মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২০

বেলুন


বেলুন
কেয়া_চ্যাটার্জী
দার্জিলিং শহরটা বেশ অদ্ভুত। একদিকে কোলাহল আর একদিকে পাথরের নীরবতা। ঝিলম এই নীরব দিকটাতেই বসে আছে। রেলিঙের ওপারে সুগভীর খাদ। একটু এগোলেই ম্যালের জনবহুল রাস্তা। এখানে পরপর অনেকগুলি হোটেল ও রিসর্ট। তারই মাঝে মাঝে কয়েকটা চওড়া জায়গায় ছাউনি দিয়ে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দুটি নেপালী ভদ্রমহিলা বড় বড় ফ্লাস্কে চা আর কিছু কৌটোয় রকমারি বিস্কুট বিক্রি করছেন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন আঞ্চলিক ভাষায়।
  ঝিলমের ফোনটা বেজে উঠল। আকাশের নম্বর। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে এক কাপ চা নিয়ে ফের চুপচাপ বসলো বেঞ্চে। সূর্য আজকের মতো গোলাপি লাল আভা ছড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রিয়তমা পৃথিবীকে। এই প্রেম পর্বই ভালো। ভালোবাসা থাকে। যেমন ভালোবাসা ছিল আকাশ আর ঝিলমের। পাঁচবছর আগে অবধি।
  একই অফিসে কাজ করার সুবাদে ওদের আলাপ, বন্ধুত্ব, তারপর তা গড়িয়ে বিশেষ এক সম্পর্ক। যেদিন আকাশ অফিসিয়ালি প্রপোস করেছিল সেদিনই ওদের বাড়ি গিয়ে ডেট ফাইনাল করে এসেছিল পাঁজি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। ঝিলমের মা বাবা বেশ হতবাক হয়েছিলেন। পাত্র নিজেই এসে বিয়ের কথা বলছে! দুসপ্তাহ পরে আসেন আকাশের মা বাবা জলপাইগুড়ি থেকে। ছেলের পাগলামী সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত তাঁরা। হেসে বলেছিলেন, “মিয়াঁ বিবি রাজি তো আমরা চার কাজী আর নাক গলিয়ে কি করবো বলুন তো?”
  বিয়ের তিনমাস পর তারা হানিমুন সারতে আসে দার্জিলিং। কিন্তু পাঁচবছর আগের নিখাদ বন্ধুত্বে কেমন একটা ভাঁটা পরে গেছে ইতিমধ্যে। আকাশের অতিরিক্ত প্রাণচ্ছলতা অসহ্য লাগতে শুরু করে ঝিলমের। কথায় কথায় হেসে ওঠা, ভুলে যাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া সব সব অসহ্য ঝিলমের কাছে। আজকেও আকাশের মাথায় বাই চাপলো ঘোড়ায় চড়বে। ঝিলম সাফ না জানিয়ে দিলো, কিন্তু আকাশ টুক করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলল, তুমি ওই বইয়ের দোকানে থাকো, আমি একটু ঘুরে আসি। লেট করবো না প্রমিস। তারপর একঘন্টা কেটে গেলেও আকাশের পাত্তা নেই। ফোন করলেও তুলছে না। মাথা গরম হয়ে উঠল ঝিলমের। ম্যাল ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুল এই জায়গাটায়। আকাশ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। তোলেনি। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছেলেটাকে।
হঠাৎ একটা গান কানে আসতেই ঝিলম এদিক ওদিক ফিরে দেখল সামনের বেঞ্চে একটি লোক পাহাড়ের দিকে মুখ করে আপন মনে গেয়ে চলেছেন, “আঁখি পানে চেয়ে বলে না..না..না..সে যে মানে না মানা।” কলকাতার বাইরে বাঙালি দেখলে, তার সাথে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে। তার গান শেষ হতে ঝিলম বলে উঠল, কলকাতা? লোকটি পিছন ফিরে চাইল। না লোকটি বাঙালি না বরং গোর্খা। সে হেসে বলল, “না দার্জিলিং।” ঝিলম অবাক হয়ে বলল, “আপনি এতো স্পষ্ট বাংলা বলেন কি করে?” লোকটি আবার একগাল হেসে বলল, “আমার বউ শিখিয়েছে। বউ কিন্তু কলকাতায় থাকত।” ঝিলম বলল, “বিয়ের পর  তাহলে এখানেই থাকে?” লোকটির মুখ একটু ম্লান হলো। বলল, “হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এখানেই থাকে। বরাবরের মতো।” ঝিলম এতক্ষনে দেখল লোকটির হাতে একগোছা লাল নীল বেলুন। পাহাড়ি হাওয়ার দাপটে ভীষণ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ঝিলম হেসে বলল, “কটি ছেলে মেয়ে আপনাদের?” লোকটি এবার বেলুনগুলো দিকে চেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো হেসে উঠে বলল, এ তো আমার বড় বাচ্চার জন্য। আমার বৌএর জন্য। অনেকদিন দেখা হয়নি তো। রাগ করেছে। এই বেলুনগুলো দেখলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে, আমি জানি।” একটু থেমে আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “আমিও খুব রাগ করতাম। বৌটা একদম সংসারী ছিল না। ভীষণ ছেলে মানুষ। রাঁধতে পারত না, দরকারি কথা ভুলে যেত, কাজের সময় বসে ছবি আঁকত। একদম অগোছালো। ভীষণ রাগ করতাম। বকতাম। ও কাঁদতো। ভাবতাম কাঁদুক, ভুল বুঝে শুধরে যাবে। কিন্তু...”
― কিন্তু?
ঝিলমের প্রশ্নে লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়াল। “আমি যাই ম্যাডাম। দেরী হয়ে গেল। দেরী হলে আবার রাগ বেড়ে যাবে। বেলুনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে ।” এই বলে একগাল হেসে  ঢাল বেয়ে নেমে যেতে লাগল নীচে। ঝিলমের ভীষণ কৌতূহল হলো। সেও লোকটির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। রাজভবন পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে লোকটি একটি ছোট গেট খুলে ঢুকে গেল একটি জঙ্গল ঘেরা স্থানে। ঝিলমও তার পিছু পিছু ঢুকে বুঝতে পারল এটি কবরস্থান। দূরে কিছুটা গাছ গাছালি ঘেরা জায়গায় লোকটি বসে আছে। সামনের একটি বেদীতে বাঁধা সেই লাল নীল বেলুন গুলি। লোকটি আপন মনে গল্প করছে তার স্ত্রীর সাথে। তার চিরকালের অভিমানী প্রেমিকা।
চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। ঝিলম ছিটকে বেরিয়ে এলো ওখানে থেকে। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে গতি বাড়িয়ে দৌড়োতে লাগল। আকাশ কোথায়? তার অগোছালো খামখেয়ালি আকাশ? ওদের হোটেল পেরিয়ে আরো কিছুটা যেতেই পিছন থেকে হাতে টান পড়তে ফিরে দেখল অবাক দৃষ্টিতে আকাশ দাঁড়িয়ে তার সামনে। ঝিলমের চোখে জল দেখে বলল, “ঘোড়াটাকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল জানতো। অবলা প্রাণী কষ্ট পাচ্ছিল। হাসপাতালে গেছিলাম। আমারও একটু হাত পা ছড়ে গেছে।তোমায় কতো বার ফোন করলাম, তুমি কিছুতেই রিসিভ করলে না। আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল জানো?” ঝিলম আঁকড়ে ধরল ওকে। আকাশ জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদছো কেন? ঝিলম অস্ফুটে বলল, কিছু না।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২০

ম্যাজিক

ম্যাজিক
কেয়া চ্যাটার্জী

গিলি গিলি ছূ, আবরা কা ডাবরা....
হাততালিতে ফেটে পড়ল প্যান্ডেল। ছোট ছোট চোখগুলিতে বিস্ময় ঝরে পড়ল। স্টেজে জাদুকর রঙিন পোশাক পরে একের পর এক জাদু দেখিয়ে চলেছে। কখনো ফুল ঝরে পড়ছে, কখনো বা উড়ে যাচ্ছে পায়রা, কখনো কার পকেট থেকে উঁকি মারছে ইঁদুর।
  শো এর শেষে টাকা হাতে পেতে বেশ দেরি হলো সনাতনের। পুজো কর্তারা আরো কিছুক্ষন খেলা দেখাতে বলেছিলেন। কিন্তু সনাতনের সরঞ্জাম যে আর নেই। তাই শাস্তিস্বরূপ....। সঙ্গের ছেলেটির হাতে হাজার টাকা ধরাতেই তার মুখে ফুটে উঠল সব পেয়েছির হাসি। হয়তো ছেলেটির জীবনের প্রথম কামাই। এইসব দৃশ্য মনকে খুব খুশি করে দেয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে খুশিটা কেমন ম্লান হয়ে যায়। বৌমা ছোট নাতিটার পিঠে গরম খুন্তি চেপে ধরে চিৎকার করছে, “খাবি, খাবি? আমায় খা রে শয়তান, আমায় খা।” দূরে বসে আছে ছেলে। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে স্ত্রীয়ের দিকে। সনাতন দ্রুত ছাড়িয়ে নিল বাচ্চাটাকে, “কি করছো কি বৌমা! ছেলেটাকে এই পুজোর দিনে মারবে নাকি?” সরমা ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, “তাই করলে বাঁচবো বাবা। এমন অপগন্ড সোয়ামীর ঘর করার থেকে তো বাঁচবো।” সনাতন তাকালো প্রকাশের দিকে। সে শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বলল, “আজও দিল না।” সনাতন বলল, “দিল না মানে? তুই তো সাতদিন আগে কাজ করেছিস। আজও টাকা দিল না?”
― না। ওই অন্নপ্রাশন বাড়িতে মিকি মাউসের জামা মাথা পরে ঘুরতে বলেছিল। ওতো বড় মাথাটা কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিলাম না। একবার টাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে একজনের গায়ে পরে যাই। একটা প্লেট আর গ্লাস ভাঙে। ওই টাকা কেটে সাতশ টাকা দেবে বলেছিল। কিন্তু আজও দিল না।”
সনাতন ছেলের হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে বলল, “যা ছেলেটার জন্য খাবার নিয়ে আয়।” ছেলে চলে গেলে মনে মনে ঠিক করে নেয় বাকি দেড় হাজারে কি কি হিসেব মেটানো বাকি। নাতিটা মাটিতে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ঠিক তার ওপরে দেওয়ালে ঝুলছে স্ত্রী মিনতির মালা পড়া ছবি। সনাতন বাক্স থেকে বের করে জাদুকরের পাগড়ি আর পোশাক। নাতির সামনে হঠাৎ বলে ওঠে, “এই দেখো দেখো, জাদু দেখো। ম্যাজিক, ম্যাজিক, ম্যাজিক। আমি পি.সি.সরকারের চেলা। অন্ধকারে সূর্য দেখাই, দিনের বেলা তারা, মরুভূমিতে ফুল ফোটাবে এই সরকার বাবুর চেলা।” প্লাস্টিকের ফুল ঝরে পড়ল ছোট্ট শরীর জুড়ে। হাসি ফুটে উঠল খিলখিলিয়ে। ক্ষিদের ব্যথা ভুলে সে মেতে উঠল দাদুর জাদুর খেলায়। সরমা নিভৃতে চোখ মুছে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ম্যাজিশিয়ানের দিকে। এই বুড়ো মানুষটার পোড়া জীবনে একটা ম্যাজিক ভীষণ দরকার।

রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২০

বিয়ে বাড়ির গপ্পো


বিয়ের মরসুম চলছে। তাই স্মৃতি হাতড়ে কিছু বিয়ের গল্প বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আসলে গল্প তো না, স্মৃতি রোমন্থন।

বাড়ির সব থেকে ছোট হওয়ার সুবাদে আমি আমার ছোটবেলায় তিন দিদির বিয়ে দেখেছি। নব্বই দশকে পাড়ায় কোনো বাড়িতে বিয়ে লাগলে সেই অনুষ্ঠান শুধু সেই বাড়িতেই আটকে থাকত না, গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তো। বাড়ির সামনে ডেকোরেটর এনে প্যান্ডেল টাঙানো হতো। এখনকার মতো বাহারি ফুল, কাপড় সাজানো প্যান্ডেল না, লাল-হলুদ-সাদা কম্বিনেশনের কাপড়। গেটে বসতো একটি বৃহৎ প্রজাপতি, পাত্র-পাত্রীর নাম লেখা থাকত বাংলায়। সকাল থেকে সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙতো। সূর্য ওঠার আগে মা-জেঠিমা আর পাড়ার অন্যান্য কাকিমারা যেতেন জল সইতে। গঙ্গা দেবীকে নিমন্ত্রন করে আসতেন। তারপর হতো খই দই খাওয়ার পর্ব। সে সব পর্ব যদিও আমি দেখিনি। ঘুম থেকেই উঠতাম না। সকালের নানা পর্ব তো বড়দের ব্যাপার। সেসব আমাদের পোষাত না। বিয়ে  মানেই তো খাওয়া-দাওয়া তাই আমরা নজর রাখতাম হেঁসেলের দিকে। সকালবেলা লুচি আর সাদা আলুর তরকারি দিয়ে সারা হতো প্রাতঃরাশ। আহা! সে কি স্বাদ সেই আলু চচ্চড়ির। দুপুর হতেই গন্ধ আসত মাছের কালিয়ার। ততক্ষণে পাড়ার দাদারা আর দাদাদের বন্ধুরা কোমরে গামছা বেঁধে শুরু করে দিত পরিবেশনের আয়োজন। কাঠের লম্বা টেবিল তার সামনে সারি দিয়ে বসানো হতো কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। সেই চেয়ারে বসা একটু বিপদজনক ছিল বটে। বেশ কয়েকবার কব্জায় হাত রেখে আঙুলে চাপা খেয়েছি। তা সে যাইহোক, ছোট হওয়ার একটা সুবিধা ছিল, কোনো কাজ দেওয়া হতো না। উল্টে তাড়াতাড়ি খেতে বসিয়ে দেওয়া হতো। শালপাতার থালা আর মাটির গ্লাস। সেই গ্লাসে জল ঢাললে একটা অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ পেতাম। নুন লেবুর পর এল গরম ভাত আর ঘি , তারপর বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, ঝুরি ঝুরি আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ঝাল ঝাল শুকনো আলুপোস্ত, সেই পোস্ত গা বেয়ে গড়িয়ে পরতো লালচে হলুদ সর্ষে তেল আর শেষে মাছের কালিয়া, টমেটোর চাটনি।
 এরই মাঝে মন খারাপের সুর বাজত ভিতর ঘরে। দিদিকে সাজাতে আসত কোনো এক বিউটিশিয়ান বান্ধবী বা তার পার্লারের কর্মী। সাজার আগে একপ্রস্থ কান্নাকাটি মাস্ট। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। জেঠু বাবা ভীষণ গম্ভীর হয়ে কাজে ব্যস্ত, যতই হোক, মর্দ কো দর্দ মানায় না। আমি বরাবরই ভ্যাবলা গোবিন্দ টাইপ। দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখতাম সবার কান্না। ছোড়দির বিয়ের সময়, আমার থেকে তিন বছরের ছোট বোনপো এসে বলল, ও মাম্পি মাসি তুমি কাঁদবে না? (যেন না কাঁদলে ঠাকুর পাপ দেবে) আমি বললাম, কাঁদবো কেন? সে বলল, পুচি মাসি তো কাল থেকে আর আসবে না।
 কথাটা তখন মাথায় ঢোকেনি। বাচ্চা ছেলের কথায় পাত্তাও দিইনি। তখন মনে মনে জল্পনা রাতে কি হবে। এর মাঝে নিমপাতার মতো একটা দুপুরের অপরিহার্য ঘুমের ব্যবস্থা করা হতো। ফলে দূরদূরান্ত থেকে যত কাছাকাছি বয়সের দিদি ভাই বোনপো বোনঝি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হতো।
  সন্ধ্যে বেলা একবার ঢুঁ মারতাম দিদির ঘরে। সেই দুপুর থেকে সাজতে বসেছে। সন্ধ্যে বেলাও ফাইনাল টাচ বাকি। মাথা চুলকে ভাবতাম, দেখতে তো ভালোই এত সাজের কি আছে বাপু। ঘরের পিছনে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লুচি ভাজা। তখন এত শত স্টার্টার মকটেল ছিল না। বরযাত্রীর হাতে দেওয়া হতো লুচি,তরকারি আর মিষ্টির প্যাকেট। অন্যান্য অতিথিরা খেতেন চা বা শরবত। এই শরবত ব্যাপারটা বেশ লোভনীয় ছিল। একটা বিশাল এলুমিনিয়ামের ড্রামে লিটার লিটার জলে ঢালা হতো প্যাকেট প্যাকেট রসনা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই যে i love you Rasa, সেই রসনা। দেখে তো চোখ চকচক, জিভ লকলক। বাবার মামাতো ভাই একটা জগ হাতে সেই রসনা ঘুটছেন আর গ্লাসে ঢেলে অতিথিদের জন্য রেডি করছেন। পাড়ার দাদারা সার্ভ করছে। জনা পাঁচেক বাচ্চাপার্টি দু তিনবার ঘুর ঘুর করে সুযোগ বুঝে ঝুলে পড়লাম, ও ভোলা কা রসনা দাও না গো। সে চোখ পাকিয়ে বলে দিল, বরযাত্রী না এলে কিচ্ছু পাবি না। যে খেল গিয়ে।
  কি ভীষণ অপমান! সবার মুখ ভার। মনে মনে ভাবলাম, কবে যে দাদাগুলো বিয়ে করবে আর আমরা বরযাত্রী হয়ে একটু খাতির পাবো। বর বা জামাইবাবু আসার সময়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। সবাই ছুটে যায় বর এসেছে এসেছে। তাদের বর দেখার আগ্রহে এই ছোট্ট শরীর গলিয়ে কোনোদিনও জামাই বরণ দেখতে পেলাম না। বরযাত্রীর হাতে হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভার পড়ে গেলে তো ব্যস্ততার শেষ নেই। দিদির বিয়েতে আমরাও কিছু কাজ করেছি। যা হোক তেড়ে খেলার ফলে ক্ষিদে পেয়ে যেত জবর। ফার্স্ট ব্যাচে দূরের অতিথিদের একাধিপত্ব। তারা খেয়েই বেরিয়ে যাবেন। ততক্ষণে বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। দাউদাউ আগুনের সামনে দুই পাঁঠ...থুড়ি পাত্র পাত্রী হাফ সিরিয়াস হয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ছে। আমরা কজন ফাঁক ফোকর গলে পাশে দাঁড়িয়ে পরতাম, ছবি উঠবে যে। একবার ফ্লাস হয়ে গেলে কি আর বাদ দিতে পারবে? হিঃহিঃহিঃ।
 এবার রাতের খাওয়ার পালা। লুচি, ছোলার ডাল, বাঁকা বাঁকা ফিস ফ্রাই, ভাত, মুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, ধোঁকার ডালনা, মাছ, খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি, দই, পান। শালপাতাটা অনুগ্রহ করে চেবাবেন না। এখানেও কিন্তু একটা হালকা পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টভাবে চোখে পড়তো। যে দিদি বা পিসি একটু বেশি সুন্দরী, সে না খেতে পারলেও তার পাতেই খাবার গুলো বেশি বেশি করে পড়ত।কেন যে দাদারা তাদের সামনেই বেশি ঘুরঘুর করতো কে জানে বাবা! তারপর? তারপর আর কি, চোখ ঢুলু ঢুলু। সিঁদুর দান শেষ হতে ঘুম। বাসর ব্যাপারটা কি কোনোদিনও বুঝিনি। এই বাসরে নাকি ভালো ভালো গান হয়, দুস্টু মুসটু ইয়ার্কি হয়। হলে হয়, ঘুমের থেকে ভালো কিছু হয় নাকি! আমার বিয়ের বাসর রাত জেগেছিল আমার বোনপো, বোনঝি আর সবেধন নীলমনি একমাত্র বৌদি। ফলে সেই যে একটা মিথিকাল বিবাহ বাসর আমার দেখা হয়নি এখনও।
  যাকগে, বিয়ে শেষ। বিয়ের গল্পও শেষ। বৌভাত তো অন্যরকম। যে দিদি আগের দিন কেঁদে ভাসায় সেই পরের দিন বাপের বাড়ির সকলকে অভ্যর্থনা করে। কি অদ্ভুত না? সব ভালোর শেষে যখন স্কুল থেকে ফিরে জেঠুর বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়াতাম ঘরটা খাঁ খাঁ করতো। জমজমাট বাড়িটা নিমেষে ফাঁকা। বুম্বার কথাটা কানে এসে লাগত, দিদিকে তো রোজ রোজ আর দেখতে পাবো না।

বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২০

অনুগল্প- প্রশ্ন

প্রশ্ন
কেয়া চ্যাটার্জী

এক বাড়িতে একটা বিড়াল ছিল। তার ভীষণ লোভ ছিল মাঠের পাশে আমগাছে বাসা বাধা ফিঙে পাখিটার ওপর। বিড়ালটা রোজ একটা করে মাছ চুরি করে এনে আমগাছের গোড়ায় বসে ফিঙেকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেত। যেন বলতো তোকেও এইভাবেই খাবো। ফিঙে তার বাচ্চাদের আগলে রেখে ভাবতো কবে ওরা বড় হবে আর এই বাসা ছেড়ে উড়ে যেতে পারবে।
  একদিন পাখিটা দেখল, গাছের নিচে একটা লোক একটা কাপড় মোড়া ঝুড়ি নিয়ে এসে বসল। ঘর্মাক্ত কলেবরে, গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য একটু আশ্রয় নিল গাছের ছায়ায়। কিছুক্ষন পরেই নাক কুঁচকে তাকাল গাছের নীচে পড়ে থাকা মাছের আঁশ-কাঁটার দিকে। সে তার ঝুড়ি থেকে কিছু ফুল ফেলে দিল ওই আবর্জনার ওপর। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। সূর্য পাটে গেলে ফিঙে দেখল কে একজন ওই ফুলের সামনে মোমবাতি আর ধুনো জ্বালিয়ে চলে গেল।
  পরেরদিন সকালে বিড়াল এসে দেখে তার সাধের খাওয়ার জায়গাটা কারা যেন নোংরা করে দিয়েছে। সে থাবা দিয়ে পরিষ্কার করতে যেতেই কিছু লোক রে রে করে তেড়ে এলো তার দিকে। সেদিনের মতো বিড়াল পালিয়ে বাঁচল।
  ক্রমে দিন যায়, মাস যায়, এম গাছের নীচে রোজই কিছু লোক এসে শব্দ করে কি সব বলে। মানুষের ভাষার তুলনায় সে ভাষা একটু দুরূহ। অন্তত বিড়াল বা ফিঙে সেসব ভাষা এর আগে কখনো শোনেনি। এরপর জায়গাটায় বাড়ি উঠল। পাশাপাশি দুটো বাড়ি। তাতে দুটি আলাদা রঙের পতাকা লাগানো। আমগাছের দুটো ডালও গেছে ছাঁটা। ফিঙে কোনোমতে বাসাটা সামলে রেখেছে। ফিঙে আর বিড়াল পরস্পরের দিকে করুণ মুখে চায়। তাদের সম্পর্কের সমীকরণটা কেমন পাল্টে গেল। এখন ফিঙে বিড়ালের পাশে উড়ে এসে বসে। বিড়ালেরও ইচ্ছে করে না ফিঙেকে খেয়ে ফেলতে। ফিঙে ছাড়া যে তার আর বন্ধু নেই।
   একদিন আকাশ ছেয়ে মেঘ করল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আকাশে বুক কাঁপানো বিদ্যুতের ছটা। ফিঙের বাসা গেল ভেঙে। সে তার ভাঙা বাসা আর ছোট ছানাদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিড়াল তা দেখতে পেয়ে এক ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে ছানা সমেত বাসাটা মুখে করে বাড়ির বারান্দায় এনে রাখল। ফিঙেও এসে বসল তার পিছু পিছু। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল তার মাথা।
  সকালবেলা ভোর হওয়ার আগেই কি এক কোলাহলে বিড়াল আর ফিঙে বাইরে মাথা বের করে দেখে, কিছু লোক নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। দুটি রঙের পতাকা লুটিয়ে রয়েছে মাটিতে। হঠাৎ একজন আরেকজনের মাথা দিল ফাটিয়ে। হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড বেঁধে গেল চারিদিকে। রক্তের বন্যা যেন এলাকাময়। কেউ এল না ওদের থামাতে।
  বিড়াল ফিঙেকে প্রশ্ন করল, “হ্যাঁ রে বন্ধু, মানুষ কি মানুষের মাংস খায়?”
ফিঙে দুপাশে মাথা নাড়ালো।
বিড়াল বলল, “তবে ওরা লড়ছে কেন?”

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

History of English literature


History of English literature:
ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস: চসার সমকালীন কবি
John Wyclif: জন উইক্লিফ: (১৩২৪-১৩৮৪)
চতুর্দশ শতকে ইংরাজি সাহিত্যের একজন শক্তিশালী কবি ছিলেন জন উইক্লিফ। তিনি তাঁর সরল ও চলিত ভাষার বক্তৃতার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন।  চসারের মতো অভিজাতদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টির কথা  তিনি ভাবতেন না। বরং তাঁর আগ্রহ ছিল সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি। তাঁর প্রতিভা তাঁকে "ইংরাজি গদ্যের জনক" বা “father of English prose” উপাধি নিয়ে আসে।
  উইক্লিফ বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। যদিও তিনি কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি, শেষ করেন তাঁর শিষ্য Nicholas of Hereford. বাইবেলটি অনুবাদ করা হয় ল্যাটিন ভাষা থেকে এবং ১৩৮৮সালে John Purvey, উইক্লিফের আরেক শিষ্য, সেটিকে পুনর্মুদ্রণ করেন।
  উইক্লিফের কাব্য সাধারণ মানুষের জন্য রচিত হলেও, বর্তমানে তা সাধারণ মানুষের কাছে ততটা জনপ্রিয় নয়। কিছু গবেষকের মাঝেই তাঁর কাজ বরেণ্য। তাঁর বাইবেলের অনুবাদ বিভিন্ন মানুষের দ্বারাই ইংল্যান্ডে পুনরায় লিখিত হয় এবং কিছু প্রাচীন শব্দ বদলে দেওয়া হয়। যদিও উইক্লিফের এই প্রয়াস ইংরাজি সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে এক নবতম আঙ্গিকে মেলে ধরেছেন।


John Mandeville: জন মান্ডেভিল―
১৩৫৬ সালে ইংল্যান্ডের পাঠক মহলকে আচ্ছন্ন করে একটি বই যার নাম, Voyage and Travail of Sir John Maundeville.,  যা একেবারে চলিত ভাষায় লেখার ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব ফেলে।
  এই বইটির আসল লেখককে নিয়ে বেশ জল্পনা ছিল গবেষকদের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে এটি প্রমাণিত যে মান্ডেভিল ওডোরিক, মার্কোপোলো এবং অন্যান্য লেখকদের লেখা থেকে সংগৃহীত। মৌলিক লেখাটি আসলে লেখা ছিল ফ্রেঞ্চ ভাষায়, যা পরবর্তী কালে ল্যাটিন, ইংরাজি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়। যে ভাষাতেই অনূদিত হোক না কেন কাব্যটি তার সাহিত্য গুণের জন্য সর্বত্র প্রশংসিত হয়।
বর্তমানে মান্ডেভিলের পাণ্ডুলিপির ৩০০কপি সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে রয়েছে। একজন ভালো পাঠক দু থেকে তিন ঘন্টায় এই বইটির রসাস্বাদন করতে পারেন। চতুর্দশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতির এটি একটি জ্বলন্ত নথি।

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

সুখ


কণিকাকে অটোর লাইনে দেখতে পেয়েই মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল নন্দিনী। কণিকার ডাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে হলো। স্মিত হেসে বলল, “ও তুই, ভালো আছিস?” কান থেকে হেডফোন খুলতে খুলতে কণিকা বলল, “হ্যাঁ রে ভালো আছি। তা তুই কি এদিকে থাকিস?” 
― হ্যাঁ আরেকটু ভিতরে। চল না।
― না রে। আজ অফিস যেতে হবে তাড়াতাড়ি। পরে একদিন যাবো। তোর ফোননম্বরটা দে না।
নম্বর বিনিময়ের মাঝে নন্দিনী আড় চোখে গিলতে থাকলো কণিকার পোশাক, কানের দুল, স্পা করা চুল, ওয়াক্স করা হাতে পিছলে পড়া রোদ্দুর। মিলিয়ে নিল নিজের রোদে পোড়া চামড়া আর ফেটে যাওয়া গোড়ালি। নাঃ কোনো ভাবেই কণিকার পাশে নন্দিনীকে মানাচ্ছে না। ফোনটা ব্যাগে চালান করে কণিকা বলল, “বল, কি করছিস আজকাল?” নন্দিনী এই প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু অস্বস্তি বোধ করে বরাবর। একইরকম ম্লান হেসে বলল, “কিছু না। বাড়িতেই থাকি।” কণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলে ফেলল, “উফ বাড়িতেও অনেক কাজ রে। ভালোই আছিস। আমি তো দুদিক সামলে আর পেরে উঠছি না। জবের চেষ্টা করছিস?”নন্দিনী কিছু বলার আগেই অটো চলে এলো। কণিকা হাত নেড়ে উঠে পড়ল অটোতে। চেঁচিয়ে বলল, “আসি রে। ফোনে কথা হবে।” নন্দিনী ঘাড় নেড়ে বিদায় জানালো। অটোটা মিলিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো নন্দিনী। বিয়ের পর থেকেই এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত। চাকরি করে না কেন? আজকাল যেকোনো শিক্ষিত মেয়েই চাকুরিরতা। নন্দিনীর যে ইচ্ছে করে না তা নয়। কিন্তু বৃদ্ধ দিদি শাশুড়ি আর তিন বছরের বিট্টুকে ছেড়ে বেরোনো তার পক্ষে অসম্ভব। নন্দিনীর স্বামী বেসরকারী চাকুরে। বাড়ি সেই মেদিনীপুর। ওর মা বাবা পরিবার থাকে ওখানেই। শ্রীমন্ত কলকাতায় চাকরি সূত্রেই থাকে।   নন্দিনীর সাথে বিয়ের দু বছরের মাথায় বিট্টু আসে। ছেলে বছর খানেক হতে না হতেই শ্রীমন্ত তার সংসারে নিয়ে এলো তার দিদাকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য। বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর পর অতিরিক্ত আয়া রাখা শ্রীমন্তর পক্ষে সম্ভব নয়, জানে নন্দিনী। তাছাড়া, ছেলেটাকে অপরিচিত একজনের হাতে ছেড়ে যেতেও মন চায়না। ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে। কতো স্বপ্ন ছিল তার নিজের জীবন নিয়ে। কতো ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গেল। শ্রীমন্ত মানুষটা খারাপ নয়। তবু তার এই অসম্পূর্ণ জীবনের জন্য বিয়েকেই দায়ী করে সে। কি ক্ষতি হতো বাবা মায়ের, যদি আরেকটু সময় দিত? চোখ ফেটে জল আসে নন্দিনীর। ছেলের গায়ের চাদরটা আরেকটু টেনে দিয়ে জানলার কাছে এসে বসে। দুপুরগুলো খুব আলসে কাটে তার। এইটুকু সময় নিজের করে পাওয়া যায়। বই পড়া, গান শোনা, আকাশ পাতাল চিন্তা, সব টুকুই নিজের, একান্ত নিজের। কেউ ভাগ বসানোর নেই। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল নন্দিনীর। অচেনা নম্বর। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে কলকল করে ভেসে এলো কণিকার কণ্ঠ, “কি রে কি করছিস? ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?” আলতো হেসে নন্দিনী জানালো সে দুপুরে ঘুমায়না। নানান কথায় ভাসতে লাগলো দুই সখীর শব্দতরী। পুরোনো গল্প, পুরোনো বন্ধুদের কথা। নন্দিনীর মনে আরেকবার দগ্ধে উঠল ক্ষত। তার থেকে কম রেজাল্ট করা ছেলে মেয়েগুলোও এখন স্ব-নির্ভর আর সে পঞ্চাশ টাকার জন্য স্বামীর কাছে হাত পাতে। চোখটা ভিজে গেল আবার। এ জ্বালা যে কবে জুড়াবে! কণিকা হঠাৎ  জিজ্ঞেস করলো , “তোর ফিউচার প্ল্যান কি?” নন্দিনী থতমত খেয়ে বলল, “কিসের ফিউচার প্ল্যান বলতো?” 
― কেন? তোর এত ভালো রেজাল্ট, এত ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলি তুই। নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করবি না?
Pro gym ― men's gym and sports wear T-shirt for men.




নন্দিনী একচোট হেসে নিয়ে বলল, “আমার আবার কেরিয়ার! সব শেষ রে, সব শেষ।” 
ওপারে কণিকার গলায় সন্দেহ ভেসে উঠল, “কেন তোকে চাকরি করতে দিচ্ছে না শশুরবাড়ি?” নন্দিনীর মনে হলো বহুদিন পর কাউকে পাওয়া গেল যে তার কথা শুনতে চায়। তার ব্যাপারে জানতে চায়। সে নিজের মনের আগল খুলতে শুরু করলো। তার অভিমান, ব্যথা, কষ্ট একে ঝরে পড়ল অশ্রুবিন্দু হয়ে। নন্দিনীর কথা শেষ হতেই ওপাশে শোনা গেল কণিকার হাসি। নন্দিনীর মনে হলো এ তাচ্ছিল্যের হাসি। তার ব্যর্থতায় কণিকার সাফল্য হাসছে। নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই হাসছিস? খুব মজা লাগছে বল আমার কষ্টে?” কণিকা তার হাসির বেগ চাপল, “আরে তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? তোর তো অনেক সুবিধা। মাথার ওপর ছাদ আছে। খেতে পাস। কোল জুড়ে একটা সন্তান আছে। কতো মানুষের আরো কতো কষ্ট, কতো সমস্যা আছে জীবনে জানিস?” নন্দিনী কিছুই শুনতে চাইছে না এখন। তার মন চাইছে সমবেদনার কথা কিন্তু কণিকা তাকে জ্ঞান দিচ্ছে। কণিকা ওদিকে বলেই চলেছে, “আমার বাপেরবাড়ির পাড়ায় একটা মেয়েকে তার বাবা টাকার বিনিময়ে পাচার করে দিয়েছিল, সেই মেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে এখন একজন সমাজসেবী। আমার কাজের মেয়েটা দশ বাড়ি খেটে মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেল। আর তুই তো ভালো আছিস, সুখে আছিস। এত ডিপ্রেশন কেন তোর?” নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর পক্ষে এসব কথা বলা বেশ সোজা। তুই চাকরি করিস, প্রতিষ্ঠিত, নিজের টাকা আছে। আমার কিছু নেই। দশটাকা নিজের জন্য খরচ করলে মনে হয় দেনা বেড়ে গেল। কোন অধিকারে অন্যের কষ্টের টাকা খরচ করছি। তোর জীবনটা অনেক সুখের।” ওপাশ এবার নিস্তব্ধ। নন্দিনী ভাবলো একটু কি বেশিই বলে ফেলল সে? বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করে সারা এলো।
 “বল”
― চুপ করে আছিস যে?
― এই ভাবছি, আমি কতো সুখী।
―মানে?
― আমার বিয়ের পাঁচ বছর হলো, এখনো একটা সন্তান হলো না রে। প্রবলেমটা ওর, কিন্তু মানতে চায়না, ট্রিটমেন্ট করে না। রোজ ঝগড়া, রোজ ঝামেলা। শশুরবাড়ির কুকথা। একটা ব্যবসা করতো, ধার দেনায় লাটে উঠলো। বাধ্য হয়ে চাকরি করছি রে। নাহলে তো খেতে পাবো না। কতো ইচ্ছে ছিল জানিস নিজের একটা পার্লার বানাবো। নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করবো। সবার জীবন বাইরে থেকে যতটা সুখের মনে হয় ততটা সুখের নয় জানিস তো। তবে যেদিন তোর সাথে দেখা হলো সেদিন চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম।” নন্দিনী আকাশ থেকে পড়লো, “চাকরি ছেড়ে দিলি?” কণিকা স্বস্তির হাসি হাসল, “হ্যাঁ। পাড়ায় একটা ঘর ভাড়া নির পার্লার খুলেছি। বর খুব চেঁচামেচি করেছিল। পাত্তাই দিইনি। খুব ভালো লাগছে। কোনো চাপ নেই। বস নেই। একদম ফ্রি। বল জয়েন করবি আমায়?” নন্দিনী চুপ করে রইল। কণিকা বলল, “এই শোন না কাস্টমার এসেছে। এখন রাখি পরে কথা হবে। বাই।” ফোনটা কাটার সঙ্গে সঙ্গে বিট্টু এসে দাঁড়ালো পাশে। ছেলেটা ঘুম ভাঙলে এখন আর কাঁদে না। বিট্টুকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো নন্দিনী। এই একটি অভাব কতো বুক খালি করে রেখেছে! বিট্টুকে কোলে নিয়েই আরেকটা ফোন করলো সে, “হ্যালো সুতপা। তোমার মেয়েকে পড়তে পাঠাবে বলেছিলে, পাঠাবে আমার কাছে? --- তবে কাল থেকেই পাঠিও.....”

নন্দিনীর ভীষণ শান্ত লাগে নিজেকে। শিক্ষা আর ইচ্ছা একটা না একটা পথ বানিয়ে দেয় পরিচিতি গড়ে তোলার। টাকার থেকেও বেশি দামী এই পরিচিতি। পথ নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়। এগিয়েও যেতে হয় নিজেকেই।

বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস: চসারের যুগ।

History of English literature :
The Age of Chaucer :

একটি দেশের সাহিত্য সেই দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলে আবহমানকাল ধরে। চতুর্দশ শতাব্দীর দুটি ঘটনা ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটায়, যা ইংল্যান্ডের সাহিত্য চর্চার ওপর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব ফেলছিল।
     দীর্ঘ একশত বছরের যুদ্ধের ইতি ঘটিয়ে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড  চুক্তি অনুযায়ী দুটি আলাদা দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। এর ফলে ফরাসী ভাষা তার কৌলিন্য হারায় ও ইংরাজি ভাষা শুধু
  Geoffrey Chaucer: A prologue to the Canterbury Tales (with text) by Raghukul Tilak
সাধারণ মানুষের ভাষাই নয় রাজদরবারের ভাষা হিসেবে সম্মান অর্জন করে। দ্বিতীয়ত, এই সময় মানুষের চিন্তা ধারার কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। বহু প্রচলিত রাজ পরিবারের বিলাস বহুল জীবনযাপন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলেন। একদিকে রাজা  দ্বিতীয় রিচার্ড এর বিলাসী জীবন, অপরদিকে কর প্রদানকারী সাধারণ কৃষক মজুরদের দুর্বিষহ জীবন রাজার সিংহাসন টলিয়ে দেয়। ইংল্যান্ডে বিপ্লবের সঞ্চার হয়।

এই দুটি ঘটনা ছাড়াও, এই সময় অধিবাসীরা ব্যবসা বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করে। তাদের দেশের মাটি ছেড়ে তারা সমুদ্রাভিযানে নামে। বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে, ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। তাছাড়া, স্পেন, ইটালি সহ ইংল্যান্ডে এই সময় রেনেসাঁসের আবির্ভাব ঘটে।

 চতুর্দশ শতকের এই দোলাচলপূর্ণ সময়ের পাঁচ জন কবি ইংরাজি সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন। Langland, Wycliffe, Gower, Mandeville, Chaucer.

  এঁদের মধ্যে চশার প্রভূত খ্যাতির অধিকারী হন। তাঁর লেখায় সমকালীন বিখ্যাত অ-ইংরেজ কবি যথা Dante, Petrarch, Boccaccio-র অনুপ্রেরণা পরিলক্ষিত হয়। ইংল্যান্ড ও ইতালীয় সাহিত্য ও বৌদ্ধিক পরিবর্তন সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্য ও চিন্তা ধারার ওপর প্রভাব ফেলেছিল।

Geoffrey Chaucer [1340-1400]

       চসারের জীবনকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রত্যেক পর্যায়েই তাঁর জীবনযাত্রা তাঁর লেখনীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর শৈশব কাটে লন্ডনে। সতেরো বছর বয়সে তিনি রাজকন্যা এলিজাবেথের কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন। ঊনিশ বছর বয়সে কুখ্যাত একশো বছরের যুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় তিনি জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন অথবা বলা যায় মৃত্যুকে খুব নিকটে আসতে দেখেছেন। এই সময়ে প্রাপ্ত জীবনবোধ বারবার উঁকি তাঁর কবিতায়। এরপর ফিরে এসে রাজার অনুচর হিসেবে যোগ দিলে তাঁর সাথে রানীর এক সহচরীর বিবাহ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালের লেখা থেকে অনুমিত হয় যে এই রাজকীয় বিবাহ খুব একটা সুখকর ছিল না।



    1370 খ্রিস্টাব্দে চসারকে পাঠানো হয় ইটালি। এই সময় তাঁর কবিতায় ইতালীয় সাহিত্যের বেশ প্রভাব পরে যার ছায়া আমরা দেখতে পাই তাঁর অসম্পূর্ণ কবিতা  “Hous of Fame”এ। Dante, Ovid, Virgil তাঁর লেখার রসদ জোগালেও এই কবিতার বিষয় ও মৌলিক ভাবনার জন্য চসারের সাহিত্য ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারা যায়না। 1386 খ্রিস্টাব্দে তিনি পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৎ ব্যক্তিদের প্রতিকূল হয়ে পরে। চসার বিভিন্ন পার্টি থেকে ডাক পেলেও তিনি John of Gaunt এর পার্টির সাথেই আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন।
 “Romaunt of the Rose” তাঁর জীবনের প্রথম কাব্য কীর্তি। ফরাসি কবিতা “Roman de la Rose” এর অনুবাদ হলেও কবিতাটির চসারের কবি প্রতিভা কোনো ভাবেই ক্ষুন্ন হয়নি।



  তাঁর পৃষ্ঠপোষক John of Gaunt এর স্ত্রী Blanche এর মৃত্যুর পর যিনি রচনা করেন Dethe of Blanche the Duchesse যা Boke of Duchesse হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। এছাড়াও তাঁর ছোট কবিতার মধ্যে Truth বেশ জনপ্রিয়।
 ইতালিতে থাকাকালীন তিনি রচনা করেন Troilus and Criseyde. এটি একটি ৮০০০ লাইনের কবিতা। Boccaccio র Il Filostroto র অনুপ্রেরণায় কবিতাটির জন্ম। এই কবিতার মূল ভাবনার ওপর নির্ভির করে নাট্যকার সেক্সপিয়ার রচনা করেছিলেন নাটক ট্রইলাস ও ক্রিসেডি।
House of Fame এর পর তিনি রচনা করেন আরেকটি কাব্য “The Legende of Goode Wimmen” .  এটি সমকালীন ও পূর্বতন কিছু মহিয়সী নারীর জীবনী ও কথা বর্ণনা করা আছে। কিন্তু গ্রন্থটি নয়জন নারীর সম্পর্কে লেখার পরে শেষ হয়ে যায়। এটিকে অসমাপ্ত কাব্য হিসেবেই ধরা হয়। হয়তো সেই সময়েই তাঁর মনে শুরু হয়ে গেছিল বিখ্যাত Canterbury Tales এর প্লটের বুনন।

  Canterbury Tales চসারের জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য কর্ম। তিনি প্রধানত চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সমাজ ও জীবনযাত্রার কথা তারই অধিবাসীরা নিজের মুখে বলুক। তাই তিনি সৃষ্টি করলেন কিছু পর্যটকের যারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সামাজিক স্তরের প্রতিনিধি। এক রাত্রে সকলে কাকতলীয় ভাবে একত্রিত হওয়ার পর শুরু হলো সকলের নিজ নিজ গল্প বলা। এই গল্পগুলির মাধ্যমেই উঠে আসে ইংল্যান্ডের সমাজ, সংস্কার, রীতি-নীতি, ও রাজনীতি। এই কাব্যটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি কিন্তু তাঁর এই অসাধারণ ভাবনাটি আজ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রার এক সুন্দর ও সফল নথি হিসেবে পরিচিত।

  ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। Westminister Abbey তে তাঁর স্মৃতি সৌধ রচিত হয়। চসার ইংরাজি  তথা বিশ্বসাহিত্যের জয়যাত্রার একজন উজ্জ্বল পথ প্রদর্শক। তিনি অবিস্মরণীয়।

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা #কেয়া_চ্যাটার্জি প্যারিস পর্ব • #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস...