#ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা
#কেয়া_চ্যাটার্জি
প্যারিস পর্ব
• #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে
১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস্তার লাভ করেনি তখন শহরের পশ্চিমাংশ শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ তৈরি করেন একটি দুর্গ। দুর্গটির নাম ল্যুভর। পরবর্তীকালে, আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা প্রথম ফ্র্যান্সিস এই দুর্গকে একেবারে ভেঙে ফেলে রেনেসাঁ স্টাইলের নতুন একটি প্রাসাদ তৈরি করেন যা রাজবংশীদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথম ফ্র্যান্সিস যেমন একাধারে ছিলেন সুশাসক তেমনি ছিলেন শিল্প সংগ্রাহক। তিনি এই প্রাসাদে মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিসহ বহু বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবি ও মূর্তি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ‘মোনালিসা’। প্রথম ফ্র্যান্সিসের পরে দ্বিতীয় হেনরি ও নবম চার্লসের আমলেও এই প্রাসাদের অনেকগুলি অংশ নির্মাণ ও পুনর্নির্মিত হয়। তবে ল্যুভর প্রাসাদ গড়ে ওঠার নেপথ্যে রাজা ত্রয়োদশ লুই ও রাজা ষোড়শ লুইয়ের অবদান সবথেকে বেশি।
১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য ষোড়শ লুই রাজপ্রাসাদ ল্যুভর থেকে ভেরসিলিতে স্থানান্তরিত করেন। তখন এই প্রাসাদটি একাধারে আর্ট মিউজিয়াম এবং অন্যদিকে শিল্পীদের স্টুডিও ও বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয় গঠনগত কিছু কাজের জন্য। আবার নতুনভাবে খোলা হয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে নেপলিয়নের রাজত্বকালে। নেপলিয়ন নানা দেশ জয় করে ফেরার সময় সেখানকার শিল্প কর্মগুলি লুঠ করে নিয়ে আসতেন। সেই লুঠ করা জিনিসের অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া হলেও, থেকে যায় আরও অনেক কিছু। ল্যুভর মিউজিয়ামে আজও অবস্থিত ইজিপ্টের বহু হাতের কাজ ও শিল্পকর্মের নিদর্শনগুলি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ল্যুভরের প্রচুর শিল্পকর্ম লুকিয়ে রাখা হয় নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তা সত্ত্বেও নাৎসিরা এই প্রাসাদ নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য খুলে নেয়। বহু বছর পরে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেঞ্চ সরকার এই প্রসাদটিকে সম্পূর্ণরূপে একটি মিউজিয়াম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে ল্যুভর মিউজিয়ামের ৬৫২,৩০০ স্কোয়ার ফিট জমিতে প্রায় ২০০ জন শিল্পীর ৩৫০০০ শিল্পকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগ পর্যটক আসেন শুধুমাত্র ‘মোনালিসা’কে দেখতে। ইতালিয় চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে দেহাবসান হলে তাঁর আঁকা এই ছবিটি যা প্রথম ফ্র্যান্সিস অনেক আগেই কিনে নিয়েছিলেন ল্যুভরের দেওয়ালে সাজিয়ে রাখেন। নেপোলিয়ন এটিকে নিয়ে যান নিজের শয়ন কক্ষে। ফ্রাঙ্কো প্রাশিয়ান যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটিকে লুকিয়ে রাখা হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চুরি হয় মোনা লিসা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরুদ্ধারের পরে আবার ছবিটি শোভা পায় ল্যুভরের দেওয়ালে।
ল্যুভরের এই ইতিহাস জানা যায় মিউজিয়ামের অডিও গাইডের মাধ্যমে। এছাড়াও, মিউজিয়ামের নিজস্ব ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট, ইতিহাস বইয়ের পাতা তো আছেই।
ল্যুভর দেখতে হলে প্রথমেই আপনাকে একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করতে হবে। সেই নির্দিষ্ট দিনের জন্য টিকিট কাটতে হবে। তবে টিকিট কাটার একটি বিশেষ নিয়ম আছে। আপনাকে অনলাইন টিকিট কাটতে হবে গুনে গুনে ষাট দিন আগে। মানে ধরুন, আপনি যাবেন ১০ই জানুয়ারি। আপনাকে কিন্তু টিকিট কাটতে হবে সেইদিনের ৬০ দিন আগে। আঠারো বছর বা তার উপরে যাদের বয়স অনলাইন টিকিট কাটতে তাদের খরচ ১৭ ইউরো, অফলাইনে ১৫ ইউরো (সাথে ঘণ্টা দুই-তিন লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ফ্রি।) আঠারো বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের এন্ট্রি ফ্রি। মূল্য দিতে না হলেও টিকিট কিন্তু কাটতে হবে। আপনি যদি ইওরোপিয়ান নাগরিক হন তাহলে ১৮-২৫ বছর বয়সীদের জন্য মিউজিয়াম এন্ট্রি ফ্রি। এছাড়াও, একটা লম্বা লিস্ট রয়েছে www.louvre.fr ওয়েবসাইটে যেখানে লেখা আছে কাদের কাদের জন্য মিউজিয়ামের অবারিত দ্বার। ধরুন, আপনি শিল্পী বা আর্ট টিচার। আপনার সেই হিসেবে একটি কার্ড আছে। কাউন্টারে সেটি দেখালে আপনাকে মূল্য দিতে হবে না। অথবা আপনি সাংবাদিক। সেক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটবে।
প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবার সন্ধ্যে ছয়টার পরে মিউজিয়ামে সকলে বিনামুল্যে প্রবেশ করতে পারেন। এই নিয়মটি অবশ্য জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রযোজ্য নয়। তখন তো সিজন টাইম। তবে ১৪ই জুলাই মিউজিয়ামে প্রবেশ করা যায় বিনামূল্যে। সকাল সাড়ে নটা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা অবধি খোলা থাকে ল্যুভর। বন্ধ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগেই দর্শনার্থীদের বাইরে বের করার প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়।
এবার একটা ছোট্ট টিপস (হালকা লিপস্টিক) দিয়ে যাই। ফ্রান্স ভারতের থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। শীতকালে সেটি দাঁড়ায় সাড়ে চার ঘণ্টায়। অনলাইন পোর্টাল চালু হয় রাত বারোটায়। তবে আমাদের দেশের রাত বারোটা নয়, ওদের সময়ের রাত বারোটা ধরেই কিন্তু আপনাকে সমস্ত ব্যবস্থা নিয়ে রেডি থাকতে হবে। টিকিটে টাইম স্লট উল্লেখ করতেই হবে। প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর টাইম থাকে। আমাদের টাইম ছিল সাড়ে চারটে। তবে গিয়ে যা বুঝলাম টাইম স্লট ব্যাপারটাকে এরা খুব একটা পাত্তা দেয় না। আপনার ভ্যালিড টিকিট থাকলেই হল। মোট কথা, এখানে যখন রাত সাড়ে তিনটে বা ভোর সাড়ে চারটে তখন ওখানে সবে মধ্যরাত। আপনাকে সেই সময় টিকিট কাটলে সহজে পেয়ে যাবেন। আইফেল টাওয়ারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। আমি কী বোঝাতে পারলাম ব্যাপারটা? ভূগোলে আমি বড়ই কাঁচা। এবার ধরুন আপনি এত কষ্ট করতে চাইছেন না। সেক্ষেত্রেও সমাধান রয়েছে। ইন্টারনেট ঘাটলেই পেয়ে যাবেন বেশ কিছু সংস্থার সন্ধান যারা আপনার জন্য টিকিট কেটে দেবেন এবং গাউডেড ট্যুরও দেবেন। সেক্ষত্রে টিকিটের মূল্য স্বভাবতই বেশি হবে। এছাড়া রয়েছে 'প্যারিস মিউজিয়াম পাস'। এই টিকিটের দ্বারা আপনি প্যারিসের সমস্ত মিউজিয়ামে প্রবেশের অধিকার পেয়ে যাবেন।
মিউজিয়ামের মোট চারটি ফ্লোর। কিন্তু ম্যাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেও বা মিউজিয়ামের কর্মীদের বারংবার জিজ্ঞাসা করলেও আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য। এ বিশাল ভুলভুলাইয়া! অবশেষে ইজিপ্ট, রোম, ইতালি ঘুরে আমরা মোনালিসার দেখা পেয়েছি। তাকে দেখতে গিয়ে অবাক হলাম একটা বিষয় দেখে – খ্যাতির কি বিড়ম্বনা! একটা একহাতের ছবির সামনে শ্রীভূমি মার্কা ভিড়। এদিকে ঠিক পিছনেই দেওয়াল জোড়া বিশাল বিশাল বিস্ময় জাগানো পেন্টিংয়ের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না।
যাইহোক, আরও বেশ কয়েকটি ঘর ঘুরে মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে। লাগোয়া একটি সুদৃশ্য ক্যাফেতে বসে হট চকোলেট খেতে খেতে কাঁচের পিরামিডটিকে আলোকিত হতে দেখলাম। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ কিন্তু প্রয়োজন বুঝলে একদিন বা দু’দিনের জন্য গোটা মিউজিয়াম বন্ধ রেখে দিতে পারেন। কখনও কখনও কয়েকটি বিশেষ ঘরও পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে না। আমরা যখন গেছিলাম তখন মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধ তুঙ্গে। বেশ চাপেই ছিলাম। কারণ ফ্রান্সেও এই যুদ্ধের আঁচ পরেছে। জায়গায় জায়গায় দেখেছি প্যালেস্তাইনকে সাপোর্ট করে দলে দলে লোকজনকে পতাকা, প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে, সভা করতে।
বাইরে বেরিয়েই আমাদের ছেলে লাফিয়ে উঠল। ওর বিস্মিত চোখ অনুসরণ করে দেখলাম সামনেই জ্বলজ্বল করছে দি আইফেল টাওয়ার। বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার দাপটে তখন দাঁত কপাটি লাগলেও আইফেল টাওয়ারকে রাতের অন্ধকারে দেখার আনন্দে সেই কষ্ট নিমেষে ভুলে গেলাম। সামনেই দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি রিক্সার মতো দেখতে যান। ফেসবুক গ্রুপের কল্যানে জেনেই ফেলেছিলাম এগুলিকে বলা হয়, “টুকটুক”। রিক্সা ও অটোর কম্বিনেশনে তৈরি নতুন যান চড়ার ঝোঁক উঠল। শুরু হল দরদাম। চালক প্রথমেই হাঁকল আশি ইউরো। সেটিকে কমিয়ে কমিয়ে নামানো হল পঁয়ষট্টিতে। সিয়েন রিভারের ধার ঘেঁষে, পার্লামেন্টের পাশ দিয়ে, ব্রিজ টপকে, বিখ্যাত চ্যাম্প ইলিসেস ধরে পৌঁছলাম আর্ক দে ত্রায়াম্ফের সামনে। চালক বেশ অমায়িক। আগ বাড়িয়ে ছবি তুলে দিলেন আমাদের। এবার গাড়ি গড়াল আইফেল টাওয়ারের দিকে। রাতের অন্ধকারের সোনালী টাওয়ার জেট ল্যাগ, ক্লান্তি - সব ভুলিয়ে দিল।
টুকটুক চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকেই ওয়াইফাই ধার নিয়ে বুক করে নিলাম উবের। প্যারিসের মেট্রো পরিষেবা খুবই ভালো। এছাড়াও পর্যটক থেকে সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, ইলেকট্রিক স্কুটারে, আরও নানা ধরনের স্কেট বোর্ডে চেপে যাতায়াত করতেই পছন্দ করেন। তবে আমরা প্রথম দিনেই মেট্রো চাপতে একটু দ্বিধা বোধ করলাম। সুখ্যাতির পাশাপাশি চোর ছ্যাঁচড় সম্বলিত মেট্রো লাইনের কুখ্যাতিও আছে। উবের ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও দুটি ক্যাব পরিষেবা G7 ও Bolt । এছাড়াও ট্যাক্সি তো রয়েছেই। আমরা প্রধানত ট্যাক্সি আর উবেরের উপরেই বেশি ভরসা করেছি।
ক্রমশ…








