শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

About John Donne

 জন ড্যান: মেটাফিজিক্যাল কবি

কেয়া চ্যাটার্জি




সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজি সাহিত্যে উদিত হল এক নতুন ধারণার সূর্য। একদল তরুণ কবি পূর্বতন কবিদের রোম্যান্টিক ধ্যান ধারণার বাইরে গিয়ে পৃথিবীকে দেখতে শেখে এক অন্য ধরনের দৃষ্টি দিয়ে। প্রেমে কি শুধুই চাঁদ, তারা, ফুল, পাখিদের অধিকার? প্রেমিকা কেন হবে এক অলীক জগতের অধিবাসী? তাকে ছোঁয়া যাবে না কেন? শুধুই তার পথ চেয়ে কবি লিখে যাবে কিছু পেলব পংক্তি? তারুণ্যের উচ্ছ্বাস সেই না পাওয়া গুলির বিরুদ্ধে শানিয়ে তুলল নিজেদের কলম। জন্ম নিল কিছু ছক ভাঙা কাব্যের। গঠিত হল মেটাফিজিক্যাল কবি গোষ্ঠী। 

   এই গোষ্ঠীর কবিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল চিরাচরিত কাব্যের থেকে একটু আলাদা। কবিতাগুলি ছিল ছন্দবদ্ধ, আধ্যাত্মিক ও প্রেমের, কাব্যিক ভঙ্গি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও চমকপ্রদ। তবে মেটাফিজিক্যাল কবিতার আসল চমক ছিল তার উপমায়। দুটি অসম বস্তুকে উপমিত করে কবি তাঁর মনের ভাব ব্যক্ত করেন। এই ধরণের উপমা সম্বলিত কবিতার প্রয়াস এর আগে কখনো ইংরেজি সাহিত্যে ঘটেনি। সব থেকে কোমল অনুভূতিদের প্রকাশ কীভাবে কিছু নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর মাধ্যমে সম্ভব সেই ভাবনাই ঘিরে ধরল পাঠক মহলকে। 

   মেটাফিজিক্যাল কাব্যগুলির গঠন ছিল মোটামুটি একরকম ছকের। একজন কথক, মুক্ত ছন্দ এবং ভিন্ন ধরার উপমা যা পাঠককে চমকে দেবে। এই উপমার ভিতরেই নিহিত থাকে কবির জটিল ভাবনা, গভীর মনস্তত্ত্ব। মেটাফিজিক্যাল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন গবেষক ডক্টর জনসন। এই গোষ্ঠীর কবিদের রীতি ভাঙার সাহসিকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই কবিরা তাঁদের যৌন চাহিদার কথা, প্রেমের কথা, সামাজিক অবস্থানের কথা নির্দ্বিধায় জানাতেন। পূর্বতন কবিদের মতো তাঁদের পদ্যে ছিল না কোন অহেতুক অলঙ্কারের আতিশয্য। তৎকালীন কবিদের মধ্যে নাম উঠে আসে জর্জ হার্বার্ট, রিচার্ড ক্রস, হেনরি ভগান, থমাস কারিউ, অ্যান্ড্রু মার্ভেল, আব্রাহাম কাউলি, হার্বার্ট ওয়ালের প্রমুখের নাম উঠে এলেও এঁদের মধ্যে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন জন ডান। 

১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের এক অভিজাত ক্যাথোলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জন ডান। তবে তাঁর শিক্ষাজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিভেদের জন্য। তাঁকে ইংল্যান্ডের সব থেকে ঐতিহ্যপূর্ণ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ পড়াশোনা শেষ করার আগেই ছেড়ে দিতে হয়। ধর্মীয় অভিমতের অমিলের কারণে তাঁর দাদাকে একটি চার্চের পৌরহিত্য ত্যাগ করতে হয় কারাবাসে প্রাণত্যাগ করতে হয়।  এতো প্রতিকূলতার পরেও জীবনের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাননি। পরবর্তী কালে তিনি আইনের ওপর পড়াশোনা করেন। ধীরে ধীরে তিনি যে চার্চের অধীনে তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন সেটি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বিভেদের উর্দ্ধে গিয়ে নিজেকে শুধুমাত্র একজন খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিতেন। 

 কবিতা লেখার অভ্যাস ছোটোবেলা থেকেই তাঁকে ঘিরে ছিল। প্রাপ্তবয়সে কবিতা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি ভাগ করে নিতেন দরিদ্র ক্যাথোলিক পরিবারের সাথে। তিন বছর তিনি বসবাস করেন ইউরোপে। ফিরে এসে লর্ড এগেরটনের সেক্রেটারির কাজে নিযুক্ত হন। এই সময় তাঁর পরিচয় ঘটে তাঁরই মালিকের ভাইঝি অ্যান মোরের সাথে। তাঁরা দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। তাঁর প্রেমের অপরাধে তাঁকে কারাবাস করতে হয়। তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। বহু বছরের দারিদ্রতার জ্বালা সহ্য করার পর অ্যানের পিতা জর্জ মোর তাঁদের ক্ষমা করেন ও তার কন্যার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জন এই আরামের জীবন চাননি কখনোই। তিনি চার্চের চাকরির সুযোগ ছেড়ে দেন। তিনি রাজা প্রথম জেমসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর পৃষ্টপোষকতা আশা করেন। কিন্তু রাজা তাঁর দিকে নজর দিলেও তাঁকে কোন জীবিকা দিলেন না। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর অ্যানের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যায়। সাতটি সন্তানের দায়িত্ব ও চরম দারিদ্র তাঁকে অবেশেষে একটি চার্চের পুরোহিত হিসেবে যোগ দিতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে তিনি শহরের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত হয়ে ওঠেন। অবশেষে তাঁকে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রালের ডিন হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। 

  জীবনের এই ওঠা পড়ার মাঝেও কবিতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁর জীবনের সবথেকে বেশি কবিতা তিনি লিখেছেন ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে ধরা পড়েছে বুদ্ধিমত্তা, কোমলতা, সন্দেহ, মানবিকতা। তাঁর কাব্যে ধরা পড়ে তাঁর গভীর মনস্তত্ত্ব, জীবনের প্রতি ভালোবাসা। তাঁর কবিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল The Flea, The Good Morrow, The Canonization, The Sun Rising, Go and catch ba falling star, The Anniversary, Holy Sonnets। এলিজাবেথান ও পেট্রারকান কবিদের চিরাচরিত ধরন থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। তাঁর ছন্দ ছিল সহজ, ভাষা ছিল সাধারন মানুষের হৃদয়গ্রাহ্য ও সাবলীল। তাঁর কাব্যে ছড়িয়ে আছে জীবনকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করার এক আনন্দ। জীবন, প্রেম, আধ্যাত্মিক চিন্তা ধারা সব ধারায় তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন এক রহস্যের চিহ্ন। 

তাঁর এই শৈলী শুধুমাত্র তাঁর পরবর্তী কবিদের মধ্যেই সীমিত ছিল না। হার্বার্ট, ক্লিভল্যান্ড, মার্ভেল ছাড়াও তাঁর এই শৈলীর বশীভূত হয়েছিলেন কবি ড্রাইডেন, কোলেরিজ, ব্রাউনিং, এলিয়ট, পোপ, হপকিন্স প্রমুখরা। খুব কম কবি তাঁর জীবদ্দশায় এতটা বিখ্যাত হতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষা বোধ, শব্দ চয়ন তাঁকে মানুষের মনের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তাঁর মৌলিকত্ব ও আধুনিক প্রকাশভঙ্গি জন ডানের নামকে ইংরেজি সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল করে রেখেছে।

মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০২২

Ruskin Bond ও কিছু কথা

  রাস্কিন বন্ড ও কিছু কথা

কেয়া চ্যাটার্জী




     বিমল, রিয়াজ, ব্রিয়ান এবং রাস্কিন হেঁটে যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। দিনটা রবিবার। বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনার ছুটি। কর্তৃপক্ষ কোনও খেলাধূলার আয়োজন না করলে ছাত্রদের এই একটি দিনেই তারা ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দেন। চলতে চলতে হঠাৎ একজন হোঁচট খেয়ে পড়ল মুখ থুবড়ে। ছেলেটি বিস্মিত হয়ে দেখল একটা প্রায় সদ্যজাত শিশুকে কাপড়ে মুড়ে কে যেন রাস্তায় রেখে দিয়ে চলে গেছে। তারা ঠিক করল এভাবে একটি বাচ্চাকে পথে ফেলে যাওয়া একদম ঠিক হবে না। অতএব তারা শিশুটিকে নিয়েই হাঁটা লাগাল স্কুলের দিকে। তারপর কী হল?

  আচ্ছা একটা বই শেষ করার পর কখনও মন খারাপ হয়েছে? মনে হয়েছে, বেশ তো ছিলাম ওদের জগতে, কেন আবার ফিরে এলাম এই রুক্ষতায়? কখনও কান্না পেয়েছে খুব? রাস্কিন বন্ড এমনই একজন লেখক। এমন একজন যে তাঁর কলমের প্রথম আঁচরেই পাঠককে বইয়ের পাতার সাথে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বারবার ধরা পরে তাঁরই জীবন স্মৃতি, অভিজ্ঞতা। নিজেকে সকলের মাঝে রেখেই সকলের গল্প বলেছেন তিনি— মানুষের গল্প, ছোটদের গল্প। ছোটদের মনের খবর দিতেন তিনি পাতার পর পাতা জুড়ে।

     ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে মে ভারতবর্ষের কাসৌলীতে জন্মগ্রহণ করে এডিথ ক্লার্ক এবং অবরে বন্ডের পুত্র রাস্কিন বন্ড। বাবার এয়ারফোর্সে চাকরি করার সুবাদে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে নানান জায়গায়। মা বাবার বিচ্ছেদ ও বাবার মৃত্যু তাঁর জীবনে ও তাঁর লেখনীতে  বিশেষ ছাপ ফেলেছে। পিতামহির লালন পালন ও সিমলার বোর্ডিং স্কুলের জীবন তাঁকে গল্প লিখতে শিখিয়েছে। অন্য চোখে, অন্য ভাবে দেখতে শিখিয়েছে চেনা জানা জগৎটাকে। তাঁর জীবন, তাঁর অভিজ্ঞতা গল্প হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে বারবার। রাস্কিন বন্ডের লেখা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর ছোটবেলা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।  কারণ লেখক হওয়ার সমস্ত রসদ, গল্পের চরিত্ররা, গল্পের ভাবনা, ছোট ছোট মুহূর্ত সবই তাঁর শৈশবে লুকিয়ে আছে। বেড়ে উঠেছে ছোট্ট রাস্কিনের মধ্যে একটা বটবৃক্ষের সম্ভাবনা।

     একটি নিঃসঙ্গ ও জটিল শৈশব পাওয়া সত্ত্বেও রাস্কিন তাঁর পাঠকদের উপহার দিয়েছেন এক একটি সদর্থক গল্প। যে জীবন তিনি চেয়েও পাননি, যা তাঁর প্রাপ্য হয়েও অধরা, তা-ই হয়তো উপহার দিতে চেয়েছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে। তাই তো তাঁর চরিত্ররা আমাদের বড় আপন। তারা যেন আমাদেরই কথা বলে, আমাদেরই মাঝে থাকে। তারা আমাদের থেকে দূরের কেউ নয়। আমাদেরই চারপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষ, নিত্য নৈমিত্তিক ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহকে অন্য আঙ্গিক ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখার এক একটি নতুন চশমা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যান গল্পের ফেরিওয়ালা। আমরা অবাক হই। জীবন এত সুন্দর!

    তাঁর লেখনীর জীবন লুকিয়ে তাঁর ভাষায়। সাবলীল বাচন ভঙ্গী, শব্দ নির্বাচন, দৃশ্য বর্ণনা, ঘটনা প্রবাহের সজ্জা, চরিত্র চিত্রণ, সহজ সংলাপ এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের সুন্দর বর্ণনা তাঁর লেখনীকে অন্য মাত্রা এনে দেয়। যা কিছু সহজ, যা কিছু সুন্দর শিশু মনকে তা-ই আকৃষ্ট করে। রাস্কিন বন্ড তাই শিশুদের প্রাণের লেখক। আসলে তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি আজও নতুন নতুন বন্ধু বানায়। শিশুরা নিজেদের খুঁজে পায় বইয়ের পাতায়। একটা স্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প, দাদু- ঠাকুমা বা একটা অংকে ভয় পাওয়া ছেলের গল্প — এরা তো অন্য কোনও  জগতের বা অন্য কোনও সমাজের মানুষ না। এরা তো আমাদেরই লোক। তারা তো আমরাই। নিজেদের জীবনের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে? 

    একটা সাধারণ ঘটনা, তা কিভাবে যেন অসাধারণ হয়ে ওঠে বন্ডের জাদু কলমে। Getting Granny's Glasses একটি ছোট ছেলে মনির তার ঠাকুমাকে মুসৌরিতে চোখের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার গল্প। এই ছোট্ট অভিযানে রাস্কিন বন্ড কি অদ্ভুত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন পথের, ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির, কুয়াশা, রাস্তায় নামতে থাকা ধস ও রাতের মুসৌরি শহরের। পরিশেষে যখন ঠাকুমা তার নতুন চশমা দিয়ে বহুদিনের অস্পষ্ট পৃথিবীকে ফের পরিষ্কারভাবে দেখতে শুরু করলেন তখন তার আনন্দের বর্ণনা, তার উল্লাস পাঠক যেন সচক্ষে দেখতে পায়। মুসৌরি যাওয়ার পথে ঠাকুমা এগারো বছরের মনির কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এদিকে ফেরার পথে মনি ঠাকুমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। একই গল্পে দু'জন মনি। একজন অত্যন্ত দায়িত্ববান, আরেকজন নিশ্চিন্ত কিশোর। রাস্কিন বন্ডের এই সরলতায় বাঁধা পরে পাঠকের হৃদয়।

কথায় আছে, যে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারে সে পৃথিবীর সব কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায়। রাস্কিন বন্ড এমনই একজন মানুষ। Roads to Mussoorie গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "Instead of a Forward I'm writing a Backward, because that's the kind of person I've always been...Very backward." এমন অকপটভাবে নিজের ব্যাপারে কে-ই বা বলতে পারে। যেমন অকপট ভাবে তিনি নিজের শৈশবের ব্যাপারে লিখেছেন তাঁর নব্য গ্রন্থে। বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ তাঁকে ততটা নাড়িয়ে দেয়নি যতটা টলিয়ে দিয়েছে বাবার মৃত্যু। মাত্র দুবছর বাবার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিনি। মায়ের ভূমিকা পালন করা বাবা রাস্কিনের জীবনের অর্ধেকটা জুড়ে। আজও একাকী সময়ে তিনি অনুভব করেন বাবার উপস্থিতি। তাঁর আশ্রয়ের ছায়া। বুজে আসা কণ্ঠে তিনি সাক্ষাৎকারীকে বলেন, যে বাচ্চারা ছোট থেকেই একা থাকতে শিখে যায়, যাদের পারিবারিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়, যারা বিচ্ছেদ দেখেছে তারা ভীষণ সংবেদনশীল হয়। এই সমস্যা আর সংবেদনশীলতা তাদের লিখতে অনুপ্রাণিত করে। যেমন তিনি নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আসলে তাঁর গল্প, উপন্যাসে তিনি নিজের কথাই লিখে গেছেন নিরন্তর। সতের বছর বয়সে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস The Room on the Road, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে পেল Llewellyn Rhys Memorial Prize.  উপন্যাসটি রচিত হয় একটি কিশোরকে ঘিরে যে তার কঠোর অভিভাবকদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে তার বন্ধুদের সাথে পালিয়ে যায় নিরুদ্দেশের পথে। আচ্ছা, আমাদের কি কখনও মনে হয় না এই কঠিন পৃথিবীর বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে? কৈশোরে কি কখনও মনে উঁকি দেয়নি নিজের একটা জগৎ গড়ার ইচ্ছা? বন্ডের গল্পে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। সুপ্ত ইচ্ছেগুলো এক ম্যাজিক ফুঁয়ে সত্যি হয়ে যায়। পাঠকের মনে তাই চিরন্তন, চির নবীন রাস্কিন বন্ড।

The Blue Umbrella উপন্যাসে একটি নীল রঙের ছাতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সমগ্র প্লটটি। 

আঙ্কেল কেন, আন্ট রুবি, বিবিজি, সমি, রঞ্জি, দলজিৎ, রাস্টি— রাস্কিন বন্ডের চরিত্ররা চির অমর পাঠকের হৃদয়ে। তাঁর মননে যেমন ছায়া ফেলেছে জীবন ও অভিজ্ঞতা তেমনই প্রভাব রেখেছেন চার্লস ডিকেন্স, শার্লট ব্রন্টে, রুডইয়ার্ড কিপ্লিংয়ের মতো বরেন্য সাহিত্যিকরা। তাঁর প্রতি গল্পে উঠে আসে মুসৌরির পরিবেশ ও প্রকৃতি, তার ছাত্র জীবন, পিতামহির সাহচর্য ও বন্ধুদের কথা, কৈশোরের স্বপ্ন, যৌবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর সারা জীবন ধরে আহরিত জীবন বোধ তিনি বিলিয়ে দেন তার পাঠক কূলের মাঝে। আমাদের বয়স বাড়লেও আমাদের মন আটকে থাকে কৌশোরে। এক স্বপ্নালু কিশোরের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সুদূরে।

শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ভালোবাসার সংজ্ঞা হয়না।

ভালোবাসা। চার অক্ষরের শব্দটা আসলে ওজনে ভীষণ ভারী। শব্দটার সঙ্গে জুড়ে থাকে দায়িত্ব, কর্তব্য, একে অপরকে আজীবন শ্রদ্ধা ও সম্মান করার দায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে।    


শব্দটা আবার ঠিক ম্যাজিকের মতো। নিমেষে এক ছোঁয়ায় সব কষ্ট, অভিমান, অনুযোগ ভ্যানিশ। আবার চিরবসন্ত উড়ে এসে বসে মনের মনিকোঠায়।


ভালোবাসা আকাশ নয়, নিজের ঘরের ভীষণ আপন কোণ। সারাদিনের পরে যার কোলে নিশ্চিন্তে চোখ বোজা যায়।


ভালোবাসার মানুষটা প্রতিপদে মন্দগুলো বিচার করে না। গুণ নিয়েও গান করে না। পিছিয়ে পড়লে বলে না, আর হবে না, থেমে যাও। বরং হাত ধরে আরেকটু এগিয়ে দেয়, হোঁচট খেলে অপেক্ষা করে, আবার তুলে ধরে। 


ভালোবাসা বেড়িবিহীনক্ষণ। যখন ভীষণ ভাবে আমি হয়ে যাওয়া যায়। লোকে কি ভাববে, ভাবতে বলে না কেউ। ভালোবাসা ভাগাভাগি করে বসা স্কুলের বেঞ্চ, একই ভাঁড়ের চা। মুহূর্তটাই ভীষণ দামী।


ভালোবাসা আসলে আজীবনের পণ। মানভঞ্জনের আবশ্যিক অবসর। নৈঃশব্দ বুঝে নেওয়ার অভ্যাস। ভেঙে ফেলার বদলে গড়ে তোলার শিক্ষা। উভয় পক্ষের আমৃত্যু সম্মান রক্ষার দায়। 

 

ভালোবাসা বসন্তের দখিনা বাতাস। সন্ধ্যেবেলা জানলা বন্ধ করতে যাওয়ার আগে যার ছোঁয়ায় হাজার প্রজাপতি উড়ে যায় মনের গহীনে। মনে হয় পৃথিবীটা খুব সুন্দর হতে পারে।


কেয়া চ্যাটার্জী

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

অনুগল্প

প্রতিঘাত
কেয়া চ্যাটার্জী


অজিতের নিথর শরীরটার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে পূর্বা। একবছরের বিবাহিত জীবনে সমাপ্তি ঘটল। পাশে দাঁড়ানো অফিসার তাঁর মহিলা সহকর্মীকে ইশারায় উঠিয়ে নিয়ে যেতে বললেন পূর্বাকে। শেখর চিৎকার করে বলে উঠল, “না না অফিসার বৌদিকে নিয়ে যাবেন না। ও তো জ্ঞানত কিছু করেনি। এর আগেও ও ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেরিয়েছে, কথা বলেছে। আমরা কতো হাসাহাসি করেছি। সকালবেলা কিন্ত ওর কিছু মনে পড়তো না। বিশ্বাস করুন।” অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে মশাই, আপনার কথার ভিত্তিতে কি ওঁকে ছেড়ে দিতে পারি। এত বড় একটা কেস। সরুন তো। আমাদের কাজ করতে দিন।” নিজের স্বামীকে গলা টিপে খুন করার অপরাধে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হলো পূর্বাকে।  জেল হেফাজতে থাকাকালীন ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেল তার সপ্লিট পার্সোনালিটি আছে। ঘুমের মধ্যে সে আলাদা এক মানুষ। জেগে থাকলে সব কিছুই স্বাভাবিক। দীর্ঘ একবছর বিচার চলে। পুলিশ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। পূর্বা আর ফেরেনি শশুর বাড়ি। নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকিয়ে কি লাভ! অন্যায় নিশ্চই করেছে সে। খুন করেছে। একটা মানুষকে মেরে ফেলেছে। শাস্তি পাবে না? কিন্তু মৃত মানুষটা কি নিরপরাধ ছিল? পূর্বার চোখে ভেসে উঠল শ্রীতমার মৃত শরীর। বোকা মেয়েটা ভালোবেসেছিল অজিতকে। কিন্তু অজিতের শরীরে ছিল যৌবনের সর্বগ্রাসী আগুন। সেই আগুনে পুড়ে গেল শ্রীতমার জীবন। সন্তান সম্ভবা মেয়েটাকে অস্বীকার করলো অজিত। তখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই মেয়েটার। পূর্বা অনেক চেষ্টা করেছিল বোঝানোর, রুখে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাতে পারল না শ্রী। পাশে পেল না পরিবারকে। শেষে একদিন গলায় ফাঁস দিয়ে...
 পূর্বা একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিল। অজিতের চোখে মৃত্যুর ভয়টা তাকে তৃপ্তি দেয়। অজিত জেনে গেছে কোন অপরাধে তার এই শাস্তি। তিন বছর ধরে প্ল্যান করে শ্রীর মৃত্যুর দিনটাকেই বেছে নিয়েছিল পূর্বা কাজটা করার জন্য। তার পাশে কি তার পরিবার থাকবে আর?  তার গায়ে যে খুনের প্রলেপ লেগে আছে। হয়তো না, হয়তো  হ্যাঁ। তবে যেটাই হোক প্রতিঘাতটা খুব দরকার ছিল। ভীষণ দরকার ছিল। যেখানে বিচারের হাত পৌঁছয় না, যেখানে প্রতিবাদের শব্দ কড়া নাড়ে না সেখানে প্রতিশোধই একমাত্র উপায়। পূর্বা এগিয়ে চলল নতুন জীবনের পথে, হয়তো একাই।

মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২০

বেলুন


বেলুন
কেয়া_চ্যাটার্জী
দার্জিলিং শহরটা বেশ অদ্ভুত। একদিকে কোলাহল আর একদিকে পাথরের নীরবতা। ঝিলম এই নীরব দিকটাতেই বসে আছে। রেলিঙের ওপারে সুগভীর খাদ। একটু এগোলেই ম্যালের জনবহুল রাস্তা। এখানে পরপর অনেকগুলি হোটেল ও রিসর্ট। তারই মাঝে মাঝে কয়েকটা চওড়া জায়গায় ছাউনি দিয়ে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দুটি নেপালী ভদ্রমহিলা বড় বড় ফ্লাস্কে চা আর কিছু কৌটোয় রকমারি বিস্কুট বিক্রি করছেন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন আঞ্চলিক ভাষায়।
  ঝিলমের ফোনটা বেজে উঠল। আকাশের নম্বর। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে এক কাপ চা নিয়ে ফের চুপচাপ বসলো বেঞ্চে। সূর্য আজকের মতো গোলাপি লাল আভা ছড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রিয়তমা পৃথিবীকে। এই প্রেম পর্বই ভালো। ভালোবাসা থাকে। যেমন ভালোবাসা ছিল আকাশ আর ঝিলমের। পাঁচবছর আগে অবধি।
  একই অফিসে কাজ করার সুবাদে ওদের আলাপ, বন্ধুত্ব, তারপর তা গড়িয়ে বিশেষ এক সম্পর্ক। যেদিন আকাশ অফিসিয়ালি প্রপোস করেছিল সেদিনই ওদের বাড়ি গিয়ে ডেট ফাইনাল করে এসেছিল পাঁজি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। ঝিলমের মা বাবা বেশ হতবাক হয়েছিলেন। পাত্র নিজেই এসে বিয়ের কথা বলছে! দুসপ্তাহ পরে আসেন আকাশের মা বাবা জলপাইগুড়ি থেকে। ছেলের পাগলামী সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত তাঁরা। হেসে বলেছিলেন, “মিয়াঁ বিবি রাজি তো আমরা চার কাজী আর নাক গলিয়ে কি করবো বলুন তো?”
  বিয়ের তিনমাস পর তারা হানিমুন সারতে আসে দার্জিলিং। কিন্তু পাঁচবছর আগের নিখাদ বন্ধুত্বে কেমন একটা ভাঁটা পরে গেছে ইতিমধ্যে। আকাশের অতিরিক্ত প্রাণচ্ছলতা অসহ্য লাগতে শুরু করে ঝিলমের। কথায় কথায় হেসে ওঠা, ভুলে যাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া সব সব অসহ্য ঝিলমের কাছে। আজকেও আকাশের মাথায় বাই চাপলো ঘোড়ায় চড়বে। ঝিলম সাফ না জানিয়ে দিলো, কিন্তু আকাশ টুক করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলল, তুমি ওই বইয়ের দোকানে থাকো, আমি একটু ঘুরে আসি। লেট করবো না প্রমিস। তারপর একঘন্টা কেটে গেলেও আকাশের পাত্তা নেই। ফোন করলেও তুলছে না। মাথা গরম হয়ে উঠল ঝিলমের। ম্যাল ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছুল এই জায়গাটায়। আকাশ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। তোলেনি। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছেলেটাকে।
হঠাৎ একটা গান কানে আসতেই ঝিলম এদিক ওদিক ফিরে দেখল সামনের বেঞ্চে একটি লোক পাহাড়ের দিকে মুখ করে আপন মনে গেয়ে চলেছেন, “আঁখি পানে চেয়ে বলে না..না..না..সে যে মানে না মানা।” কলকাতার বাইরে বাঙালি দেখলে, তার সাথে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে। তার গান শেষ হতে ঝিলম বলে উঠল, কলকাতা? লোকটি পিছন ফিরে চাইল। না লোকটি বাঙালি না বরং গোর্খা। সে হেসে বলল, “না দার্জিলিং।” ঝিলম অবাক হয়ে বলল, “আপনি এতো স্পষ্ট বাংলা বলেন কি করে?” লোকটি আবার একগাল হেসে বলল, “আমার বউ শিখিয়েছে। বউ কিন্তু কলকাতায় থাকত।” ঝিলম বলল, “বিয়ের পর  তাহলে এখানেই থাকে?” লোকটির মুখ একটু ম্লান হলো। বলল, “হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এখানেই থাকে। বরাবরের মতো।” ঝিলম এতক্ষনে দেখল লোকটির হাতে একগোছা লাল নীল বেলুন। পাহাড়ি হাওয়ার দাপটে ভীষণ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ঝিলম হেসে বলল, “কটি ছেলে মেয়ে আপনাদের?” লোকটি এবার বেলুনগুলো দিকে চেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো হেসে উঠে বলল, এ তো আমার বড় বাচ্চার জন্য। আমার বৌএর জন্য। অনেকদিন দেখা হয়নি তো। রাগ করেছে। এই বেলুনগুলো দেখলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে, আমি জানি।” একটু থেমে আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “আমিও খুব রাগ করতাম। বৌটা একদম সংসারী ছিল না। ভীষণ ছেলে মানুষ। রাঁধতে পারত না, দরকারি কথা ভুলে যেত, কাজের সময় বসে ছবি আঁকত। একদম অগোছালো। ভীষণ রাগ করতাম। বকতাম। ও কাঁদতো। ভাবতাম কাঁদুক, ভুল বুঝে শুধরে যাবে। কিন্তু...”
― কিন্তু?
ঝিলমের প্রশ্নে লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়াল। “আমি যাই ম্যাডাম। দেরী হয়ে গেল। দেরী হলে আবার রাগ বেড়ে যাবে। বেলুনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে ।” এই বলে একগাল হেসে  ঢাল বেয়ে নেমে যেতে লাগল নীচে। ঝিলমের ভীষণ কৌতূহল হলো। সেও লোকটির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। রাজভবন পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে লোকটি একটি ছোট গেট খুলে ঢুকে গেল একটি জঙ্গল ঘেরা স্থানে। ঝিলমও তার পিছু পিছু ঢুকে বুঝতে পারল এটি কবরস্থান। দূরে কিছুটা গাছ গাছালি ঘেরা জায়গায় লোকটি বসে আছে। সামনের একটি বেদীতে বাঁধা সেই লাল নীল বেলুন গুলি। লোকটি আপন মনে গল্প করছে তার স্ত্রীর সাথে। তার চিরকালের অভিমানী প্রেমিকা।
চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। ঝিলম ছিটকে বেরিয়ে এলো ওখানে থেকে। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে গতি বাড়িয়ে দৌড়োতে লাগল। আকাশ কোথায়? তার অগোছালো খামখেয়ালি আকাশ? ওদের হোটেল পেরিয়ে আরো কিছুটা যেতেই পিছন থেকে হাতে টান পড়তে ফিরে দেখল অবাক দৃষ্টিতে আকাশ দাঁড়িয়ে তার সামনে। ঝিলমের চোখে জল দেখে বলল, “ঘোড়াটাকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল জানতো। অবলা প্রাণী কষ্ট পাচ্ছিল। হাসপাতালে গেছিলাম। আমারও একটু হাত পা ছড়ে গেছে।তোমায় কতো বার ফোন করলাম, তুমি কিছুতেই রিসিভ করলে না। আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল জানো?” ঝিলম আঁকড়ে ধরল ওকে। আকাশ জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদছো কেন? ঝিলম অস্ফুটে বলল, কিছু না।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২০

ম্যাজিক

ম্যাজিক
কেয়া চ্যাটার্জী

গিলি গিলি ছূ, আবরা কা ডাবরা....
হাততালিতে ফেটে পড়ল প্যান্ডেল। ছোট ছোট চোখগুলিতে বিস্ময় ঝরে পড়ল। স্টেজে জাদুকর রঙিন পোশাক পরে একের পর এক জাদু দেখিয়ে চলেছে। কখনো ফুল ঝরে পড়ছে, কখনো বা উড়ে যাচ্ছে পায়রা, কখনো কার পকেট থেকে উঁকি মারছে ইঁদুর।
  শো এর শেষে টাকা হাতে পেতে বেশ দেরি হলো সনাতনের। পুজো কর্তারা আরো কিছুক্ষন খেলা দেখাতে বলেছিলেন। কিন্তু সনাতনের সরঞ্জাম যে আর নেই। তাই শাস্তিস্বরূপ....। সঙ্গের ছেলেটির হাতে হাজার টাকা ধরাতেই তার মুখে ফুটে উঠল সব পেয়েছির হাসি। হয়তো ছেলেটির জীবনের প্রথম কামাই। এইসব দৃশ্য মনকে খুব খুশি করে দেয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে খুশিটা কেমন ম্লান হয়ে যায়। বৌমা ছোট নাতিটার পিঠে গরম খুন্তি চেপে ধরে চিৎকার করছে, “খাবি, খাবি? আমায় খা রে শয়তান, আমায় খা।” দূরে বসে আছে ছেলে। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে স্ত্রীয়ের দিকে। সনাতন দ্রুত ছাড়িয়ে নিল বাচ্চাটাকে, “কি করছো কি বৌমা! ছেলেটাকে এই পুজোর দিনে মারবে নাকি?” সরমা ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, “তাই করলে বাঁচবো বাবা। এমন অপগন্ড সোয়ামীর ঘর করার থেকে তো বাঁচবো।” সনাতন তাকালো প্রকাশের দিকে। সে শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বলল, “আজও দিল না।” সনাতন বলল, “দিল না মানে? তুই তো সাতদিন আগে কাজ করেছিস। আজও টাকা দিল না?”
― না। ওই অন্নপ্রাশন বাড়িতে মিকি মাউসের জামা মাথা পরে ঘুরতে বলেছিল। ওতো বড় মাথাটা কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিলাম না। একবার টাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে একজনের গায়ে পরে যাই। একটা প্লেট আর গ্লাস ভাঙে। ওই টাকা কেটে সাতশ টাকা দেবে বলেছিল। কিন্তু আজও দিল না।”
সনাতন ছেলের হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে বলল, “যা ছেলেটার জন্য খাবার নিয়ে আয়।” ছেলে চলে গেলে মনে মনে ঠিক করে নেয় বাকি দেড় হাজারে কি কি হিসেব মেটানো বাকি। নাতিটা মাটিতে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ঠিক তার ওপরে দেওয়ালে ঝুলছে স্ত্রী মিনতির মালা পড়া ছবি। সনাতন বাক্স থেকে বের করে জাদুকরের পাগড়ি আর পোশাক। নাতির সামনে হঠাৎ বলে ওঠে, “এই দেখো দেখো, জাদু দেখো। ম্যাজিক, ম্যাজিক, ম্যাজিক। আমি পি.সি.সরকারের চেলা। অন্ধকারে সূর্য দেখাই, দিনের বেলা তারা, মরুভূমিতে ফুল ফোটাবে এই সরকার বাবুর চেলা।” প্লাস্টিকের ফুল ঝরে পড়ল ছোট্ট শরীর জুড়ে। হাসি ফুটে উঠল খিলখিলিয়ে। ক্ষিদের ব্যথা ভুলে সে মেতে উঠল দাদুর জাদুর খেলায়। সরমা নিভৃতে চোখ মুছে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ম্যাজিশিয়ানের দিকে। এই বুড়ো মানুষটার পোড়া জীবনে একটা ম্যাজিক ভীষণ দরকার।

রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২০

বিয়ে বাড়ির গপ্পো


বিয়ের মরসুম চলছে। তাই স্মৃতি হাতড়ে কিছু বিয়ের গল্প বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আসলে গল্প তো না, স্মৃতি রোমন্থন।

বাড়ির সব থেকে ছোট হওয়ার সুবাদে আমি আমার ছোটবেলায় তিন দিদির বিয়ে দেখেছি। নব্বই দশকে পাড়ায় কোনো বাড়িতে বিয়ে লাগলে সেই অনুষ্ঠান শুধু সেই বাড়িতেই আটকে থাকত না, গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তো। বাড়ির সামনে ডেকোরেটর এনে প্যান্ডেল টাঙানো হতো। এখনকার মতো বাহারি ফুল, কাপড় সাজানো প্যান্ডেল না, লাল-হলুদ-সাদা কম্বিনেশনের কাপড়। গেটে বসতো একটি বৃহৎ প্রজাপতি, পাত্র-পাত্রীর নাম লেখা থাকত বাংলায়। সকাল থেকে সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙতো। সূর্য ওঠার আগে মা-জেঠিমা আর পাড়ার অন্যান্য কাকিমারা যেতেন জল সইতে। গঙ্গা দেবীকে নিমন্ত্রন করে আসতেন। তারপর হতো খই দই খাওয়ার পর্ব। সে সব পর্ব যদিও আমি দেখিনি। ঘুম থেকেই উঠতাম না। সকালের নানা পর্ব তো বড়দের ব্যাপার। সেসব আমাদের পোষাত না। বিয়ে  মানেই তো খাওয়া-দাওয়া তাই আমরা নজর রাখতাম হেঁসেলের দিকে। সকালবেলা লুচি আর সাদা আলুর তরকারি দিয়ে সারা হতো প্রাতঃরাশ। আহা! সে কি স্বাদ সেই আলু চচ্চড়ির। দুপুর হতেই গন্ধ আসত মাছের কালিয়ার। ততক্ষণে পাড়ার দাদারা আর দাদাদের বন্ধুরা কোমরে গামছা বেঁধে শুরু করে দিত পরিবেশনের আয়োজন। কাঠের লম্বা টেবিল তার সামনে সারি দিয়ে বসানো হতো কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। সেই চেয়ারে বসা একটু বিপদজনক ছিল বটে। বেশ কয়েকবার কব্জায় হাত রেখে আঙুলে চাপা খেয়েছি। তা সে যাইহোক, ছোট হওয়ার একটা সুবিধা ছিল, কোনো কাজ দেওয়া হতো না। উল্টে তাড়াতাড়ি খেতে বসিয়ে দেওয়া হতো। শালপাতার থালা আর মাটির গ্লাস। সেই গ্লাসে জল ঢাললে একটা অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ পেতাম। নুন লেবুর পর এল গরম ভাত আর ঘি , তারপর বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, ঝুরি ঝুরি আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ঝাল ঝাল শুকনো আলুপোস্ত, সেই পোস্ত গা বেয়ে গড়িয়ে পরতো লালচে হলুদ সর্ষে তেল আর শেষে মাছের কালিয়া, টমেটোর চাটনি।
 এরই মাঝে মন খারাপের সুর বাজত ভিতর ঘরে। দিদিকে সাজাতে আসত কোনো এক বিউটিশিয়ান বান্ধবী বা তার পার্লারের কর্মী। সাজার আগে একপ্রস্থ কান্নাকাটি মাস্ট। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। জেঠু বাবা ভীষণ গম্ভীর হয়ে কাজে ব্যস্ত, যতই হোক, মর্দ কো দর্দ মানায় না। আমি বরাবরই ভ্যাবলা গোবিন্দ টাইপ। দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখতাম সবার কান্না। ছোড়দির বিয়ের সময়, আমার থেকে তিন বছরের ছোট বোনপো এসে বলল, ও মাম্পি মাসি তুমি কাঁদবে না? (যেন না কাঁদলে ঠাকুর পাপ দেবে) আমি বললাম, কাঁদবো কেন? সে বলল, পুচি মাসি তো কাল থেকে আর আসবে না।
 কথাটা তখন মাথায় ঢোকেনি। বাচ্চা ছেলের কথায় পাত্তাও দিইনি। তখন মনে মনে জল্পনা রাতে কি হবে। এর মাঝে নিমপাতার মতো একটা দুপুরের অপরিহার্য ঘুমের ব্যবস্থা করা হতো। ফলে দূরদূরান্ত থেকে যত কাছাকাছি বয়সের দিদি ভাই বোনপো বোনঝি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হতো।
  সন্ধ্যে বেলা একবার ঢুঁ মারতাম দিদির ঘরে। সেই দুপুর থেকে সাজতে বসেছে। সন্ধ্যে বেলাও ফাইনাল টাচ বাকি। মাথা চুলকে ভাবতাম, দেখতে তো ভালোই এত সাজের কি আছে বাপু। ঘরের পিছনে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লুচি ভাজা। তখন এত শত স্টার্টার মকটেল ছিল না। বরযাত্রীর হাতে দেওয়া হতো লুচি,তরকারি আর মিষ্টির প্যাকেট। অন্যান্য অতিথিরা খেতেন চা বা শরবত। এই শরবত ব্যাপারটা বেশ লোভনীয় ছিল। একটা বিশাল এলুমিনিয়ামের ড্রামে লিটার লিটার জলে ঢালা হতো প্যাকেট প্যাকেট রসনা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই যে i love you Rasa, সেই রসনা। দেখে তো চোখ চকচক, জিভ লকলক। বাবার মামাতো ভাই একটা জগ হাতে সেই রসনা ঘুটছেন আর গ্লাসে ঢেলে অতিথিদের জন্য রেডি করছেন। পাড়ার দাদারা সার্ভ করছে। জনা পাঁচেক বাচ্চাপার্টি দু তিনবার ঘুর ঘুর করে সুযোগ বুঝে ঝুলে পড়লাম, ও ভোলা কা রসনা দাও না গো। সে চোখ পাকিয়ে বলে দিল, বরযাত্রী না এলে কিচ্ছু পাবি না। যে খেল গিয়ে।
  কি ভীষণ অপমান! সবার মুখ ভার। মনে মনে ভাবলাম, কবে যে দাদাগুলো বিয়ে করবে আর আমরা বরযাত্রী হয়ে একটু খাতির পাবো। বর বা জামাইবাবু আসার সময়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। সবাই ছুটে যায় বর এসেছে এসেছে। তাদের বর দেখার আগ্রহে এই ছোট্ট শরীর গলিয়ে কোনোদিনও জামাই বরণ দেখতে পেলাম না। বরযাত্রীর হাতে হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভার পড়ে গেলে তো ব্যস্ততার শেষ নেই। দিদির বিয়েতে আমরাও কিছু কাজ করেছি। যা হোক তেড়ে খেলার ফলে ক্ষিদে পেয়ে যেত জবর। ফার্স্ট ব্যাচে দূরের অতিথিদের একাধিপত্ব। তারা খেয়েই বেরিয়ে যাবেন। ততক্ষণে বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। দাউদাউ আগুনের সামনে দুই পাঁঠ...থুড়ি পাত্র পাত্রী হাফ সিরিয়াস হয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ছে। আমরা কজন ফাঁক ফোকর গলে পাশে দাঁড়িয়ে পরতাম, ছবি উঠবে যে। একবার ফ্লাস হয়ে গেলে কি আর বাদ দিতে পারবে? হিঃহিঃহিঃ।
 এবার রাতের খাওয়ার পালা। লুচি, ছোলার ডাল, বাঁকা বাঁকা ফিস ফ্রাই, ভাত, মুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, ধোঁকার ডালনা, মাছ, খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি, দই, পান। শালপাতাটা অনুগ্রহ করে চেবাবেন না। এখানেও কিন্তু একটা হালকা পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টভাবে চোখে পড়তো। যে দিদি বা পিসি একটু বেশি সুন্দরী, সে না খেতে পারলেও তার পাতেই খাবার গুলো বেশি বেশি করে পড়ত।কেন যে দাদারা তাদের সামনেই বেশি ঘুরঘুর করতো কে জানে বাবা! তারপর? তারপর আর কি, চোখ ঢুলু ঢুলু। সিঁদুর দান শেষ হতে ঘুম। বাসর ব্যাপারটা কি কোনোদিনও বুঝিনি। এই বাসরে নাকি ভালো ভালো গান হয়, দুস্টু মুসটু ইয়ার্কি হয়। হলে হয়, ঘুমের থেকে ভালো কিছু হয় নাকি! আমার বিয়ের বাসর রাত জেগেছিল আমার বোনপো, বোনঝি আর সবেধন নীলমনি একমাত্র বৌদি। ফলে সেই যে একটা মিথিকাল বিবাহ বাসর আমার দেখা হয়নি এখনও।
  যাকগে, বিয়ে শেষ। বিয়ের গল্পও শেষ। বৌভাত তো অন্যরকম। যে দিদি আগের দিন কেঁদে ভাসায় সেই পরের দিন বাপের বাড়ির সকলকে অভ্যর্থনা করে। কি অদ্ভুত না? সব ভালোর শেষে যখন স্কুল থেকে ফিরে জেঠুর বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়াতাম ঘরটা খাঁ খাঁ করতো। জমজমাট বাড়িটা নিমেষে ফাঁকা। বুম্বার কথাটা কানে এসে লাগত, দিদিকে তো রোজ রোজ আর দেখতে পাবো না।

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা #কেয়া_চ্যাটার্জি প্যারিস পর্ব • #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস...