অন্যরকম। যে দিদি আগের দিন কেঁদে ভাসায় সেই পরের দিন বাপের বাড়ির সকলকে অভ্যর্থনা করে। কি অদ্ভুত না? সব ভালোর শেষে যখন স্কুল থেকে ফিরে জেঠুর বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়াতাম ঘরটা খাঁ খাঁ করতো। জমজমাট বাড়িটা নিমেষে ফাঁকা। বুম্বার কথাটা কানে এসে লাগত, দিদিকে তো রোজ রোজ আর দেখতে পাবো না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your valueable comment.

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা #কেয়া_চ্যাটার্জি প্যারিস পর্ব • #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস...