সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা

#কেয়া_চ্যাটার্জি

প্যারিস পর্ব


• #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে








১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস্তার লাভ করেনি তখন শহরের পশ্চিমাংশ শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ তৈরি করেন একটি দুর্গ। দুর্গটির নাম ল্যুভর। পরবর্তীকালে, আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা প্রথম ফ্র্যান্সিস এই দুর্গকে একেবারে ভেঙে ফেলে রেনেসাঁ স্টাইলের নতুন একটি প্রাসাদ তৈরি করেন যা রাজবংশীদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথম ফ্র্যান্সিস যেমন একাধারে ছিলেন সুশাসক তেমনি ছিলেন শিল্প সংগ্রাহক। তিনি এই প্রাসাদে মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিসহ বহু বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবি ও মূর্তি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ‘মোনালিসা’। প্রথম ফ্র্যান্সিসের পরে দ্বিতীয় হেনরি ও নবম চার্লসের আমলেও এই প্রাসাদের অনেকগুলি অংশ নির্মাণ ও পুনর্নির্মিত হয়। তবে ল্যুভর প্রাসাদ গড়ে ওঠার নেপথ্যে রাজা ত্রয়োদশ লুই ও রাজা ষোড়শ লুইয়ের অবদান সবথেকে বেশি। 

  ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য ষোড়শ লুই রাজপ্রাসাদ ল্যুভর থেকে ভেরসিলিতে স্থানান্তরিত করেন। তখন এই প্রাসাদটি একাধারে আর্ট মিউজিয়াম এবং অন্যদিকে শিল্পীদের স্টুডিও ও বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয় গঠনগত কিছু কাজের জন্য। আবার নতুনভাবে খোলা হয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে নেপলিয়নের রাজত্বকালে। নেপলিয়ন নানা দেশ জয় করে ফেরার সময় সেখানকার শিল্প কর্মগুলি লুঠ করে নিয়ে আসতেন। সেই লুঠ করা জিনিসের অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া হলেও, থেকে যায় আরও অনেক কিছু। ল্যুভর মিউজিয়ামে আজও অবস্থিত ইজিপ্টের বহু হাতের কাজ ও শিল্পকর্মের নিদর্শনগুলি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ল্যুভরের প্রচুর শিল্পকর্ম লুকিয়ে রাখা হয় নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তা সত্ত্বেও নাৎসিরা এই প্রাসাদ নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য খুলে নেয়। বহু বছর পরে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেঞ্চ সরকার এই প্রসাদটিকে সম্পূর্ণরূপে একটি মিউজিয়াম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে ল্যুভর মিউজিয়ামের ৬৫২,৩০০ স্কোয়ার ফিট জমিতে প্রায় ২০০ জন শিল্পীর ৩৫০০০ শিল্পকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগ পর্যটক আসেন শুধুমাত্র ‘মোনালিসা’কে দেখতে। ইতালিয় চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে দেহাবসান হলে তাঁর আঁকা এই ছবিটি যা প্রথম ফ্র্যান্সিস অনেক আগেই কিনে নিয়েছিলেন ল্যুভরের দেওয়ালে সাজিয়ে রাখেন। নেপোলিয়ন এটিকে নিয়ে যান নিজের শয়ন কক্ষে। ফ্রাঙ্কো প্রাশিয়ান যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটিকে লুকিয়ে রাখা হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চুরি হয় মোনা লিসা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরুদ্ধারের পরে আবার ছবিটি শোভা পায় ল্যুভরের দেওয়ালে। 

  ল্যুভরের এই ইতিহাস জানা যায় মিউজিয়ামের অডিও গাইডের মাধ্যমে। এছাড়াও, মিউজিয়ামের নিজস্ব ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট, ইতিহাস বইয়ের পাতা তো আছেই। 

  ল্যুভর দেখতে হলে প্রথমেই আপনাকে একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করতে হবে। সেই নির্দিষ্ট দিনের জন্য টিকিট কাটতে হবে। তবে টিকিট কাটার একটি বিশেষ নিয়ম আছে। আপনাকে অনলাইন টিকিট কাটতে হবে গুনে গুনে ষাট দিন আগে। মানে ধরুন, আপনি যাবেন ১০ই জানুয়ারি। আপনাকে কিন্তু টিকিট কাটতে হবে সেইদিনের ৬০ দিন আগে। আঠারো বছর বা তার উপরে যাদের বয়স অনলাইন টিকিট কাটতে তাদের খরচ ১৭ ইউরো, অফলাইনে ১৫ ইউরো (সাথে ঘণ্টা দুই-তিন লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ফ্রি।) আঠারো বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের এন্ট্রি ফ্রি। মূল্য দিতে না হলেও টিকিট কিন্তু কাটতে হবে। আপনি যদি ইওরোপিয়ান নাগরিক হন তাহলে ১৮-২৫ বছর বয়সীদের জন্য মিউজিয়াম এন্ট্রি ফ্রি। এছাড়াও, একটা লম্বা লিস্ট রয়েছে www.louvre.fr ওয়েবসাইটে যেখানে লেখা আছে কাদের কাদের জন্য মিউজিয়ামের অবারিত দ্বার। ধরুন, আপনি শিল্পী বা আর্ট টিচার। আপনার সেই হিসেবে একটি কার্ড আছে। কাউন্টারে সেটি দেখালে আপনাকে মূল্য দিতে হবে না। অথবা আপনি সাংবাদিক। সেক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটবে। 

  প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবার সন্ধ্যে ছয়টার পরে মিউজিয়ামে সকলে বিনামুল্যে প্রবেশ করতে পারেন। এই নিয়মটি অবশ্য জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রযোজ্য নয়। তখন তো সিজন টাইম। তবে ১৪ই জুলাই মিউজিয়ামে প্রবেশ করা যায় বিনামূল্যে। সকাল সাড়ে নটা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা অবধি খোলা থাকে ল্যুভর। বন্ধ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগেই দর্শনার্থীদের বাইরে বের করার প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়।

  এবার একটা ছোট্ট টিপস (হালকা লিপস্টিক) দিয়ে যাই। ফ্রান্স ভারতের থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। শীতকালে সেটি দাঁড়ায় সাড়ে চার ঘণ্টায়। অনলাইন পোর্টাল চালু হয় রাত বারোটায়। তবে আমাদের দেশের রাত বারোটা নয়, ওদের সময়ের রাত বারোটা ধরেই কিন্তু আপনাকে সমস্ত ব্যবস্থা নিয়ে রেডি থাকতে হবে। টিকিটে টাইম স্লট উল্লেখ করতেই হবে। প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর টাইম থাকে। আমাদের টাইম ছিল সাড়ে চারটে। তবে গিয়ে যা বুঝলাম টাইম স্লট ব্যাপারটাকে এরা খুব একটা পাত্তা দেয় না। আপনার ভ্যালিড টিকিট থাকলেই হল। মোট কথা, এখানে যখন রাত সাড়ে তিনটে বা ভোর সাড়ে চারটে তখন ওখানে সবে মধ্যরাত। আপনাকে সেই সময় টিকিট কাটলে সহজে পেয়ে যাবেন। আইফেল টাওয়ারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। আমি কী বোঝাতে পারলাম ব্যাপারটা? ভূগোলে আমি বড়ই কাঁচা।  এবার ধরুন আপনি এত কষ্ট করতে চাইছেন না। সেক্ষেত্রেও সমাধান রয়েছে। ইন্টারনেট ঘাটলেই পেয়ে যাবেন বেশ কিছু সংস্থার সন্ধান যারা আপনার জন্য টিকিট কেটে দেবেন এবং গাউডেড ট্যুরও দেবেন।  সেক্ষত্রে টিকিটের মূল্য স্বভাবতই বেশি হবে। এছাড়া রয়েছে 'প্যারিস মিউজিয়াম পাস'। এই টিকিটের দ্বারা আপনি প্যারিসের সমস্ত মিউজিয়ামে প্রবেশের অধিকার পেয়ে যাবেন।

    মিউজিয়ামের মোট চারটি ফ্লোর। কিন্তু ম্যাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেও বা মিউজিয়ামের কর্মীদের বারংবার জিজ্ঞাসা করলেও আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য। এ বিশাল ভুলভুলাইয়া! অবশেষে ইজিপ্ট, রোম, ইতালি ঘুরে আমরা মোনালিসার দেখা পেয়েছি। তাকে দেখতে গিয়ে অবাক হলাম একটা বিষয় দেখে – খ্যাতির কি বিড়ম্বনা! একটা একহাতের ছবির সামনে শ্রীভূমি মার্কা ভিড়। এদিকে ঠিক পিছনেই দেওয়াল জোড়া বিশাল বিশাল বিস্ময় জাগানো পেন্টিংয়ের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। 

  যাইহোক, আরও বেশ কয়েকটি ঘর ঘুরে মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে। লাগোয়া একটি সুদৃশ্য ক্যাফেতে বসে হট চকোলেট খেতে খেতে কাঁচের পিরামিডটিকে আলোকিত হতে দেখলাম। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ কিন্তু প্রয়োজন বুঝলে একদিন বা দু’দিনের জন্য গোটা মিউজিয়াম বন্ধ রেখে দিতে পারেন। কখনও কখনও কয়েকটি বিশেষ ঘরও পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে না। আমরা যখন গেছিলাম তখন মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধ তুঙ্গে। বেশ চাপেই ছিলাম। কারণ ফ্রান্সেও এই যুদ্ধের আঁচ পরেছে। জায়গায় জায়গায় দেখেছি প্যালেস্তাইনকে সাপোর্ট করে দলে দলে লোকজনকে পতাকা, প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে, সভা করতে।

  বাইরে বেরিয়েই আমাদের ছেলে লাফিয়ে উঠল। ওর বিস্মিত চোখ অনুসরণ করে দেখলাম সামনেই জ্বলজ্বল করছে দি আইফেল টাওয়ার। বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার দাপটে তখন দাঁত কপাটি লাগলেও আইফেল টাওয়ারকে রাতের অন্ধকারে দেখার আনন্দে সেই কষ্ট নিমেষে ভুলে গেলাম। সামনেই দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি রিক্সার মতো দেখতে যান। ফেসবুক গ্রুপের কল্যানে জেনেই ফেলেছিলাম এগুলিকে বলা হয়, “টুকটুক”। রিক্সা ও অটোর কম্বিনেশনে তৈরি নতুন যান চড়ার ঝোঁক উঠল। শুরু হল দরদাম। চালক প্রথমেই হাঁকল আশি ইউরো। সেটিকে কমিয়ে কমিয়ে নামানো হল পঁয়ষট্টিতে। সিয়েন রিভারের ধার ঘেঁষে, পার্লামেন্টের পাশ দিয়ে, ব্রিজ টপকে, বিখ্যাত চ্যাম্প ইলিসেস ধরে পৌঁছলাম আর্ক দে ত্রায়াম্ফের সামনে। চালক বেশ অমায়িক। আগ বাড়িয়ে ছবি তুলে দিলেন আমাদের। এবার গাড়ি গড়াল আইফেল টাওয়ারের দিকে। রাতের অন্ধকারের সোনালী টাওয়ার জেট ল্যাগ, ক্লান্তি - সব ভুলিয়ে দিল। 

  টুকটুক চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকেই ওয়াইফাই ধার নিয়ে বুক করে নিলাম উবের। প্যারিসের মেট্রো পরিষেবা খুবই ভালো। এছাড়াও পর্যটক থেকে সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, ইলেকট্রিক স্কুটারে, আরও নানা ধরনের স্কেট বোর্ডে চেপে যাতায়াত করতেই  পছন্দ করেন। তবে আমরা প্রথম দিনেই মেট্রো চাপতে একটু দ্বিধা বোধ করলাম। সুখ্যাতির পাশাপাশি চোর ছ্যাঁচড় সম্বলিত মেট্রো লাইনের কুখ্যাতিও আছে। উবের ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও দুটি ক্যাব পরিষেবা G7 ও Bolt । এছাড়াও ট্যাক্সি তো রয়েছেই। আমরা প্রধানত ট্যাক্সি আর উবেরের উপরেই বেশি ভরসা করেছি। 

ক্রমশ…

শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৩

ঘরকুনোর বিদেশ যাত্রা

 ঘরকুণোর বিদেশ যাত্রা

কেয়া চ্যাটার্জি

প্যারিস পর্ব


পর্ব - প্যারিসিয়ান সংসার 

আগেই বলেছি ফ্লাইট যখন ল্যান্ড করেছে তখন প্যারিসের ঘড়ি অনুযায়ী সময় সকাল আটটা। কিন্তু কাঁচ ঘেরা এয়ারপোর্টের ভিতর থেকেই দেখে বুঝতে পারছিলাম ফ্রান্স তখন সদ্য ফোটা ভোরের আলো মাখছে। প্রাচ্যে যে ঋতু শরৎ ও হেমন্ত, পাশ্চাত্যে সেই ঋতুই ‘autumn বা falls season’। শীত পড়ার আগের পূর্বাভাস। পাতা ঝরার মরশুম। এই সময় সকাল শুরু হয় দেরি করে। সন্ধ্যেও নেমে যায় সাড়ে ছটার মধ্যে। সেদিন ভোরের প্যারিস আমাদের মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালো।

বাইরে বেরিয়ে একটি মিনি ভ্যান বুক করে আমরা পাড়ি দিলাম মালাকফের উদ্দেশ্যে। যদিও মিনি ভ্যান বুক করা উদ্দেশ্য ছিল না আমাদের। লাগেজের তুলনায় একটু বেশি বড় গাড়ি হয়ে গেছিল। কিন্তু সেই সময় সাধারণ সিদান গাড়ি সেখানে না পাওয়ায় এবং দীর্ঘ ফ্লাইট জার্নির পরে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছে না করায় আমারা বাধ্য হয়েই গাড়িটি নিই। ফলে গাড়ি ভাড়াও সামান্য বেশি লাগে। বলে রাখি, দরদাম কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের দেশেই চলে তা নয়। আপনি চাইলে কি না সম্ভব? গাড়ী চলতে শুরু করার পরে চালক মালাকফ পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেয়ে বসল ৯৫ ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় নয় হাজারের কাছাকাছি। গাড়ি চলমান অবস্থাতেই আমরা সেটিকে টেনেটুনে ৮৫ ইউরোতে নামাতে পেরেছি। অবশ্যই অন্তত বিনয়ের সঙ্গেই দরদাম করতে হয়েছে। Attitude দেখিয়েছেন কি গেছেন! ছোট গাড়ি পেলে হয়তো ভাড়া নেমে আসত পঞ্চাশ বা ষাট ইওরোতে। প্রথমদিন, তাই, একটু লোকসান দিয়েই যাত্রা শুরু হল।



  প্যারিস রাজধানী শহর হওয়ায় ভাষার অসুবিধা খুব একটা হয়নি। ফ্রান্সে সবাই ইংরাজি বলতে পারে না। না বলতে পারায় আমাদের মতো হিন্মন্য়তাতেও ভোগে না। তবে চেষ্টা করে বোঝার। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে যাত্রীকে বা নতুন পর্যটককে নিজের বক্তব্য বোঝানোর। তারপর যখন দুপক্ষই নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে অপারগ হয়ে পড়ে তখন ওরা সাহায্য নেয় ট্রান্সলেটারের। প্রসঙ্গত, যাহা আমাদের ম্যাক্সিমাম; তাহা উহাদের মিনিমাম। আমরা আইফোন কেনার জন্য কিডনি বেচার তাল করি, আর ওদিকে আমাদের হৃদয়ে ব্যথা দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার পকেট থেকে ফটাস করে আনল আইফোন (মডেল বৃত্তান্ত জানতে চাইবেন না প্লিজ।)। ফোনের একটি বিশেষ সফটওয়্যারে গিয়ে ফ্রেঞ্চ ভাষায় নানা রকম ফুস ফাস করে এগিয়ে দিল সামনে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইংরাজি বাক্য। এইভাবেই দরদাম সম্পন্ন হল। বাঙালির জয়! রাস্তার যানজট দেখে বুঝলাম শহরে সদ্য ভোর হলেও শহরের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। গাড়ীর সারিতে যোগ দিলাম আমরাও। চললাম মালাকফ। 

  মালাকফ,প্যারিস সিটি সেন্টার থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি টাউন। টাউন শুনে অনেকেই নাক কুঁচকে, হাসতে পারেন। তাই বলে রাখি, এটি ফ্রান্সের একটি ঐতিহাসিক এবং বৃহৎ শহর। তাছাড়া, The European Organisation for Civil Aviation Equipment এই মালাকফেই অবস্থিত।  এখানেই বুক করা হয়েছে আমাদের আগামী তিনদিনের সংসার। প্রসঙ্গত, হোটেল নয় বুক করেছি এয়ারবিএনবি। এই এয়ারবিএনবি সম্পর্কে অনেকেই জানেন। আবার অনেকেই জানেন না। Airbnb হল একটি online marketplace যেখানে একটি প্রপার্টি ভাড়া দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, নির্দিষ্ট মুল্যের বিনিময়ে। Google playstore থেকে AirBnb app ডাউনলোড করে সাইন আপ করলেই নিজের পছন্দ মতো দেশে, বা নিজের দেশেও পছন্দসই লোকেশান ও মূল্যে এপার্টমেন্ট বুক করে নেওয়া যায়। হোটেলে রুমের ভাড়ার পাশাপাশি, খাওয়া দাওয়ার খরচটাও কিন্তু বিশাল অঙ্কের। বিদেশে এসে বিদেশী খাবার কতটা সহ্য হবে সেই ভেবেই এয়ারবিএনবি নিলাম। তাছাড়া, শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় তিনদিনের ভাড়াও পেয়ে গেলাম বেশ কমের মধ্যেই। তিনদিনের জন্য ২৮০ ইউরো। বড় একটি এপার্টমেন্টে– বাগান, রান্নাঘর, বেডরুম, লিভিং রুম, বাথরুম সহ পেয়ে গেলাম। শুধুমাত্র ঘর নয় সঙ্গে ছিল রান্না করার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মশলাপাতি, ডিশ ওয়াশার, রেফ্রিজেরেটার, ওয়াশিং মেশিন, টিভি, সোফা, দুটি বেড ইত্যাদি। (একটা সম্যক ধারণা পেতে হলে নিচের ইউটিউব লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন আমাদের এপার্টমেন্টের ভিডিওটি। লাইক, সাবস্ক্রাইব ইত্যাদি ইত্যাদি করতে বলছি না কিন্তু।) আমাদের হোস্টের নাম ছিল মার্ক। আমাদের জন্য বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিল তার সহকারি ‘মামাদো’। ইশারায়, অল্প ইংরাজি, কিছুটা স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ মিশিয়ে সে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল কীভাবে কম্বিনেশন লকের মাধ্যমে মেইন গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে হবে। তারপর দেখিয়ে দিল চাবির বাক্স। সেখানেও কম্বিনেশন লক করা। ঠিকঠাক নম্বর মেলাতে পারলেই ঘরের চাবি পাওয়া যাবে হাতে। একে একে সে দেখিয়ে দিল ওভেন, মাইক্রোওয়েভ, রুম হিটার চালানোর পদ্ধতি। 

মামাদোকে বিদায় জানিয়ে আমরা লেগে পড়লাম কাজে। চাল, ডাল, নুন, ঘি, আলু ভাজা, রেডিমেড তরকারি, রেডিমেড বিরিয়ানি, ম্যাগি, পোহা, সুজি – অনেক রেডি টু ইট খাবারই নিয়ে গেছিলাম। ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে একটি উবের বুক করে চললাম বিশ্বের সবথেকে বড় মিউজিয়াম গ্র্যান্ড ল্যুভ দেখতে।


ক্রমশ…


youtube link:


https://youtu.be/r1r_IGu0CxU?si=krbOlsHw1-AUccY0


ঘরকুনোর বিদেশ যাত্রা

 একেবারে নতুন একটা ভ্রমণ মূলক ধারাবাহিক শুরু করলাম আজ। এই লেখার পাশাপাশি চলবে 'ওজন বাড়ান' ধারাবাহিকটিও। তাই ওজন বাড়ানের পাঠকরা হতাশ হবেন না। এই লেখাটি একেবারে নিজের জন্য লেখা। নিজেদের জন্য লেখা। সম্প্রতি ঘুরে এসেছি বিদেশ থেকে। কোনও ট্যুর এজেন্সি ছাড়া, নিজেদের প্রচেষ্টায়। তাও আবার রোড ট্রিপ। সেই অভিজ্ঞতাই সকলের সাথে ভাগ করে নিতে এই লেখা। তাছাড়া, যখন সময়ের ধূলিকণা স্মৃতির আল্ব্যামে জমে উঠবে, যখন ফিকে হয়ে আসবে কোনও এক ঘটনা তখন ফেসবুক মেমোরিতে ফিরে আসবে এই দিনগুলি - বারবার। এটাই জীবনের অন্যতম সম্পদ। আর এই লেখা পড়ে আপনারা যারা ভ্রমণ পিপাসু, তাদের যদি কোনও উপকার হয় তাহলে সেটা আমাদের উপরি পাওনা।  🥰🥰🥰


ঘরকুণোর বিদেশ যাত্রা

কেয়া চ্যাটার্জি

প্যারিস পর্ব





                           ১. প্যারিসে পা 


না, ঠিক ঘরকুনো আমরা নই। বেড়াতে যেতে কে না ভালোবাসে? গতে বাঁধা জীবন থেকে কয়েকদিনের ছুটি। কে না চায়? তবে হ্যাঁ, আমায় অনায়াসে ঘরকুনো হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়। সেজেগুজে বাইরে বেরোতে গেলেই আমার জীবনে বড় ল্যাদ লাগে। যাইহোক, এদিক ওদিকের কথায় মাথা না ঘামিয়ে আসল কথায় সরে আসা যাক। ফোকাস করা যাক কাজের কথায়। দুর্গা পুজোর কলকাতা ফেলে বেড়াতে যেতে মন চায়নি কখনও। কিন্তু এবারে হয়তো জগজ্জননী নিজেই সঙ্গ দিয়েছিলেন আমাদের জগৎ দেখার বাসনা পূরণে। তাই তৃতীয়ার কলকাতা, আলো – রোশনাই, যানজট, পুজোর গান, প্যান্ডেলের ভিড় ছেড়ে কত্তা, গিন্নী আর ছানা- তিনজন মিলে পাড়ি দিলাম ইউরোপের পথে। মূল গন্তব্য প্যারিস, সুইজারল্যান্ড হলেও বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

   কলকাতার নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে আবু ধাবির কানেক্টিং ফ্লাইট ধরলাম। এতিহাদ এয়ারওয়েজ। আমার ও ঋভুর ক্ষেত্রে এই প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। মনে অনেক প্রশ্ন। কিছুটা জড়তাও ছিল। কোনও এজেন্সি ছাড়া নাকি প্রথম বিদেশ ট্যুর সম্ভব নয়। যেদিন থেকে প্ল্যানিং শুরু করেছিলাম সেদিন থেকেই এই কথা আমাদের দুজনের কানের কাছে পাঁচালির মতো আওড়ে গেছে অনেকেই। তাই একটা হালকা মানসিক চাপও ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো? যা যা, যেভাবে ভেবেছি, সব ঠিকঠাক করতে পারব তো? ইমিগ্রেশন নাকি ভারী বিষম বস্তু! অনেকক্ষণ সময় লাগে। অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে সেইসব ঝামেলায় পড়তে হয়নি। সবকিছুই হয়েছে একেবারে মাখনের মতো। 

  ইমিগ্রেশনের পরে হাতে ছিল বেশ কিছুটা সময়। রাত ন’টা পঁচিশে ফ্লাইট থাকলেও নিয়ম অনুযায়ী পৌঁছে গেছিলাম চার ঘণ্টা আগেই। ফলে পেটের ভেতর অদেখা ইঁদুর ঘোরাঘুরি শুরু করে দিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তো পারা যায় না। তাই সময় কাটাতে ঢুকে পড়লাম এয়ারপোর্ট ভিআইপি লাউঞ্জে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড যারা ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা জানেন যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার সাথে সাথে প্রায়োরিটি পাস থাকার ফলে এই ধরনের আন্তর্জাতিক মানের ফুড লাউঞ্জে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। আমাদের কাছে দু’ধরনের প্রায়োরিটি পাস ছিল, তবে আমরা এসবিআই- এর পাস ব্যবহার করি। একে তো তৃতীয়ার সন্ধ্যে তার উপর আগামী কটা দিন কেমন খাবার দাবার পাবো সেই নিয়ে একটু দ্বন্দ্ব তো ছিলই। তাই ডায়েটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুফে মেনু সাজানো হয়েছিল বাংলার ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে। ভাত, সোনা মুগের ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, দই পোনা, বাসন্তি পোলাও, কষা মাংস, চিকেন কারি, পটলের দোলমা, স্যালাড, গন্ধরাজ ঘোল, আম পোড়া সরবত যেমন ছিল তেমন ছিল মটন বিরিয়ানি, রায়তা, দু রকমের চাটনি, নানা রকমের পাঁপড়, চাট কাউন্টারে পাপড়ি চাট। এছাড়াও, নানা রকমের কফি, জুশ, ফল, মিষ্টি, আইস ক্রিম, সফট ও হার্ড ড্রিঙ্কস।

এবার প্লেনে চড়ার পালা। সময় হতেই বোর্ডিং পাস হাতে রেডি হলাম আমরা। এরপর ধীরে ধীরে প্লেনের চাকা গতিবেগ বাড়িয়ে মাটি ছেড়ে আকাশে ভেসে উঠতেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠল। অবশেষে আমাদের যাত্রা হল শুরু।

  আবু ধাবি এয়ারপোর্টে যখন পা রাখলাম তখন মোবাইলের ঘড়িতে সময় রাত একটা। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে টার্মিনাল থ্রি থেকে ছাড়ল প্যারিসগামী বিমান। ততক্ষণে যদিও রাতের ঘুম চটে গেছে। বিমান সেবিকা খাবার পরিবেশন করে গেল। এই রাত তিনটের সময় খাবো কি খাবো না ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ভেসে ওঠা হিন্দি সিনেমা ‘দশবী’ দেখতে দেখতে খেয়েই ফেললাম হিন্দু নন ভেজ মিল। যতই হোক, পাপী পেট আর অভিষেক বচ্চন বলে কথা!

   ঘড়িতে সকাল আটটা। পাইলট জানিয়ে দিলেন আমরা এসে পৌঁছেছি সিটি অফ লাভ প্যারিসে। মুহূর্তে ঘুম উড়ে গেল। ইতিমধ্যে গরম কফি আর চিকেন অমলেট পেটস্থ করা হয়ে গেছে। এবার কেবিন লাগেজ কাঁধে চাপিয়ে গুটি গুটি পায়ে ইমিগ্রেশনের দিকে পা বাড়ানোর পালা। তারপর লাগেজ কালেকশন, ট্যাক্সি বুকিং ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনেছিলাম ফ্রান্সের ইমিগ্রেশন অফিসারেরা নাকি ভীষণ কড়া। কিন্তু কাউন্টারে পৌঁছে আমাদের সেই শোনা কথা যে ভ্রান্ত তার প্রমাণ পেলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার হাসি মুখে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর পাসপোর্টের সঙ্গে একে একে মুখ মিলিয়ে সুইচ টিপে খুলে দিলেন পাশের কাঁচের দরজা। ভেবেছিলাম দু-তিন ঘণ্টা জলাঞ্জলি দিতে হবে শুধুমাত্র এই কাজটিতেই। কিন্তু দেখলাম ঘড়ি ধরে সাত মিনিটে সব কাজ শেষ করে আমরা ব্যাগেজ নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়েই দেখা মিলল সারি সারি ট্যাক্সির লাইনের। তবে এখানে বলে রাখা ভালো বিমান বন্দরের নিজস্ব একটি সরকার অনুমোদিত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই গাড়ি নেওয়া ভালো কারণ বড় শহরে পর্যটকদের সাথে স্ক্যামিং হয় প্রচুর। ট্যাক্সি বুকিঙের আগে চালকের কাছ থেকে এটাও জেনে নিতে হবে যে সে কার্ডে পেমেন্ট নেয় কি না। যাতে পরে ঝামেলা না হয়। আমরা প্রথম দিন থেকে কার্ডেই পেমেন্ট করেছি কারণ তখনও নতুন দেশের নতুন টাকা পুরোপুরি চেনা হয়নি।

  


ক্রমশ...

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা #কেয়া_চ্যাটার্জি প্যারিস পর্ব • #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস...