বেলুন
কেয়া_চ্যাটার্জী
কেয়া_চ্যাটার্জী
দার্জিলিং শহরটা বেশ অদ্ভুত। একদিকে কোলাহল আর একদিকে পাথরের নীরবতা। ঝিলম এই নীরব দিকটাতেই বসে আছে। রেলিঙের ওপারে সুগভীর খাদ। একটু এগোলেই ম্যালের জনবহুল রাস্তা। এখানে পরপর অনেকগুলি হোটেল ও রিসর্ট। তারই মাঝে মাঝে কয়েকটা চওড়া জায়গায় ছাউনি দিয়ে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দুটি নেপালী ভদ্রমহিলা বড় বড় ফ্লাস্কে চা আর কিছু কৌটোয় রকমারি বিস্কুট বিক্রি করছেন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন আঞ্চলিক ভাষায়।
ঝিলমের ফোনটা বেজে উঠল। আকাশের নম্বর। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে এক কাপ চা নিয়ে ফের চুপচাপ বসলো বেঞ্চে। সূর্য আজকের মতো গোলাপি লাল আভা ছড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রিয়তমা পৃথিবীকে। এই প্রেম পর্বই ভালো। ভালোবাসা থাকে। যেমন ভালোবাসা ছিল আকাশ আর ঝিলমের। পাঁচবছর আগে অবধি।
একই অফিসে কাজ করার সুবাদে ওদের আলাপ, বন্ধুত্ব, তারপর তা গড়িয়ে বিশেষ এক সম্পর্ক। যেদিন আকাশ অফিসিয়ালি প্রপোস করেছিল সেদিনই ওদের বাড়ি গিয়ে ডেট ফাইনাল করে এসেছিল পাঁজি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। ঝিলমের মা বাবা বেশ হতবাক হয়েছিলেন। পাত্র নিজেই এসে বিয়ের কথা বলছে! দুসপ্তাহ পরে আসেন আকাশের মা বাবা জলপাইগুড়ি থেকে। ছেলের পাগলামী সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত তাঁরা। হেসে বলেছিলেন, “মিয়াঁ বিবি রাজি তো আমরা চার কাজী আর নাক গলিয়ে কি করবো বলুন তো?”
বিয়ের তিনমাস পর তারা হানিমুন সারতে আসে দার্জিলিং। কিন্তু পাঁচবছর আগের নিখাদ বন্ধুত্বে কেমন একটা ভাঁটা পরে গেছে ইতিমধ্যে। আকাশের অতিরিক্ত প্রাণচ্ছলতা অসহ্য লাগতে শুরু করে ঝিলমের। কথায় কথায় হেসে ওঠা, ভুলে যাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া সব সব অসহ্য ঝিলমের কাছে। আজকেও আকাশের মাথায় বাই চাপলো ঘোড়ায় চড়বে। ঝিলম সাফ না জানিয়ে দিলো, কিন্তু আকাশ টুক করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলল, তুমি ওই বইয়ের দোকানে থাকো, আমি একটু ঘুরে আসি। লেট করবো না প্রমিস। তারপর একঘন্টা কেটে গেলেও আকাশের পাত্তা নেই। ফোন করলেও তুলছে না। মাথা গরম হয়ে উঠল ঝিলমের। ম্যাল ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুল এই জায়গাটায়। আকাশ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। তোলেনি। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছেলেটাকে।
হঠাৎ একটা গান কানে আসতেই ঝিলম এদিক ওদিক ফিরে দেখল সামনের বেঞ্চে একটি লোক পাহাড়ের দিকে মুখ করে আপন মনে গেয়ে চলেছেন, “আঁখি পানে চেয়ে বলে না..না..না..সে যে মানে না মানা।” কলকাতার বাইরে বাঙালি দেখলে, তার সাথে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে। তার গান শেষ হতে ঝিলম বলে উঠল, কলকাতা? লোকটি পিছন ফিরে চাইল। না লোকটি বাঙালি না বরং গোর্খা। সে হেসে বলল, “না দার্জিলিং।” ঝিলম অবাক হয়ে বলল, “আপনি এতো স্পষ্ট বাংলা বলেন কি করে?” লোকটি আবার একগাল হেসে বলল, “আমার বউ শিখিয়েছে। বউ কিন্তু কলকাতায় থাকত।” ঝিলম বলল, “বিয়ের পর তাহলে এখানেই থাকে?” লোকটির মুখ একটু ম্লান হলো। বলল, “হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এখানেই থাকে। বরাবরের মতো।” ঝিলম এতক্ষনে দেখল লোকটির হাতে একগোছা লাল নীল বেলুন। পাহাড়ি হাওয়ার দাপটে ভীষণ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ঝিলম হেসে বলল, “কটি ছেলে মেয়ে আপনাদের?” লোকটি এবার বেলুনগুলো দিকে চেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো হেসে উঠে বলল, এ তো আমার বড় বাচ্চার জন্য। আমার বৌএর জন্য। অনেকদিন দেখা হয়নি তো। রাগ করেছে। এই বেলুনগুলো দেখলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে, আমি জানি।” একটু থেমে আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “আমিও খুব রাগ করতাম। বৌটা একদম সংসারী ছিল না। ভীষণ ছেলে মানুষ। রাঁধতে পারত না, দরকারি কথা ভুলে যেত, কাজের সময় বসে ছবি আঁকত। একদম অগোছালো। ভীষণ রাগ করতাম। বকতাম। ও কাঁদতো। ভাবতাম কাঁদুক, ভুল বুঝে শুধরে যাবে। কিন্তু...”
― কিন্তু?
ঝিলমের প্রশ্নে লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়াল। “আমি যাই ম্যাডাম। দেরী হয়ে গেল। দেরী হলে আবার রাগ বেড়ে যাবে। বেলুনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে ।” এই বলে একগাল হেসে ঢাল বেয়ে নেমে যেতে লাগল নীচে। ঝিলমের ভীষণ কৌতূহল হলো। সেও লোকটির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। রাজভবন পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে লোকটি একটি ছোট গেট খুলে ঢুকে গেল একটি জঙ্গল ঘেরা স্থানে। ঝিলমও তার পিছু পিছু ঢুকে বুঝতে পারল এটি কবরস্থান। দূরে কিছুটা গাছ গাছালি ঘেরা জায়গায় লোকটি বসে আছে। সামনের একটি বেদীতে বাঁধা সেই লাল নীল বেলুন গুলি। লোকটি আপন মনে গল্প করছে তার স্ত্রীর সাথে। তার চিরকালের অভিমানী প্রেমিকা।
চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। ঝিলম ছিটকে বেরিয়ে এলো ওখানে থেকে। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে গতি বাড়িয়ে দৌড়োতে লাগল। আকাশ কোথায়? তার অগোছালো খামখেয়ালি আকাশ? ওদের হোটেল পেরিয়ে আরো কিছুটা যেতেই পিছন থেকে হাতে টান পড়তে ফিরে দেখল অবাক দৃষ্টিতে আকাশ দাঁড়িয়ে তার সামনে। ঝিলমের চোখে জল দেখে বলল, “ঘোড়াটাকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল জানতো। অবলা প্রাণী কষ্ট পাচ্ছিল। হাসপাতালে গেছিলাম। আমারও একটু হাত পা ছড়ে গেছে।তোমায় কতো বার ফোন করলাম, তুমি কিছুতেই রিসিভ করলে না। আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল জানো?” ঝিলম আঁকড়ে ধরল ওকে। আকাশ জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদছো কেন? ঝিলম অস্ফুটে বলল, কিছু না।
ঝিলমের ফোনটা বেজে উঠল। আকাশের নম্বর। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে এক কাপ চা নিয়ে ফের চুপচাপ বসলো বেঞ্চে। সূর্য আজকের মতো গোলাপি লাল আভা ছড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রিয়তমা পৃথিবীকে। এই প্রেম পর্বই ভালো। ভালোবাসা থাকে। যেমন ভালোবাসা ছিল আকাশ আর ঝিলমের। পাঁচবছর আগে অবধি।
একই অফিসে কাজ করার সুবাদে ওদের আলাপ, বন্ধুত্ব, তারপর তা গড়িয়ে বিশেষ এক সম্পর্ক। যেদিন আকাশ অফিসিয়ালি প্রপোস করেছিল সেদিনই ওদের বাড়ি গিয়ে ডেট ফাইনাল করে এসেছিল পাঁজি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। ঝিলমের মা বাবা বেশ হতবাক হয়েছিলেন। পাত্র নিজেই এসে বিয়ের কথা বলছে! দুসপ্তাহ পরে আসেন আকাশের মা বাবা জলপাইগুড়ি থেকে। ছেলের পাগলামী সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত তাঁরা। হেসে বলেছিলেন, “মিয়াঁ বিবি রাজি তো আমরা চার কাজী আর নাক গলিয়ে কি করবো বলুন তো?”
বিয়ের তিনমাস পর তারা হানিমুন সারতে আসে দার্জিলিং। কিন্তু পাঁচবছর আগের নিখাদ বন্ধুত্বে কেমন একটা ভাঁটা পরে গেছে ইতিমধ্যে। আকাশের অতিরিক্ত প্রাণচ্ছলতা অসহ্য লাগতে শুরু করে ঝিলমের। কথায় কথায় হেসে ওঠা, ভুলে যাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া সব সব অসহ্য ঝিলমের কাছে। আজকেও আকাশের মাথায় বাই চাপলো ঘোড়ায় চড়বে। ঝিলম সাফ না জানিয়ে দিলো, কিন্তু আকাশ টুক করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলল, তুমি ওই বইয়ের দোকানে থাকো, আমি একটু ঘুরে আসি। লেট করবো না প্রমিস। তারপর একঘন্টা কেটে গেলেও আকাশের পাত্তা নেই। ফোন করলেও তুলছে না। মাথা গরম হয়ে উঠল ঝিলমের। ম্যাল ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুল এই জায়গাটায়। আকাশ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। তোলেনি। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছেলেটাকে।
হঠাৎ একটা গান কানে আসতেই ঝিলম এদিক ওদিক ফিরে দেখল সামনের বেঞ্চে একটি লোক পাহাড়ের দিকে মুখ করে আপন মনে গেয়ে চলেছেন, “আঁখি পানে চেয়ে বলে না..না..না..সে যে মানে না মানা।” কলকাতার বাইরে বাঙালি দেখলে, তার সাথে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে। তার গান শেষ হতে ঝিলম বলে উঠল, কলকাতা? লোকটি পিছন ফিরে চাইল। না লোকটি বাঙালি না বরং গোর্খা। সে হেসে বলল, “না দার্জিলিং।” ঝিলম অবাক হয়ে বলল, “আপনি এতো স্পষ্ট বাংলা বলেন কি করে?” লোকটি আবার একগাল হেসে বলল, “আমার বউ শিখিয়েছে। বউ কিন্তু কলকাতায় থাকত।” ঝিলম বলল, “বিয়ের পর তাহলে এখানেই থাকে?” লোকটির মুখ একটু ম্লান হলো। বলল, “হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এখানেই থাকে। বরাবরের মতো।” ঝিলম এতক্ষনে দেখল লোকটির হাতে একগোছা লাল নীল বেলুন। পাহাড়ি হাওয়ার দাপটে ভীষণ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ঝিলম হেসে বলল, “কটি ছেলে মেয়ে আপনাদের?” লোকটি এবার বেলুনগুলো দিকে চেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো হেসে উঠে বলল, এ তো আমার বড় বাচ্চার জন্য। আমার বৌএর জন্য। অনেকদিন দেখা হয়নি তো। রাগ করেছে। এই বেলুনগুলো দেখলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে, আমি জানি।” একটু থেমে আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “আমিও খুব রাগ করতাম। বৌটা একদম সংসারী ছিল না। ভীষণ ছেলে মানুষ। রাঁধতে পারত না, দরকারি কথা ভুলে যেত, কাজের সময় বসে ছবি আঁকত। একদম অগোছালো। ভীষণ রাগ করতাম। বকতাম। ও কাঁদতো। ভাবতাম কাঁদুক, ভুল বুঝে শুধরে যাবে। কিন্তু...”
― কিন্তু?
ঝিলমের প্রশ্নে লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়াল। “আমি যাই ম্যাডাম। দেরী হয়ে গেল। দেরী হলে আবার রাগ বেড়ে যাবে। বেলুনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে ।” এই বলে একগাল হেসে ঢাল বেয়ে নেমে যেতে লাগল নীচে। ঝিলমের ভীষণ কৌতূহল হলো। সেও লোকটির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। রাজভবন পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে লোকটি একটি ছোট গেট খুলে ঢুকে গেল একটি জঙ্গল ঘেরা স্থানে। ঝিলমও তার পিছু পিছু ঢুকে বুঝতে পারল এটি কবরস্থান। দূরে কিছুটা গাছ গাছালি ঘেরা জায়গায় লোকটি বসে আছে। সামনের একটি বেদীতে বাঁধা সেই লাল নীল বেলুন গুলি। লোকটি আপন মনে গল্প করছে তার স্ত্রীর সাথে। তার চিরকালের অভিমানী প্রেমিকা।
চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। ঝিলম ছিটকে বেরিয়ে এলো ওখানে থেকে। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে গতি বাড়িয়ে দৌড়োতে লাগল। আকাশ কোথায়? তার অগোছালো খামখেয়ালি আকাশ? ওদের হোটেল পেরিয়ে আরো কিছুটা যেতেই পিছন থেকে হাতে টান পড়তে ফিরে দেখল অবাক দৃষ্টিতে আকাশ দাঁড়িয়ে তার সামনে। ঝিলমের চোখে জল দেখে বলল, “ঘোড়াটাকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল জানতো। অবলা প্রাণী কষ্ট পাচ্ছিল। হাসপাতালে গেছিলাম। আমারও একটু হাত পা ছড়ে গেছে।তোমায় কতো বার ফোন করলাম, তুমি কিছুতেই রিসিভ করলে না। আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল জানো?” ঝিলম আঁকড়ে ধরল ওকে। আকাশ জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদছো কেন? ঝিলম অস্ফুটে বলল, কিছু না।