মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৯

ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস


Anglo-Saxon Period/Old English Period [450-1050]
পরিচিতি
Anglo-Saxon যুগের সাহিত্য সম্বন্ধে জানার আগে জানতে হবে এই anglo-saxon আসলে কারা। এরা জার্মানীর তিনটি উপজাতি― জুটস(jutes), এঙ্গেলস(Angls) এবং সাক্সনস (saxones), যারা ব্রিটেন অধিগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনের উপকূলবর্তী অঞ্চল অধিকার করে।
Angul বা Ongul শব্দটির অর্থ hook এবং ইংরাজি শব্দ Angle মাছ ধরা অর্থে ব্যবহার করা হতো। দুটি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে Angle প্রজাতির জীবিকা ছিল প্রধানত মাছ শিকার। এদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটতো সমুদ্রে
Seax, sax শব্দ দুটি থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ Saxon যার অর্থ ছোট ছুরি। এরা ছিল সাহসী, রাগী ও শক্তিশালী। এরা প্রধানত ছিল যোদ্ধা। এদের নামানুযায়ী ঐ বাসভূমির নামকরণ হলো Anglalond এবং তা ধীরে ধীরে লোকমুখে পরিবর্তিত হলো Englelond তারও পরে বর্তমান নাম England।
Jutland এর বাসিন্দাদের বলা হতো jutes। পরবর্তীকালে এই তিন উপজাতি রচিত সাহিত্যকে একসাথে বলা হল Anglo-Saxon Literature।

https://www.amazon.in/MARUTINANDAN-NX-Georgette-Embroidered-Stitched/dp/B07VKB69XZ/ref=as_sl_pc_qf_sp_asin_til?tag=keya230b-21&linkCode=w00&linkId=d007116a994e6723a0d7644a9f58e1c9&creativeASIN=B07VKB69XZ


জীবন:-
উপরোক্ত বর্ননা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই উপজাতির জীবন একেবারেই সহজ ছিল না। বরং কঠোর পরিশ্রম আর ব্যর্থতা ছিল এদের নিত্যসঙ্গী। একদিকে দুর্গম জঙ্গল জীবন ও হিংস্র পশুদের আক্রমণ, আরেকদিকে ছিল সুবিশাল সমুদ্র যার কুয়াশা, ঝড় ও তুষারপাত বারবার তাদের জীবন বিপন্ন করেছে। তবুও তারা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে অকুতোভয় হয়ে জীবনকে উপভোগ করেছে। তার থেকেও বেশি ভালোবাসতে শিখেছে সেই প্রতিকূল, অবাধ্য সমুদ্রকে। তাদের সেই ভালোবাসাই বারংবার ফুটে উঠেছে তাদের কাব্য, সাহিত্য ও ছবিতে।
সাহিত্য:
Beawulf:
Anglo-Saxon যুগের সাহিত্যের প্রসঙ্গ এলে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে সে যুগের প্রধান এবং অন্যতম রচনা Beawulf এর কথা। এটি আসলে একটি নিগৃহীত, শোষিত সমাজের পুনরুত্থানের গাঁথা, যা ঘটেছিল এক বীর যোদ্ধা Beawulf(বেউলফ)এর হাত ধরে। 
        গ্রেন্ডেল (Grendel) নামক এক নৃশংস রাক্ষস প্রতি সন্ধ্যেবেলা Danes (ডেন্স) এর রাজা Hrothgar (রথগার)এর সভাঘরে হামলা করতো এবং চারিদিক ক্ষয়ক্ষতি করা ছাড়াও আহার হিসেবে তুলে নিয়ে যেত এক একটি মানুষকে। এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাজা বহু চেষ্টা করেন। প্রায় বারো বছর ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ করে শুধু ক্ষয় হয়েছে সৈন্য বল ও অস্ত্র নষ্ট হয়েছে। অবশেষে রাজার এই দুর্দশার খবর সাগর পেরিয়ে এসে পৌঁছলো বীর বেউলফ এর কানে। তিনি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হলো রাজার দরবারে। সন্ধ্যেবেলা যখন গ্রেন্ডেল আবার হামলা করলো, তাকে সম্মুখীন হতে হলো বেউলফ ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর। বলাবাহুল্য গ্রেন্ডেল মৃত্যুমুখে পতিত হলো। সকলে যখন রাক্ষসের মৃত্যুর জন্য উল্লাসে মেতে উঠেছে, নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেছে নিশ্চিন্তে, ঠিক তখনই আক্রমণ করলো আরেকটি রাক্ষস বা monster। এটি গ্রেন্ডেলের মা। পুত্র শোকে কাতর হয়ে সে হামলা করেছে মনুষ্য প্রজাতির ওপর। এবারেও বেউলফ রক্ষাকর্তা হয়ে এগিয়ে এলো এবং রাক্ষসের পিছু পিছু সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। সমুদ্র রক্তে লাল হয়ে উঠল। সকলে যখন বেউলফের বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন বিশ্বাস রেখেছে শুধুমাত্র তাঁর অনুগামীরা। অবশেষে বেউলফ সেই রাক্ষসের কাটা মুন্ডু হাতে উঠে এলো তীরে। প্রথম খণ্ড এখানেই সমাপ্ত।
     এরপরের খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে  পঞ্চাশ বছর পরের ঘটনা। এই খণ্ডে বেউলফ বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর রাজত্বে সকল প্রজা সুখে রয়েছেন। রাজা তাঁর সব শত্রুদের বিনাশ করলেও একটি ড্রাগনকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। অবশেষে একসময় যখন সেই শত্রু হত্যালীলার নেশায় মেতে উঠেছে তখন বেউলফকে অস্ত্র হাতে নামতে হয়েছে ময়দানে। ড্রাগনের গুহায় যুদ্ধ করতে করতে উদ্ধার হয় প্রচুর মণি মাণিক‍্য। কিন্তু এই যুদ্ধে ড্রাগন নিহত হলেও, বেউলফ চরম আহত হন। রাজা দেখে খুশি হন যে তাঁর অনুচর ও অনুগামীরা ধন রত্নের লোভ না করে তাঁর সুস্থতার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অবশেষে বেউলফের মৃত্যু ঘটে এবং দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি হয়।
Beawulf ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি। এই একটি কাব্যগ্রন্থের মর্মার্থ উদ্ধারের নেশায় তৈরি হয়েছে একটি গোটা লাইব্রেরি। বহু গবেষক গবেষণা করেছেন এই কাব্যটি সম্পর্কে। কেউ মনে করেছেন সত্যিই সেই সময় বেউলফ ও গ্রেন্ডেলের মতো শক্তিশালী মানুষ ও দানব ছিল। কেউ আবার এই যুক্তি নস্যাৎ করে বলেছেন, গোটাটাই একটা রূপক কাহিনী। এই কাহিনীর প্রত্যেকটি পংক্তি ও ঘটনা মানুষের লড়াইয়ের চিত্র। কারুর মতে বেউলফ হলো আসলে মানব জাতি স্বয়ং যার অদম্য মানসিক জোর, সাহস ও পরিশ্রমের সামনে গ্রেন্ডেল রূপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূলতা হার মেনেছে বারবার। এই যুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ বলেছেন বেউলফের তিনটি শত্রু হলো তিনটি বাধা। সমুদ্র, সমুদ্রে পারি দেওয়া ও সেই সমুদ্রকে নিজের জীবন নির্বাহের মাধ্যম বানানো। বলাবাহুল্য মানুষ এই তিনটি কর্মেই সফলতা অর্জন করেছেন।  এছাড়াও, লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, anglo saxon উপজাতির জীবনে সমুদ্র যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা বারবার ফুটে উঠেছে এই কাব্যে।
বেউলফের ছন্দ, বাক্যগঠনশৈলী ইত্যাদি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। এছাড়াও, Old English যুগীয় আরো কিছু কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। যাদের নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে।



রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯

ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস

 ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস

সাহিত্য কি ও পড়বো কেন?

  সাহিত্য পৃথিবীর একমাত্র বস্তু যা কোনো সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনা। একটি সাহিত্য সৃষ্ট হয় এই পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জন্য। 

  সাহিত্যের কথা শুরু করলে প্রথমেই চলে আসে মানবজাতির অগ্রগতির ইতিহাসের কথা। এই আধুনিক পৃথিবীর অধিবাসীরা মনুষ‍্যেতর প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার সফরের মাধ্যমেই অর্জন করেছে জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, অনুভব ক্ষমতা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা। এই ক্ষমতা গুলিই ক্রমে ব্যক্ত হয়েছে সাহিত্য হিসেবে।

  মানুষ গুহা জীবন থেকে বেরিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করার মাধ্যমে পার করেছে সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত গুহাচিত্র তৎকালীন জীবনযাত্রার ছবি তুলে ধরে। আসলে সাহিত্য হলো সমাজের আয়না। আমরা যে যুগে বাস করছি তার লিখিত পটচিত্র বা যে যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে তার সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে পারি একমাত্র সমকালীন সাহিত্যের সাহায্যে।

  তাই সাহিত্য বুঝতে গেলে অবশ্যই বুঝতে হবে ইতিহাস। মানুষের স্বপ্ন, আশা, আশাভঙ্গ, সামাজিক আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, রীতি-নীতি ইত্যাদি বোঝার জন্য যেমন সাহিত্য এক মাধ্যম তেমনই ইতিহাসও আরেকটি মূল মাধ্যম। এরিস্টটল বলেছেন, “Poetry is more serious and philosophical than history.” আবার গোথ সাহিত্যকে বলেছেন, “the humanization of the whole world.”

  একটি সাহিত্য তখনই অমরত্ব লাভ করে যখন তার বক্তব্য স্থান, কাল, পাত্রের গন্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনীন ও সর্বকালীন হয়ে ওঠে। যেভাবে বর্ষায় ঠোঁটে গুনগুনিয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ, সেভাবেই পাখির ডাকে মনে পড়ে যান কবি কিটস, আবার বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলতে থাকা তারুণ্য অনুধাবন করতে পারেন John Osborne এর নাটক “Look Back in Anger” এর মর্মার্থ। বিশ্বাস ঘাতকতার কথা উঠলে যেমন আসে মীরজাফরের উদাহরণ তেমনই আসে Mackbeth এর প্রসঙ্গ।

 আরেকটি বিশেষ আঙ্গিক যেকোনো সাহিত্যকে প্রাচুর্য প্রদান করে তা হলো লেখকের নিজস্ব ও অভিনব স্টাইল। যখন একজন লেখক তাঁর কলমের মাধ্যমে পাঠককূলের সামনে সমাজের চিত্র তুলে ধরেন তখন সেই চিত্রে মিশে থাকে সেই লেখকের নিজস্ব চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গী। কারুর দৃষ্টিভঙ্গী হতে পারে সদর্থক কারুর বা নঞ‌র্থক। এই দুই ধারার চিন্তাভাবনাকে পাশাপাশি রেখে বিচার করাকেই বলা হয় “food for thought”।

 শুধুমাত্র ইতিহাস বা সমাজ নয়, সাহিত্য কর্মের আরেকটি বিশেষ কাজ হলো মানুষকে চেনা বা চেনানো। রবিঠাকুর তাঁর “ঘরে বাইরে” উপন্যাসের শুরুতেই বলেছিলেন মানব চরিত্র বহুমুখী। একজন মানুষকে আমরা যেভাবে দেখি সেই মানুষ স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে পারেন। মানব চরিত্র বিশ্লেষণ সবথেকে কঠিন ও দুরূহ কাজ যে কর্মযজ্ঞে ব্রতী হয়েছে শত শত কলম। 

 সাহিত্য আসলে শব্দ দ্বারা রচিত জীবনের এক সুন্দর ছবি। এটি মানুষের চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও অনুধাবন ক্ষমতার এক ও একমাত্র লিখিত নথি। মানব জীবনের উত্থান পতনের ইতিহাস থেকে আধুনিক সমাজ গঠন ও সেই সমাজের জীবনযাত্রা, মানসিক ও তাত্ত্বিক গতিবিধির বর্ণনায় মুখরিত হয় আধুনিক সাহিত্যের বক্তব্য। সাহিত্য এমন এক বহতা নদী যার জোয়ার আছে কিন্তু ভাঁটা নেই।

[ পরবর্তী পর্ব: Old English/ Anglo-Saxon Period]





বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৯

নিখোঁজ

নিখোঁজ?
কেয়া চ্যাটার্জী
দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো একটি মেয়ে। চুলগুলো এলোমেলো, বিধ্বস্ত চেহারা, চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় আগের রাতে ঘুমায়নি। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা তড়িঘড়ি বের করে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, "এই ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ কিছু করুন।" কদমতলা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অতনু বিশ্বাস ভীষণ শান্ত স্বরে বললেন, "বসুন। জল খান। তারপর ঠান্ডা মাথায় সব কিছু বলুন। আগে অভিযোগ লিখি। সব কিছুরই তো একটা নিয়ম আছে।"  মেয়েটি একটু স্থিতু হওয়ার পর বলতে শুরু করলো, “আমি পরমা লাহা। ছবিটা আমার বন্ধু অপূর্ব নাথের। আমরা একই কলেজের বন্ধু।”
― বন্ধু না বয়ফ্রেন্ড? বলে রাখলে সুবিধা হয় আর কি।
অফিসারের প্রশ্নে একটু ইতস্তত করে পরমা বলল, “হ্যাঁ, বয়ফ্রেন্ড। পাঁচ বছরের সম্পর্ক। গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি ব্যাঙ্গালোর যাই একটা কোর্সের জন্য। আর অপূর্ব এখানেই থেকে যায়। একটা চাকরি পেয়েছিল। আমাদের প্রায়ই কথা হতো ফোনে, মেসেজে। গত দু বছরে চার-পাঁচ বার কলকাতা এসে দেখাও হয়েছে। কিন্তু লাস্ট একসপ্তাহ কিছুতেই ওর কোনো ট্রেস পাচ্ছি না। ফোন বন্ধ, মেসেজ বা ভিডিও কলের তো প্রশ্নই ওঠে না।” গলা কেঁপে ওঠে পরমার।
― বাড়িতে ফোন করেছেন? বা অন্যকোনো বন্ধুদের?
― ওর বা আমার বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা জানে না। তবে একজন বন্ধুকে দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। ওখানেও নেই। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কারুর কাছেও ওর কোনো খোঁজ নেই।
― ছেলেটির ঠিকানা দিন।
পরমা ফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করে বলল, "আসল বাড়ি কৃষ্ণনগর। ওখানকার ঠিকানা জানিনা। এখানে চেতলায় থাকতো। ভাড়া বাড়ির ঠিকানা এটা।”
অতনু বাবু দেখলেন স্ক্রিনে ভাসছে একটি তেইশ চব্বিশ বছর বয়সী ছেলের ছবি। খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি আর জিন্সে, তার এলোমেলো চুল আরো মোহময়ী। একটি দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে, দেওয়ালে একটি শ্বেত পাথরের ফলকে খোদাই করা ঠিকানা ২/২এ, গোবিন্দ আঢ‍্য রোড।
দিন সাতেক কেটে গেছে। হাতে কিছু ছোট খাটো কেস মিটিয়ে অতনু বাবু অপূর্বর কেসে মনোনিবেশ করলেন। বাড়িটা পুরোনো আমলের। সমস্ত প্রটোকল ভেঙে রাস্তার ধার ঘেঁষে উঠে গেছে বাড়ির দেওয়াল, সামনেই দরজার দুধারে লাল সিমেন্টে বাঁধানো রক। কলিং বেল নেই। লম্বা দরজার গোল লোহার কড়া বার তিনেক নাড়াতেই খট করে ভিতর থেকে খুলে গেল দরজাটি। সামনে দাঁড়িয়ে একজন বয়স্ক লোক। গাল ভর্তি সাদা দাঁড়ি-গোঁফ, পরণে একটি ফতুয়া আর হাঁটু অবধি ওঠানো ধুতি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পুলিশ দেখে একটু হকচকিয়ে গেছেন। শীর্ণ শরীরে একটু বল এনে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার?” অতনু বাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বললেন, "একটি ছেলের খোঁজে এসেছি। বসে কথা বলা যাক?” উঠোনেই একটি চেয়ারে বসার ব্যবস্থা হলো। উঠোনের একপাশে কুয়োতলা ও বাথরুম। বাড়িটি দুতলা তবে জীর্ণ। আয়তন ও পজিশনের জন্য যেকোনো প্রোমোটারের কাছে অতি লোভনীয়। অপূর্বর ছবি দেখে বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “হ্যাঁ ও তো এখানেই থাকতো। প্রায় পাঁচ বছর ছিল। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে। মাঝখানে একটা চাকরিও পেয়েছিল। ভাড়া সময় মতোই দিত।” অতনু বাবু বললেন, “তারপর? ভাড়া তুলে দিলেন, নাকি নিজেই চলে গেল?” বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “আমি কেন তুলবো স্যার? ঝামেলা তো কিছু ছিল না ছেলেটার। সকালে বেরোত, রাতে ফিরত। আরো পাঁচ ঘর ভাড়া থাকে নীচ-ওপর মিলিয়ে। অপূর্ব নিজেই এক সন্ধ্যেবেলা এসে বলল, “কাকু অফিস মুম্বাইতে পোস্টিং দিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে দেবো।” আমার একটু খারাপই লাগলো। এতদিন ছিল ছেলেটা। তার দুদিন পরেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।” অতনু একবার তার ঘরটা দেখে এলেন। নেহাতই ছোট একটা আদ্দিকালের ঘর, তার কোথাও কোনো রহস্য নেই। নতুন ভাড়াটের জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে, ফলে কোনো রকম ক্লু পাওয়ার ভাবনাও অলীক। অতনু বেরিয়ে এলেন। বৃদ্ধকে বললেন, “কোনো রকম খবর যদি পান আমায় ফোন করবেন।” বৃদ্ধ একটা কাগজে অতনুর মোবাইল নম্বর লিখে নিয়ে ঘাড় নাড়লেন।

https://www.amazon.in/Avengers-Kidsville-Sweatshirt-STY-18-19-005851_Blue_13-14-Years/dp/B07SL43J6T/ref=as_sl_pc_qf_sp_asin_til?tag=keya230b-21&linkCode=w00&linkId=74812a4b834d1bdd2e6ce0303a64cd07&creativeASIN=B07SL43J6T

  এরপর যেতে হবে ছেলেটির অফিসে। পরমার কথা অনুযায়ী অফিসটা রাজারহাটে। ঠিকানা অনুসরণ করে অতনু এসে পৌঁছলো একটি চারতলা বাড়ীর সামনে। দেখলেই বোঝা যায় বাড়ীটা পুরোপুরি কমার্শিয়াল। বাড়ীটির তিনতলায় রিসেপশনে এসে অপূর্ব নাথের নাম নিলে মেয়েটি কিছুক্ষন ভ্রূ কুঁচকে ভেবে নিয়ে কম্পিউটারে ডেটাবেস দেখে বলল, “হ্যাঁ, এই ছেলেটি এখানে কাজ করতো, কিন্তু প্রায় দেড়-দু সপ্তাহ হলো ও কিছু না জানিয়েই আসছে না। আমরা মেইল করি, ও রিপ্লাই দেয় না, ফোনও বন্ধ। অগত্যা ওর পোস্টে নতুন ছেলে এপয়েন্ট করা হয়।” অতনু বললেন, “ওকে কি মুম্বাই ট্রান্সফার করা হয়েছিল এর মধ্যে?” মেয়েটি আবার কম্পিউটারে চোখ বুলিয়ে বলল, “না তো স্যার। সেরকম কোনো ইনফরমেশন এখানে নেই। আর ছেলেটি কাজে join করেছে মাস দুই হয়েছে। এর মধ্যে হেড অফিসে পোস্টিংয়ের কোনো চান্সই নেই।” অতনু কিছুক্ষন চুপচাপ চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে ম্যাডাম, ওর বাড়ীর ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিন। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।” অফিস থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ও তাঁর সহযোগী মৃণাল রায়কে ফোন করে সব ডিটেইলস দিয়ে খোঁজ নিতে বলে অতনু চললেন পরমার বাড়ী।

 “দেখুন অফিসার, এটা তো আর আমরিশ পুরী আর শাহরুখ খানের সিনেমা নয় যে ভিলেনের মেয়ের সাথে প্রেম করছে দেখে ভিলেন হিরোকে সরিয়ে দিলো। আপনি যদি আমায় সন্দেহ করে থাকেন তাহলে আপনি ভুল করছেন। আমি ছেলেটিকে চিনিনা।” গরম কফি খেতে খেতে সাততলার বিশাল এপার্টমেন্টের ড্রয়িং রুমে বসে জানালেন বিশ্বজিৎ লাহা, পরমার বাবা। একটু দূরেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে পরমা। পাশের সোফা আর চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসে আছে আরো জনা কয়েক সমবয়সী ছেলেমেয়ে। তারা সকলেই পরমা আর অপূর্বর ক্লাসমেট বা ব্যাচমেট। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “অপূর্বর সাথে অনেকদিনই কোনো যোগাযোগ ছিল না আমাদের। আসলে ও নিজেই যোগাযোগ রাখতে চায়নি বলা যায়। কিছু একটা লুকিয়ে রাখতো আমাদের থেকে। আমরাও ওর ব্যবহারে খুব বিরক্ত হতাম। ওর অফিস বা কাজ সম্পর্কে কিছুই বলতে চাইতো না। ধীরে ধীরে, যা হয় আর কি, সম্পর্ক রইল না।” অতনু পরমার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনিও কি কিছুই জানতেন না পরমা?” পরমা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। অতনু বোঝেন অপূর্ব কোনো এক চক্রে আটকে পড়েছে যার ব্যাপারে সে কাউকে কিছুই বলতে চায়নি বা পারেনি। লোক দেখানো একটা চাকরি সে জুটিয়ে রেখেছিল কিন্তু তলে তলে জড়িয়েছে আরো বড় কোনো জালে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়লেন তিনি। কেসটা একটু জটিল। কোনো সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না এই রহস্যের কিনারা করার মতো। বাইকে করে বেশ কিছুটা চলে এসে অনুভব করলেন পিছনে যেন আরেকটা বাইক তাকে অনুসরণ করছে। ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে দিতে পিছনের বাইকটা কাছাকাছি এসে পড়ল। অতনু দেখলেন অপূর্বর বন্ধুদের একজন। কাছে এসে সে বলল, “ভালো করেছেন বাইকটা থামিয়ে, আপনাকে ডাকতেও পারছিলাম না, আবার আপনার বুলেটের সঙ্গে পাল্লা দিতেও পারছিলাম না।” বলেই হাসল ছেলেটি। মুখটি বেশ গোলগাল ও হাসিখুশি।অতনু বললেন, “এমন কিছু কি বলতে চাও যেটা ওখানে বলতে পারছিলে না?” ছেলেটি এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “কোথাও গিয়ে বসলে ভালো হয় স্যার। রাস্তায় এভাবে বলা যাবেনা।” অগত্যা অতনু তাকে তার বাড়ীতেই নিয়ে এলেন। একে অবিবাহিত, তার উপর কিছুদিন আগে মা-ও ছেড়ে চলে গেছেন। রাত দশটায় তার বাড়ীতে অতিথি এলে কেউ রুষ্ট হওয়ার নেই। বাবার তৈরি একতলা বাড়ীতেই তিনি তার ত্রিশটা বছর কাটিয়েছেন। আগামী বছর গুলোও হয়তো এভাবেই কাটবে। বসার ঘরে পুরোনো একটি সোফায় গা এলিয়ে দিল ছেলেটি। হেসে বলল, “আমার নাম স্যার জিমুত রায়। আমি অপূর্বর সাথে স্কুল আর কলেজ যুবন দুটোই কাটিয়েছি তাই ওকে পরমা বা ওর অন্যান্য বন্ধুদের থেকে একটু হলেও বেশি চিনি।” একগ্লাস জল জিমুতের দিকে এগিয়ে দিয়ে অতনু বললেন, “পুরোটা বলো জিমুত। তোমাকে খুব দরকার।” জলটা ঢকঢক করে খেয়ে জিমুত বলল, “আমরা ক্লাস নাইন থেকে একসাথে। একসাথে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, গ্রাজুয়েশন।” অতনু বললেন, “তুমিও কি কৃষ্ণনগরের?” জিমুত মাথা নেড়ে বলল, “ওর বাড়ি কৃষ্ণনগর ঠিকই কিন্তু অপূর্ব এখানে যখন আসে ও তখন ক্লাস নাইন। ওর বাবার কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর পড়াশুনা চালানোর জন্য ওকে ওর মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেয় ওর বাড়ির লোক।” অতনু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তাই নাকি? ওর মামাবাড়ি কোথায়?” জিমুত গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, “চেতলার আশেপাশেই। পরে যখন কলেজে ওঠে তখন মামাবাড়ি ছেড়ে দিয়ে একটা ভাড়াবাড়িতে ওঠে। আসলে ওর মামীমা খুব অশান্তি শুরু করেছিলেন ওর থাকা খাবার খরচ নিয়ে। খুব আত্মাভিমানী ছেলে ও।” অতনু বেশ আগ্রহ বোধ করেন এবার, বলেন, “তারপর? ওর মধ্যে কি কিছু অস্বাভাবিকত্ব ছিল?” জিমুত একটু চুপ করে রইল। যেন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। তারপর বলল, “অস্বাভাবিকত্ বলতে যা বোঝায় তা সকলের চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু দারিদ্র ওকে বুঝিয়েছিল যে জীবনে টাকাটাই সব। আর সেই বোধ থেকে ও ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ থেকেই রোজগারের পথ খুঁজে নেয়। ওর হাতে আসে প্রচুর কাঁচা টাকা।” অতনু অবাক হয়ে বলেন, “কাঁচা টাকা! সতের আঠারো বছর বয়সে কি করে কাঁচা টাকা হাতে আসে? ও কি কোনো এন্টিসোশ্যাল চক্রে জড়িত হয়ে পড়েছিল?” জিমুত মাথা নেড়ে বলল, “জানিনা স্যার। জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাইনি। বেশি প্রশ্ন করলে বরং এড়িয়ে যেত।” অতনু নিচের ঠোঁটে বুড়োআঙুল ছুঁইয়ে কিছু ভাবলেন তারপর বললেন, “লাস্ট কবে দেখা হয়েছে তোমার সাথে?” জিমুত বলল, “মাসখানেক আগে। নিজেই দেখা করে একটা ব্যাগ দেয় আমাকে। বলে ও নিজে এসেই নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এলো না। আমি কখনো খুলে দেখিনি কিন্তু ব্যাগের ওপর একটা নার্সিং হোমের নাম আর ঠিকানা লেখা। যেদিন ব্যাগটা দেয় সেদিন খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে। বলেছিল ও ছাড়া যেন কাউকে ব্যাগটা না দিই আর কাউকে যেন ভুলেও না বলি যে ব্যাগটা ও আমায় দিয়েছে। আমার মনে হয় ও কোনো চক্রে আটকে পড়েছে স্যার। একটু দেখুন।” জিমুত একটা ব্যাগ হাতে দেয় অতনুর। কালো রঙের একটা সাদামাটা ব্যাগ। ওপরে লেখা 'উই কেয়ার নার্সিং হোম' ট্যাংরা এলাকায় অবস্থান। জিমুতকে বিদায় জানিয়ে ডিনার সেরে ব্যাগটা নিয়ে বসেন অতনু।
  ব্যাগের মধ্যে রয়েছে অনেক কাগজ। সবই মেডিক্যালের কাগজ। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট, এক্স-রে রিপোর্ট, ইউ-এস-জি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কমার্সের ছাত্র অপূর্ব এই সমস্ত কাগজ নিয়ে আসলে কি করতে পারে? এগুলো কি তার পরিচিত কারুর রিপোর্ট? কিন্তু এমন কি আছে এই কাগজে যা সে কাউকে বলতেই বারণ করে দিল? মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করতে শুরু করলো তার। আজ সারাদিন এই একটা কেস নিয়ে বেশ মাথা ঘামাতে হয়েছে। এক পেগ হুইস্কি খেয়ে নিদ্রামগ্ন হলেন অতনু বিশ্বাস।
 ঘুম ভাঙলো সিনিয়ার অফিসারের ফোনে। সকাল সাতটা। “অতনু তোমার এলাকায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। স্পটে যাও তাড়াতাড়ি।” এরকম ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবুও অতনুর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কাল রাতে জিমুত একাই বেরিয়েছিল। বাড়ি ফিরেছে কিনা জানা হয়নি আর। রাস্তার ধারে বিশাল ফাঁকা জমি, ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি। তার মধ্যেই উল্টে পরে আছে একটা বাইক। বডিটা তুলে আনা হয়েছে। সারা গায়ে চাপ চাপ রক্ত জমে, রাস্তার সাথে ঘষা লেগে চামড়া উঠে গেছে শরীরের অনেক জায়গায়। তবু মুখটা স্পষ্ট। জিমুত। “বাইকের ব্রেকের তার কাটা ছিল স্যার। স্পিড বাড়াতেই স্কিট খেয়ে উল্টে পড়েছে বোধহয়।” একজন কনস্টেবল কথাটা বলেই আবার বাইকটি উদ্ধারের কাজে লেগে পড়ল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অতনুর। কিছু লোভী, স্বার্থপর মানুষের জন্য কতো নিরপরাধীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বাইক ঘুরিয়ে আবার চলল সে বাড়ির দিকে। দোতলায় উঠে এসে চমকে উঠলো অতনু, সেন্টার টেবিলে রাখা ব্যাগটা নেই। কাল রাতে এখানেই রেখেছিল সে ব্যাগটা। ছিঃ ছিঃ এতো বড় ব্লান্ডার কেউ করে! নিজের অজান্তেই একটা ঘুষি ঠুকে দিল সে দেওয়ালে। মাথার শিরা দুটো দপদপ করছে, অপরাধী তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এই কেসের নিষ্পত্তি সে করবেই।
 কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে একটা রিকশা করে পৌঁছে যাওয়া যায় লোকাল থানায়। অপূর্বর ছবি ও পরিচয় দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তার কেস হিস্ট্রি হাতে চলে এলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, অপূর্বর নামে মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে প্রায় মাসখানেক আগে। ওর দাদা এসে করে গেছে। কিন্তু তারপর আর কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। এভাবে একটা পরিবার একটা ছেলেকে কি ভুলে যেতে পারে? থানার এক অফিসারের বাইকে চেপে অতনু এসে পৌঁছায় অপূর্বর বাড়ি। বড় রাস্তার পাশেই দুতলা, ছিমছাম, বাগান ঘেরা বাড়ি। ছোট্ট একটা লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢোকার আগেই গেটের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন ভদ্রমহিলা। পরণে ছাপা শাড়ি, আঁচলটা কোমড়ে গোঁজা, কপালের সিঁদুর ঘামে লেপ্টে গেছে, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ-বাহান্ন। স্বরূপের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। স্বরূপ পকেট থেকে কার্ড বের করে বললে, “কলকাতা পুলিশ।” কথাটা শুনে একটু থমকে গেলেন ভদ্রমহিলা। যেন এটা কোনোদিন আশা করেননি। একটু ইতস্তত করে বললেন, “এই বারান্দাতেই বসুন, বাড়িতে কেউ নেই। কি জানার আছে বলুন?” অপমানিত হলেও এগুলো সহ্য করা অভ্যেস হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলো, “অপূর্বর সম্পর্কে জানতে এসেছি।” মহিলা তেমনই কঠোর মুখে বললেন, “বলুন কি জানতে চান?” স্বরূপ একটু অবাক হলো। মহিলা যেন সব জেরার জন্যই প্রস্তুত। বলল, “ও কবে থেকে কলকাতায় আছে? কিভাবে নিজের পড়াশোনা চালাতো ওখানে? কোথায় থাকতো? কি চাকরি করতো? এইসব উত্তর আমার বিস্তারিত ভাবে চাই। আপনারা তো মিসিং ডায়েরি করেছিলেন। কলকাতায় কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি? কেন এখানে একটা ডায়েরি লিখিয়ে চুপ করে গেছেন?” মহিলা এবার মোড়া এনে বসলেন। একটু যেন ক্লান্ত লাগছে তাকে। কপালের মাঝখানটা চেপে ধরে কিছুক্ষন বসে থাকলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, “আমার দুই ছেলে। রূপ ও অপূর্ব। অপু যখন ক্লাস নাইনে তখন ওর বাবার একটা স্ট্রোক হয়ে বাঁদিকটা পরে যায়। কারখানার কাজটা যেতে বসেছিল, বড়বাবুকে হাতপায়ে ধরে বড় ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দিই। উচ্চমাধ্যমিকের পর ওর পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ছোটটাকে মাধ্যমিকের পর দাদার কাছে পাঠিয়ে দিই। কলকাতায়। কলেজের গন্ডীটা পেরোলেও তো অনেক মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু সহজ সরল ছেলেটা বড় শহরে গিয়ে কেমন পাল্টে গেল। মাস ছয়েকের মধ্যে টাকা পাঠাতে শুরু করলো। কখনো দশ হাজার, কখনো বিশ। সবই অপূর্ব নাথের কলকাতার একাউন্ট থেকে। আমাদের বুক কাঁপলো। ও তো তখনও স্কুল পাশ করেনি। দাদা একদিন ফোন করে বলল, অপুকে নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি হচ্ছে। বৌদি ওর হাবভাব চালচলন কিছুই মেনে নিতে পারছে না। ভীষণ উদ্ধত হয়ে পড়েছে ও। আমি তো অবাক। আমার ছেলে তো এমন ছিল না।” এইটুকু বলে মহিলা একটু থামলেন। হয়তো দম নিতে। হয়তো কান্নার বেগ সামাল দিতে। হঠাৎ গেট খোলার শব্দে দুজনেই সামনে তাকালো। একটি বছর ছাব্বিশ-সাতাশের ছেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। বারান্দায় উঠে এসে অতনুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনি পুলিশ? কি চাই?” অসন্তোষ চেপে অতনু বলল, “আপনার ভাইয়ের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে এসেছি।” ছেলেটি ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার কোনো ভাই নেই। আপনি আসতে পারেন।” হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল অতনুর। ওপার থেকে কিছু শুনে উঠে বসলো সে। রূপের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন আমার সাথে।” রূপ অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
  একটা জানালাবিহীন ঘরে বসে আছে তিনটে প্রাণী। রূপ, পরমা আর অতনু। একটু আগে একটা মৃতদেহ সনাক্ত করে এসেছে ওরা। দুজনেই বলেছে ওটা অপূর্বর লাশ নয়। অতনু টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “উই কেয়ার নার্সিংহোম।” শব্দ তিনটি শুনেই যেন চমকে উঠল সামনের দুজন। অতনু ঠিক এটাই চেয়েছিল। ঠোঁটের কোণে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলল, “নামটা ভীষণ চেনা তাই না?” রূপ ইতস্তত করে বলল, “ভাই ওখানে কাজ করতো।” অতনু উঠে দাঁড়িয়ে রূপের সামনে টেবিলে হেলান দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “শুধু অপূর্ব কাজ করতো?” রূপ আড় চোখে পরমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনো অপরিচিতর সামনে কিছু বলতে পারবো না স্যার।” অতনু সেরকমই ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলল, “পরমা আপনার অপরিচিতা নাকি?” রূপ বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মতো তাকালো অতনুর দিকে, পরমাও ঘামছে। অতনু হঠাৎ রূপের কলার ধরে তুলে একটা জোর ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, “সত্যি কথাগুলো ভালোয় ভালোয় বলবি নাকি লাঠি আনবো? কেন নিজের ভাইকে মেরেছিস বল?” এমন বিনা মেঘে বজ্রপাতে রূপ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো, “বলছি স্যার বলছি। মারবেন না। এই মেয়েটা আমায় ফাঁসিয়েছে।” পরমা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বলল, “রূপ! আমি তোমায় ফাঁসিয়েছি? প্ল্যানটা তোমার ছিল, আর আমি তোমায় ফাঁসিয়েছি?” অতনু মনে মনে স্বস্তি পেল। তীর ঠিকঠাক চাকে গিয়ে লেগেছে। ধমকের সুরে বললো, “এসব দোষারোপ পর্ব জেলে বসে করবে দুজনে। আগে পুরো ঘটনা বলো। ঠিক আছে আমিই বলছি। তার আগে একজনকে ডেকে নেবো।” অতনুর কথা শেষ হতেই একজন অফিসার ঢুকে এলেন ঘরে সঙ্গে বিশ্বজিৎ লাহা। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু বিড়বিড় করে বলে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। অতনু হাসি চেপে বলল, “বলুন মিস্টার আমরিশ পুরী কেমন চলছে আপনার নার্সিংহোমের ব্যবসা?” মিস্টার লাহা উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল।


অতনু সামান্য হেসে বলতে শুরু করলো, “ একটা থ্রিলার গল্পে দু ধরণের অপরাধী থাকে জানেন তো। এক, মাথা মোটা যে ভাবে অপরাধ করে ফেলে প্রমান লোপাট করলেই হলো। বোকা পুলিশ কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। আর এক ধরণের আছে যে অপরপক্ষকে সমান শক্তিশালী ভেবেই অপরাধ করে। এরা খুব ধূর্ত, এদের ধরতে পারাটা খুব চাপের। কিন্তু এরা যদি একত্র হয় তাহলেও কিন্তু কেস বেশ জটিল হয়ে যায়।” মিস্টার লাহা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনার গল্প গাছা শোনার জন্য এখানে বসে থাকতে পারবো না মিস্টার বিশ্বাস। আমি আসছি।”  বিশ্বজিৎ বাবু ওঠার উদ্যোগ করতেই অতনুর বন্দুকের ঠান্ডা নল তার কানের লতি ছুঁলো, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজিৎ লাহা আবার স্বস্থানে বসে পড়লেন। অতনু আবার ঠোঁটে হাসি এনে বলল, '' গুড। কিন্তু মিস্টার লাহা গল্পটা যে আপনাকে শুনতেই হবে। কারণ আপনি তো এই গল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। আচ্ছা এতো পাকা খেলোয়াড় হয়ে এরকম আনাড়ির হাতে খেলার শেষটা দিলেন কি করে বলুন তো?” বিশ্বজিৎ লাহা একবার রূপের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনেই অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন, “যা বলতে চান স্পষ্ট করে বলুন।” অতনু এবার তার গাম্ভীর্য পরিধান করে বলতে শুরু  করলো, “জিমুতের মৃত্যুর পর আমার এই কেসটা নিয়ে একটা রোখ চেপে গেছিল। একজন নিরপরাধী মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তার ওপর বাড়ি এসে দেখি জিমুতের দেওয়া ব্যাগটা আমারই বাড়ি থেকে চুরি গেছে। মাথাটা গেল আরো গরম হয়ে। বুঝলাম এই ঘি সোজা আঙুলে উঠবে না। তাই সিভিল ড্রেসে চলে গেলাম কৃষ্ণনগর। আর এখানে রেখে গেলাম আমার ক্রাইম ব্রাঞ্চ এসিস্টেন্ট তপন বসুকে। সঙ্গের অফিসার মাথা নাড়লেন। তপন উই কেয়ার নার্সিংহোমে পেট ব্যথার অভিনয় করে পেশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়। তাকে সকালবেলা ভর্তি নিয়ে নেওয়ার পর, সারাদিনে বিভিন্ন টেস্ট করার পর সন্ধ্যেবেলা জানানো হয় তার কিডনি ড্যামেজ হয়েছে তাই ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিতেও বলা হয়। আমাদের অফিসাররা পেশেন্ট পার্টির কর্তব্য সেরে সেই রাতে তপনকে ও আরো একজন অফিসারকে পেশেন্ট পার্টি হিসেবে ওখানে রেখে বাইরে টহল দিতে থাকেন আর ভেতরে তপন ও তার সহকর্মী তার কাজ করতে থাকে। ওরা মাঝরাতে ওদের মিশন শুরু করে। প্রথমত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলিকে মিটার রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিকল করে। এই সুযোগে অফিসে ঢুকে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে নার্সিংহোমের মালিক হিসেবে ওদের সামনে উঠে আসে বিশ্বজিৎ লাহার নাম। আরো কিছু কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে এই নার্সিংহোম অর্গান ট্রাফিকিং চক্রের একটি মূল পান্ডা। অর্থাৎ রুগীর সামান্য রোগকে কোনো একটি অর্গান ফেইলিওর বলে, ভুল রিপোর্ট দেখিয়ে প্রচুর টাকা হাতানো ও সাথে সাথে ভালো অর্গান পাচার করার কাজ করা হয় এই নার্সিংহোমে। আমাদের টিম অনেকদিন ধরেই এই চক্রের সন্ধানে ছিল কিন্তু কোনো সূত্র না পাওয়ায় এগোতে পারছিল না। সূত্রটি দিয়ে গেল জিমুত। এদিকে আমি  আমার কৃষ্ণনগরের অফিসার মৃণাল রায়কে সব কিছু জানিয়ে অপূর্বর বাড়ি আর বাড়ির লোকের ওপর নজর রাখতে বলে দিয়েছিলাম। অপূর্ব নাথের বাড়িতে থাকেন একজন অসুস্থ বাবা, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা মা আর তার দাদা, রূপ নাথ। আমার প্রথম থেকেই ভীষণ খটকা লেগেছিল এই ব্যাপারে যে একটা ছেলের মিসিং হওয়ার পর তার বাড়ির লোক দ্বিতীয়বার কেন তার খোঁজ করল না? আমার অর্ডারের পরেরদিন  সকাল থেকে মৃণাল সিভিল ড্রেসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টহল দিতে থাকে। সকাল দশটা নাগাদ রূপ বেরোয় স্কুটার নিয়ে। তার পিছু নিয়ে জানা যায় তার কারখানার ঠিকানা। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি রূপ ওখানেই থাকে। তারপর সে যায় আরেক জায়গায়। আরেকটা অফিসে। মৃণাল পিছু নিয়ে যায় সেখানে। একটা টিনের চালের বাড়ি অফিসের নাম নেই, অফিস সুলভ চাকচিক্য বা কাঠামো নেই, মাত্র একটি ঘর। সন্দেহ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই তবু সন্দেহ প্রবল হলো। সারা সন্ধে ওই বাড়ির কাছাকাছি লুকিয়ে থেকেও রূপকে একবারের জন্যও বেরোতে দেখা গেল না। আশেপাশের লোকজনের থেকে জানতে পারল ওই বাড়িটি সম্বন্ধে তারা খুব বেশি কিছু জানেননা। শুধু রোজ একটি ছেলে এসে দরজা খুলে ঢুকে পড়ে, বেরোয় সেই রাত্রে। আর অন্য কাউকে যেতে বা আসতে দেখা যায়নি। রাত দশটা নাগাদ রূপ বেরিয়ে আবার স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মৃণাল সবটা জানিয়ে আমায় ফোন করলো। আমি পরেরদিনই পৌঁছই। জিমুতের মৃত্যুর সঙ্গে কোথায় যেন যোগসূত্র পাচ্ছিলাম। রাত দশটায় রূপ বেরোল, আমি সুন্দর সুযোগ পেলাম ঘরটা সার্চ করার। তালা খুলতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। রূপ সিকিউরিটির ব্যবস্থা বেশ ভালোই করেছিল। যাইহোক, ভেতরে ঢুকে শুধুই দেখলাম কাগজ আর কাগজ। আলমারি, টেবিল, বাক্স ভর্তি কাগজ। কিসের কাগজ? ঘেঁটে পেলাম সেই একটাই নাম। উই কেয়ার নার্সিংহোম। সেই একই ধরনের রিপোর্ট প্রত্যেকটি ফাইলে, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট , usg রিপোর্ট যেমনটা জিমুতের দেওয়া ব্যাগে ছিল। দেখে যতটুকু বুঝলাম অর্গান ট্রাফিকিংয়ের সমস্ত নথিপত্র এখানে লোকানো রয়েছে। বুঝলাম অপূর্ব আর রূপ একই সংস্থার হয়ে কাজ করতো, একজন কলকাতায় আর একজন এখানে। কিন্তু আমার কাছে কোন ব্যাগটা ছিল বুঝতে পারছিলাম না। ওখানে একই ধরনের অনেকগুলো ব্যাগ। সার্চ করতে করতে একটা নাম চোখে পড়ল, পলাশ নাথ। জিমুত আমায় যে ব্যাগটা দিয়েছিল তাতে এই নামের ব্যাক্তির রিপোর্ট ছিল, দেখেছিলাম। বুঝতে বাকি রইল না এই ব্যাগটাই আমায় দেওয়া ব্যাগ এবং আমার বাড়ি থেকে চুরি গেছিল। পরের দিন সকাল সকাল পৌঁছলাম রূপের বাড়ি। ওর মায়ের কাছে থেকে আরো কিছু কথা জানতে। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে দুই ছেলের কার্যকলাপ সম্পর্কে উনি কিছুই জানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপ ফিরে এলো। ওর চেহারা দেখে বুঝলাম ব্যাগটি যে নেই এবং পুলিশ যে অপূর্বর খোঁজে এতো দূর চলে এসেছে এই খবর ও পেয়েছে। ওর কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন লাগল। ও যেন কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর সম্পর্কে কোনো কথাই বলতে চাইছে না। অনুমান করলাম যে অপূর্বর সম্পর্কে কোনো কথা ও যদি বলে ফেলে তাহলে ও নিজেও ফেঁসে যাবে। মনে মনে ঠিক করলাম ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে, তাহলে যদি কোনো কথা বের করা যায়। সুযোগও এসে গেল। কিছুক্ষন পরেই ফোন আসে তপনের। সে জানায় নার্সিংহোম সম্পর্কে সব খবরাখবর এবং ওরা দুজন কর্মচারীকে গোপনে আটক করে আরো কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। আমি তৎক্ষণাৎ ওকে একটা মেসেজ করলাম মর্গে একটা বডি ঠিক করার জন্য। লাশ সনাক্তকরণের অছিলায় রূপকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। এরপরে যে প্রশ্নগুলি করবো তার উত্তর আশা করি বাকিদের থেকে পাবো। তাই তো রূপ, পরমা?” অতনু এবার থামল। রূপ, পরমা মাথা নিচু করে বসে আছে।

 রূপ ধীরে ধীরে মাথা তুলে একবার পরমার দিকে তাকালো। মেয়েটি তখন থরথর করে কাঁপছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে নার্ভ ঠিক রাখতে পারছে না। রূপ বলতে শুরু করে, “বাবার অসুস্থতার পর মা ভাইকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিলো আর আমায় লেখাপড়া বন্ধ করে ঢুকে পড়তে হলো কারখানায়। কষ্ট হয়েছিল কিন্তু ভাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মেনে নিলাম সব। কলকাতায় এসে ভাই কদিনের মধ্যে প্রচুর টাকা পাঠাতে শুরু করে মায়ের একাউন্টে। এদিকে আমার মাইনে ছয়-সাতের ওপর ওঠে না। ভীষণ হিংসা হলো, ভাই বরাবর বুদ্ধিতে, কাজে আমার থেকে এগিয়ে। আবার চিন্তাও হলো, কোথায় পাচ্ছে এতো টাকা? বারবার প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছে। হেসে বলেছে, “কলকাতায় টাকা ওড়ে রে দাদা।” চিন্তা আরো বেড়ে গেল যখন মামা ফোন করে বলে ভাইকে নিয়ে বাড়িতে খুব সমস্যা হচ্ছে। ও নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি আসি কলকাতায় সবকিছু জানতে। এসে জানতে পারি ভাই চেতলার কোনো একটা বাড়িতে ভাড়া রয়েছে। সেখানেও পৌঁছে যাই। কিন্তু ওকে বাড়িতে পাইনি। সারা দুপুর আর সন্ধ্যে ওই বাড়ির চাতালে কাটাই। রাত এগারোটার সময় ভাই ফেরে। আমাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে হকচকিয়ে যায়। আমি ওর বেশভুষা দেখে তো অবাক। এতো দামী জামা কাপড়, জুতো! ঘরে ঢুকে ওকে চেপে ধরলাম― বল বল কি করছিস তুই? কোথায় পাচ্ছিস এতো টাকা? প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে ধীরে ধীরে সব বলে। ও বলে যে একটা নার্সিংহোমে কিছু একটা কাজ ও করছে যার জন্য এত পরিমান টাকা অর্জন করছে। আমায় বলে এসব কারখানায় কি আছে দাদা? আমার সাথে আয় দেখবি কতো টাকা চারিদিকে ছড়িয়ে। পরের দিন আমাকেও মিস্টার লাহার কাছে নিয়ে যায় ও। মিস্টার লাহা আমায় নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন আগে কিছুদিন সার্ভিস দেখে পুরোপুরি আপয়েন্ট করবেন। বিশ্বাস করুন তখনও জানতাম না আসলে কি কাজে জড়িয়ে পড়ছি।” রূপ একটু দম নেওয়ার জন্য থামল। সামনে রাখা গ্লাস তুলে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করলো, “ধীরে ধীরে আমিও এই কাজে লেগে পড়ি। দারিদ্রের ঝড়ের পরে অর্থের বৃষ্টি লোভের জোয়ার এনে দেয়। এই সময় আমার পরিচয় হয় পরমার সাথে। ও ভাইয়ের বন্ধু ছিল। ভাই ওকে পছন্দ করতো। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম পরমার ভাইয়ের প্রতি সেই অনুভূতি নেই।” রূপ থামে। পরের কথাগুলো বলে পরমা, “অপূর্বর সাথে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না। ও নার্সিংহোমে কাজ করতে শুরু করার দুবছর পর একই কলেজে ভর্তি হই আমরা। ও নিজে থেকেই আমার কাছাকাছি থাকতো কিন্তু রূপের সাথে আলাপ হওয়ার পর আমি রূপকে পছন্দ করতে শুরু করলাম। রূপ ততোদিনে নার্সিংহোমে আর বাড়িতে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে অপূর্বর সাথে। অপূর্বই আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।” অতনু  জিজ্ঞেস করল, “তারপর?” রূপ ধীরে ধীরে তাকালো মিস্টার লাহার দিকে। তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। রূপের দিয়ে তাকিয়ে সে ফেটে পড়লো, “আমার দিকে কি তাকাচ্ছ স্কাউনড্রেল? আমি তোমায় বলেছিলাম অপূর্বকে খুন করতে?” তারপর অতনুর দিকে ফিরে বলল, “শুনুন অফিসার। আমি একটা নার্সিংহোম খুলে অর্গান ট্রাফিকিং করেছি, স্বীকার করছি কিন্তু এই দুটো খুনে আমার কোনো হাত নেই। অপূর্ব আমার কাছে কাজ চেয়েছিল। হি ওয়াস এ ব্রিলিয়ান্ট বয়। পড়াশুনা করলে এগোতে পারতো। কিন্তু সেই সময় আমার এমন একজন এজেন্টের দরকার ছিল যাকে দেখে কেউ সন্দেহ করবে না। একজন স্কুল বয়ের থেকে বেটার ইনোসেন্ট কে আর হতে পারে। আমি কাজ দিয়েছিলাম। ও শুধু ক্লায়েন্ট আনত আর যোগাযোগ করাতো ব্যাস। হি ওয়াস আ রেস্পন্সিবল গাই। বাট দিস ফেলো ইস আবসার্ড। ওকে শুধুই কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার কাজে রেখেছিলাম। লাস্ট টাইম ও ওর বাবাকে নিয়ে আসে হসপিটালে। এমন চামার ছেলে জীবনে দেখিনি। বাবার কিডনি ও নিজে ক্লায়েন্ট এনে বিক্রি করে। অপূর্ব এটা জানতো না। জানতে পেরে ক্ষেপে যায়। ওই কেসের সব কাগজ ও নিজের কাছে রেখে হুমকি দেয় যে ও এই চক্র সম্পর্কে সব পুলিশকে জানিয়ে দেবে। আমি বলেছিলাম তোমার ভাই তুমি কিভাবে ম্যানেজ করবে তোমার ব্যাপার। দুদিন পরে শুনি অপূর্বকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।”  পরমা রূপের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলতে থাকে, “অপূর্বকে বাবা মুম্বাই চলে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়েছিলাম। সেই মতো ও ব্যাগ পত্রও গুছিয়ে রেখেছিল। ওর যাওয়ার কদিন আগে ও ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দেয়। কোথায় যায় জানি না। ফোন করেও পাইনি। হঠাৎই একদিন ওকে এসপ্লানেড এর একটা হোটেল থেকে বেরোতে দেখে আমার কলেজের এক বন্ধু। অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু অপূর্ব শুনতে পায়নি। ভিড়ে মিলিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমি যাই ওখানে, রূপও যায় ওকে বোঝাতে। হোটেলে গিয়ে ওকে পাইনি। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিল। রেজিস্ট্রার চেক করে দেখলাম চেক আউট করেনি। তার মানে ফিরে আসবে। আমরা দুজন হোটেলের বাইরেই একটু আড়ালে অপেক্ষা করতে থাকি। রাত প্রায় বারোটা নাগাদ অপূর্বকে দেখা যায় হোটেলের গেটে। আমরা ওকে গেটের সামনেই ধরি। সেইসময় ও পুরোপুরি ড্রাঙ্ক। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। রূপকে আমার সাথে দেখে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। ওকে মুম্বাইয়ের টোপ দিয়ে কলকাতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা ও বুঝতে পেরেছিল তাই বলতে থাকে যদি কলকাতা ছাড়তেই হয় ও  সব কিছু পুলিশকে জানিয়ে তবে কলকাতা ছাড়বে। একটা ট্যাক্সি ডেকে আমরা তিনজন বাইপাসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হই। রূপ সেই সময় অপূর্বকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বারণ করে। কিন্তু অপূর্ব কিছুতেই মানতে চাইছিল না। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না যে ওর পঙ্গু বাবাকেও রূপ হার্ট সার্জারির নাম করে ওর লালসার শিকার বানিয়েছে।  দুজনের ঝগড়া শুরু হয়, ক্রমে তা  হাতাহাতিতে পরিণত হয়। রূপ একসময় সঙ্গে আনা দড়ি আর কাপড় দিয়ে  অপূর্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। ফোন করে অফিস থেকে গাড়ি ডাকা হয়। ওই গাড়িতে চাপিয়ে অপূর্বকে কলকাতার বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি এর বেশি আর কিছুই জানিনা স্যার। রূপ ওকে কোথায় রেখেছে তাও জানিনা। রূপের কথা মতো কেসটা ঢাকা দেওয়ার জন্য মিসিং ডায়েরি করি পরেরদিন।” অতনু এবার চোয়াল শক্ত করে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলো, “জিমুতকে কেন মারা হলো? কেই বা মারলো?” পরমা এবার খানিকটা জল খেল। কপালের ঘাম মুছল ওড়না দিয়ে। কিছুটা দম নিয়ে বলল, “সেদিন রাতে জিমুতকে আপনার পিছুপিছু যেতে দেখে সন্দেহ হয়। ওকে আমার স্কুটি নিয়ে ফলো করে আপনার বাড়ি পৌঁছই। জিমুতের হাতে একটা ব্যাগ দেখেই পুরোটা আন্দাজ করে ফেলি। রূপের সেদিন রাতের ট্রেনে কলকাতা আসার কথা। ওকে ফোন করে জানতে পারি কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই চলে আসতে বলি আপনার এলাকায়। কিন্তু আমরা ভেতরে কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু অপেক্ষা ছিল জিমুতের আপনার বাড়ি থেকে বেরোনোর। জিমুত বেরোতেই ওকে ফলো করে কিছুটা দূরে এসে রাস্তা আটকে দাঁড়াই। ও প্রথমে কিছুটা অবাক হয় আমাকে আর রূপকে একসাথে দেখে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ও কিছুই বটে চায়নি। বরং আপনাকে কল করে বসে। সেই সময় রূপ ওর ফোন কেড়ে নিয়ে ওকে ফেলে দেয় পাশের পুকুরে। জিমুত সাঁতার জানতো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও মারা যায়। ওর বডি তুলে বাইকে বসিয়ে আরো দু কিলোমিটার দূরে এক জলাভূমিতে ফেলে দিল আর বাইকের ব্রেকের তার কেটে দিল যাতে গোটা ব্যাপারটা একসিডেন্ট মনে হয়। সকালে যখন আপনি বাড়ি ছেড়ে বেরোন ঠিক তখনই ব্যালকনির গ্রিল বেয়ে ব্যাগটা নিয়ে ও পালিয়ে আসে।” অতনু মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করে। পিছনে ডুকরে কেঁদে ওঠে রূপ-অপূর্বর মা, যিনি এতক্ষন সব শুনছিলেন। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঘরে। রূপ মাকে এতক্ষন খেয়াল করেনি। মায়ের উপস্থিতি তাকে বিচলিত করে তোলে। সে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলে ওঠে, “আমায় এরেস্ট করুন অফিসার। আমার লোভ থেকে বাবাও বাঁচতে পারেনি। ওই যে পলাশ নাথ, আমার বাবা। আমি আমার বাবার কিডনি বিক্রি করেছি। আমায় শাস্তি দিন।” অতনু রূপের দুগালে দুটি সশব্দ চড় মেরে তার চুলের মুঠি ধরে প্রশ্ন করে, “অপূর্বকে কোথায় রেখেছিস বল?” রূপ ঢোঁক গিলে কোনোমতে বলে, “অপু নেই?” রূপের মা চিৎকার করে ওঠেন, “নেই মানে? কি করেছিস তুই?”  রূপ একটা পৈশাচিক হাসি হেসে বলে ওঠে, “কবর দিয়েছি। একটা নির্মীয়মান বাড়ির নিচে কবর দিয়ে এসেছি। ছোটবেলা থেকে আমার পথের কাঁটা হয়ে বসেছিল। পৃথিবীর সব ভালো কি একজনের জন্যই বরাদ্দ? আমার টাকা চাই। ওতো এথিক্স কপচে পেট চলে না মা। বাবার আর কদ্দিন বাকি ছিল বলতো? কেন বেকার আটকালো আমায়? ও যেন কতো সাধু পুরুষ!” রূপের কথা শেষ হওয়ার আগেই এলোপাথাড়ি কিল চড় মারতে শুরু করেন রূপের মা। তার চোখ ভরা জল। দুই ছেলের অমানুষিক আচরণে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওঁর হৃদয়। মহিলা পুলিশ দিয়ে ওঁকে বিরত করে রূপের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেন তপন। অতনু অর্ডার দেন, “এই সাইকো ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানুন বডিটা কোথায় পুঁতেছে। আর নার্সিংহোম ও তার যাবতীয় নথিপত্র সিজ করুন। এই একটা সূত্র ধরে আমরা আরো অনেক কালপ্রিটদের ধরতে পারবো। সো বি কেয়ারফুল তপন।” তপন রূপকে নিয়ে চলে যায়। একে একে পরমা ও বিশ্বজিৎ লাহাও হ্যান্ডকাফ পরে এগোতে থাকেন। অতনু মিস্টার লাহার সামনে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আপনার টিমটা বেশ ভালোই ছিল জানেন তো। কিন্তু সমস্যা বাধল দুটো পেয়াদাকে নিয়ে। ওদের একজনের বিবেক জেগে উঠেছিল আরেকজনের চিরতরে মরে গেছিল। এবার আপনি হাজতে বসে ভেবে দেখুন বাকি জীবনটা আপনার বিবেক আপনাকে কোন রাস্তায়  নিয়ে যেতে চায়। নিজের কপাল তো পোড়ালেন সাথে মেয়েটাকেও নিলেন।” বিশ্বজিৎ লাহা তির্যক হাসি হেসে বলল, “দেখা যাক কতদিন হাজতে বসতে পারি।” অতনু তার ইঙ্গিত বুঝেও পাত্তা দিল না, বলল, “কনস্টেবল ওদের নিয়ে যাও।”
  সবার চলে যাওয়ার পর অতনুর চোখ পড়ল ঘরের এক কোণে বসে থাকা রূপ-অপূর্বর মায়ের দিকে। একমাত্র ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে সে কিছু বিড়বিড় করে যাচ্ছে। অতনু তার কাছে গিয়ে বলল, “ম্যাডাম আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।” তিনি তার উদ্বেগহীন চোখ দুটি অতনুর দিকে মেলে ধরে বললেন, “একটা ইট কাঠের খাঁচা ওটা। ঠিক পৌঁছে যাবো। অন্তত এই খবর টুকু দিতে তো যেতেই হবে যে আমি দুটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলাম।” তিনি চলে গেলেন। অতনু তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। গ্রীষ্মের গনগনে রোদে তার ক্লান্ত অবয়ব মিশে গেলো অবলীলায়। এভাবেই নষ্ট হয়ে যায় কতো স্বপ্ন, কতো জীবন। এই মৃত্যু গুলির কেউ হিসেব রাখেনা।
সমাপ্ত।

রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৯

কৃপণ কথা

কৃপণ-কথা
কেয়া চ্যাটার্জী
 ভবানীপুরের চারতলা বাড়ির ঝুল বারান্দা দিয়ে শহরের অনেকখানিই দেখতে পাওয়া যায়। আগে গাছগাছালিতে ভরা ছিল জায়গাটা। এখন ধীরে ধীরে বাড়ি-বহুতলে ছেয়ে যাচ্ছে এলাকা।
 আমাদের বাড়িটা অনেকদিনের পুরোনো। নিচের তলা দোকানকে ভাড়া দেওয়া। দোতলা, তিনতলায় থাকে ভাসুর আর দেওরের পরিবার, আমরা থাকি চারতলায়। আমাদের একটি মেয়ে। বিয়ে ও চাকরি নিয়ে পুনেতে বাসস্থান গেঁড়েছে। কলকাতা আসে বছরে একবার। আমাদের এই দুটি প্রাণীর জীবনে কোনো চাহিদা নেই আর। বুড়োবুড়ি দুজনা'তে বেশ সুখেই আছি।
 আমার বুড়ো ক'দিন আগেই অবসর নিলেন। প্রথম প্রথম অবসর জীবনটা বেশ উপভোগ করছিল কিন্তু মাস কাটতে না কাটতেই শুরু হলো বিরক্তি আর মন খারাপের টানাপোড়েন। আমিই বলে কয়ে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে পাঠাতে শুরু করলাম। এখন তিনি সকালে উঠে এক কাপ চা খেয়ে মর্নিং ওয়াকে যান। তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বাজার সেরে, খবরের কাগজের আদ্য শ্রাদ্ধ করে ন'টা নাগাদ ঘরে ঢোকেন। তারপর বই নিয়ে বসেন। ওটি তার বরাবরের স্বভাব। আমারও।
 এইভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু তাল কাটল একটা অদ্ভুত ব্যাপারে। আগেই বলেছি আমাদের বাড়ি অনেক পুরোনো। সেই বাড়িতে আজ পর্যন্ত ভগবানের কৃপায় উইপোকার উপদ্রব হয়নি। কিন্তু কয়দিন ধরেই দেখছি আরশোলার ভারী উৎপাত শুরু হয়েছে। এদিকে আমি সবজান্তা গৃহিনী ইঁদুরের ল্যাজ ধরে ফেলতে পারি, টিকটিকির কাটা লেজ ফেলতে পারে, ছুঁচোর সব ব্যাপারে নাক গোলানো বন্ধ করতে পারলেও এই আরশোলা বস্তুটিকে একটু সমঝে চলি। আসলে ওদের ব্রহ্ম অস্ত্র হলো ওই পাখনা দুটো। একবার মেলে দিয়ে যে কোথায় গিয়ে বসবে ভগা ন জনান্তি। যাইহোক, আমার কপালেই এই আরশোলা নামক বস্তুটি এসে জুটল। রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার বা ওভেনের পাশে, মশলার কৌটোর বক্সে, বাজারের ব্যাগে, ডিনার টেবিলে, বাথরুমে, বইয়ের তাকে, এমনকি ড্রেসিং টেবিলেও আরশোলা। ওই কদর্য চেহারা, লিকলিকে শুঁড়, খোঁচা খোঁচা ছ'টা পা দেখলেই আমার হৃৎপিন্ড তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে শুরু করলো। পাঁচ-ছয় দিন এরকম কাটলো। এবার সকাল থেকেই সঙ্গে একটা ছোট লাঠি রাখতে শুরু করলাম। যেখানেই দেখতাম সেখানেই খোঁচা, যখনই দেখতাম তখনই খোঁচা। কি আশ্চর্য! এতো খোঁচা খেয়েও পতঙ্গটা মরতো না। সে শুধু লাফিয়ে লাফিয়ে স্থান পরিবর্তন করতো।
একদিন সন্ধ্যেবেলা বসার ঘরে বসে টিভি দেখছি। মেগা সিরিয়াল আমার পোষায় না বাপু! খবরের চ্যানেল আর ডিসকভারি চ্যানেলেই কালাতিপাত করি। কত্তা এমন সময় দেখি টিভির ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার শত্রু। সেই খয়েরি রং, লিকলিকে পা, নোংরা শুঁড়। গা ঘিনঘিন করে উঠলো। হাতের কাছে পেলাম লাঠিটা। ধরে সবে কাজটা সারতে যাবো এমন সময় কে যেন বলে উঠল, “এই এই একদম খোঁচা দিবি না বলে দিলাম।” চমকে উঠলাম। কে বলল কথাটা? আরশোলা? না না, সে আবার হয় নাকি? লাঠি বাগিয়ে আবার এগিয়েছি এমন সময় আবার শুনলাম, “খবরদার!” এবার থমকালাম। নাঃ এতো মনের ভুল নয়। স্পষ্ট শুনছি কেউ হুমকি দিচ্ছে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “কে? কে কথা বলছে?” অমনি উত্তর এলো, “আমি রে আমি মৌমিতা।” ভাবতে বসলাম কে মৌমিতা, আমার সাথে তার কোথায় দেখা ইত্যাদি। কিন্তু মরচে পড়া স্মৃতির পাতায় তাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই আবার কণ্ঠস্বরটি বলে উঠলো, “চিনতে পারছিস না? আরে সেই যে তোর মেয়ে আর আমার ছেলে এক স্কুলে পড়তো। আমরা প্রতিদিন এক বাসে সঙ্গে যাওয়া আসা করতাম। আমি থাকতাম পঞ্চাননতলায়...” ঝপ করে মনে পড়লো, হ্যাঁ ঠিক তো। আমার মেয়ে তো সেই কোন ছোটবেলায় একটা প্লে স্কুলে পড়তো। সেই সময় বন্ধুত্ব হয় মৌমিতার সাথে। গোলগাল, বেঁটে খাটো চেহারার মানুষটি বেশ আমুদে ছিল। কিন্তু একটাই দোষ ছিল ― কিপ্টেমি। সেই নিয়ে অবশ্য ওকে কম খ্যাপানো হয়নি। তারপর মেয়েকে নিয়ে চলে আসা হয় এই বাড়িতে। ছোট স্কুল ছেড়ে বড় স্কুলের গন্ডিতে পা দেয় মেয়ে আর মেয়ের মা উভয়েই। 

     কিন্তু এতদিন পর সেই মৌমিতা কোথা থেকে এলো? চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যাঁ রে মনে পড়ছে। কিন্তু তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?” কণ্ঠস্বরটি উত্তর দিল, “কেন এই যে আরশোলার থেকে।” চমকে উঠে সোফায় পা গুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম , “ও মা গো! তুই  আরশোলা হয়ে গেছিস? এতদিন ধরে তুই আমার বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলি?” সে বলল, “হ্যাঁ রে অনেক দিন ধরে একটা জরুরি কথা বলার ছিল। সুযোগই পাচ্ছিলাম না। আজ হলো অবশেষে। কিন্তু তোর দেখছি মায়া দয়া কিচ্ছুটি নেই রে। এইটুকু একটা প্রাণীকে কেউ অতো বড় লাঠি দিয়ে খোঁচা দেয়!” আরশোলার পাখনা দুটো থেকে যেন এক ঝলক  দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, “জানিস তো আরশোলায় আমার ভয়। তাই আর কি...” সে বলল, “কি করবো বল। পুনর্জন্মের সেকশানে এতো লাইন পড়েছিল না! ধৈর্য্য রাখতে পারলাম না। তাই যার শরীর দিল বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলাম। মানুষ হলে একহাত তর্ক জুড়ে দিতাম কিন্তু অশরীরি কিনা, তাই বিশেষ ট্যাঁ ফুঁ করতে পারলাম না। যদি ব্যাটা নরকে পাঠিয়ে দেয়!” মৌমিতার ওরফে আরশোলার কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটু গম্ভীর হয়েই বললাম, “তা কি জরুরি কথা বলবি বললি যে?” আরশোলার দিক থেকে উত্তর এলো, “হ্যাঁ তা একটা আছে বৈকি। জীবন্ত অবস্থায় মনে ঘুরঘুর করতো জানিস তো। মরার পরেও দেখছি ভুলিনি। তাই তোর বাড়ি খুঁজে এলাম।” আমি একটু অধৈর্য হয়েই বললাম, “বল না কি কথা?” তারপর যে উত্তর এলো তাতে আমার চক্ষু চরক গাছ। শুনলাম, “আমার সেই সাত টাকা তো ফেরৎ দিলি না রে?”
 আমি আকাশ থেকে পড়লাম। “সাত টাকা? কিসের সাত টাকা?” প্রায় চিৎকার করেই বলে ফেললাম। ওদিক থেকে উত্তর এলো, “ভুলে গেছিস? জানতাম ভুলে যাবি। সেই যে একদিন বাসে তোর কাছে খুচরো ছিল না বলে কন্ডাক্টারের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধল তোর। আমি তোদের থামিয়ে তোর ভাড়াটা দিয়ে দিলাম। তুই বললি, মৌমিতা তোকে পরে টাকাটা দিয়ে দেবো। আমি শুধু ঘাড় নেড়েছিলাম। তারপর তুইও ভুলে গেলি। আমিই লজ্জায় চাইনি। কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরঘুর করতো কথাটা। আসলে স্বভাবটা একটু কিপটে গোছের কিনা। দেখ না এই জন্য মুক্তিও পাচ্ছি না।” আমি মুখে হাত চালিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কি করে পারিস মৌমিতা! এতটা কিপটে কেউ হতে পারে!” বলেই একটু সামলে নিলাম। এই মুহূর্তে ও  আমার থেকে শক্তিশালী। একে ভূত তার উপর আরশোলা। বললাম, “কিভাবে দেবো? তোর বাড়ি গিয়ে?” সে উচ্ছসিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ তাই কর তাই কর।” এই বলে সে  তার বেহালার বাড়ির ঠিকানা সমেত পথ নির্দেশিকা সব বলে দিল।
 পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। ভেবে অবাকও হচ্ছিলাম,  হাসিও পাচ্ছিল, শেষে কিনা ভূতের বাড়ি স্বেচ্ছায় চললাম। তাও আবার আরশোলা ভূত। সে আবার কথাও বলে। হা ঈশ্বর, এই দুনিয়ায় কতো কি না ঘটে। কথা অনুযায়ী এসে পৌঁছলাম একটা দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার সামনে একটা সাদা কাপড়ের গেট লাগানো। বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে শ্রাদ্ধ কাজ চলছে। আরো কিছু লোক এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। আমি সটান ঢুকলাম বাড়ির ভেতর। বসার ঘরেই বেশ কিছু লোকজন  বসে আছেন মাটিতে। একটি বছর ত্রিশের ছেলে পুরোহিতের সামনে বসে মন্ত্রপাঠ করছে। তার একটু দূরেই ফুল মালা মিষ্টিতে প্রায় ঢাকা পরে আছে মৌমিতার ছবি। ঘরের মধ্যে চোখ চালিয়ে বুঝলাম ওর স্বামীও বেশ কিছুদিন হলো গত হয়েছেন। “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।” পিছন ফিরে দেখি একটি সাতাশ আঠাশ বছর বয়সী বউ আমার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে। অনুমান করলাম হয়তো মোমিতার পুত্রবধূ। হেসে বললাম, “আমি আসলে মৌমিতার বান্ধবী। আমার মেয়ে আর ওর ছেলে একই স্কুলে পড়তো।” সে আস্বস্ত হয়ে বলল, “ও, কিন্তু মা তো...বুঝতেই পারছেন।” বললাম, “হ্যাঁ। আসলে ও আমার কাছে কিছু টাকা পেতো। তাই দিয়ে গেলাম।” মেয়েটির হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে প্রায় পড়ি মরি করে ঘর থেকে বেরোতে যাবো এমন সময় সে আমার হাত চেপে ধরে পাশের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “আপনিও?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমিও মানে?” সে আরো গলা নামিয়ে বলল, “আপনিও কি আরশোলার সাথে কথা বলেছেন?” চোখ গোল গোল করে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। সে বলল, “আর বলবেন না, পুজোর সময় একটা তিন হাজারের জামদানি আদায় করেছিলাম বরের থেকে। তা আমার শাশুড়ি মায়ের পছন্দ হয়নি। তখন কিছুই বলেননি। মৃত্যুর কিছুদিন পর আলমারি খুলে দেখি ঠিক ওই শাড়ি টার ওপর বসে আছে একটা আরশোলা। ভয়ে চিৎকার করে সরে গেলাম। ওমা অমনি শুনি আরশোলাটা শুঁড় নেড়ে বলছে, “এই শাড়িটা কিন্তু দুই হাজার দাম বৌমা। হাজার টাকা অযথাই খোকার থেকে ঝাপলে। পরেরবার আর করো না কেমন। টাকা তো আর গাছে ফলে না।”  আমি তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। বলুন তো আর ঐ শাড়ি পড়া যায়!” আমি হাসবো না কাঁদবো ভেবে পেলাম না। সত্যি মৌমিতা কিপ্টেমির একটা লিমিট থাকতে হয়! মেয়েটি বলল, “তা আন্টি এসেছেন যখন একটু বসুন। একটু জল মিষ্টি খেয়ে যান।” আবার মিচকি হেসে বলল, “পাশের ঘরে গিয়ে দেখুন তো পরিচিত কাউকে পান কিনা?” পাশের ঘরে গিয়ে সত্যিই অবাক হলাম। আরো জনা কয়েক মহিলা বসে আছে। তাদের মধ্যে দু তিনজন পরিচিত। যে স্কুলের সুবাদে মৌমিতার সাথে আলাপ হয়েছিল, সেই স্কুলেরই বান্ধবী এরা। এদের সাথেও একই ঘটনা ঘটেছে। কারুর কাছে দশ টাকা বাকি ছিল, কারুর কাছে পাঁচ টাকা। ঘটনাটা এতটাই তাজ্জব ও হাস্যকর যে কথার মাঝখানে হাসি চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এদিকে শোকের বাড়ি কোনোভাবেই উচ্চ হাসি এলাউড নয়। বৌমাকে সাবধানে থাকতে বলে আমরা কজন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বেশ একটা রিইউনিয়নই হয়ে গেল আমাদের। কতো কথা, কতো স্মৃতি। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মৌমিতাকে। ওর জন্যই তো গতানুগতিক সংসারিকতার বাইরে আজকের দিনটা পেলাম।
 বেশ খোশ মেজাজেই সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরেছি। দরজা দেখি আলগা ভাবে বন্ধ। খুলতেই চোখ পড়লো সোফায় বসা কর্তা মশায়ের ওপর। এই সময় সাধারণত থাকেন না। আজ আমি নেই বলেই হয়তো রয়েছেন। এখুনি বেরোবেন। কিন্তু তার চোখ মুখ তো ঠিক লাগছে না। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছেন দেওয়ালের দিকে। হাতের খবরের কাগজটা বারে বারে কেঁপে উঠছে। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি গো, কি হলো?” অমনি চমকে উঠে, “কে কে করে চিৎকার করে উঠলেন।” আমিও গলা চড়িয়ে বললাম, “এই যে আমি আমি। কি হয়েছে?” তিনি কিছুই বললেন না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় গেছিলাম। আমিও কাল সন্ধ্যে থেকে আজ বিকেল অব্দি সব কিছুর বৃত্তান্ত দিলাম। এটাও বললাম যে কাল রাতে উনি যদি ভয় পান সেই চিন্তায় কথাটি চেপে গেছিলাম। কর্তা মশাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, “এরকম হয় বোলো?” আমিও বললাম, “হম হয় তো।” তারপর চোখ কুঁচকে বললাম, “তা তোমার যদি কোনো ধার দেনা থেকে থাকে, দিয়ে দাও, বুঝলে?” কথাটা শুনেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মানি ব্যাগটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ফিরতে দেরি হবে বলে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমি দেওয়ালে ঝুলন্ত টিকটিকির দিকে তাকিয়ে বললাম, “চিন্তা করবেন না ঠাকুরপো আপনার পাওনা গন্ডা আজকেই শোধ পেয়ে যাবেন।” মনের ভুল কিনা জানিনা, মনে হলো যেন টিকটিকিটা লজ্জায় পর্দার আড়ালে মুখ লুকালো।

প্রেমের কোলাজ


প্রেমের কোলাজ
কেয়া চ্যাটার্জী
কোলাজ-১
গড়িয়া হাটের মোড়ে এক বিখ্যাত সারির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুদেষ্ণা। দাঁড়িয়ে আছে আর ঘড়িতে সময় দেখছে। আধঘন্টা হয়ে গেল রোদ্দুরের পাত্তা নেই। খান দশেকবার কল করেছে সুদেষ্ণা, রোদ্দুর ফোন ধরেনি। আর মিনিট দশেক দেখেই বাড়ির দিকে রওনা দেবে ঠিক করল ও।
কোলাজ-২
এনজিওর অফিস থেকে বেরোতে দেরী হয়ে গেল রোদ্দুরের। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে কাজ করার পর যেটুকু ফাঁকা সময় থাকে এনজিওর কাজে ব্যয় করে সে। আজ প্রায় পনের দিন পর সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে। আজ আবার হাগ ডে না কি সব আছে! অতশত জানেনা রোদ্দুর, মানেও না। তবু প্রেয়সী যদি এটুকুতে খুশি হয় হোক না। কিন্তু আজও দেরি। আস্ত রাখবে না আজ সুদেষ্ণা ওকে। কিন্তু আজ একবার আসতেই হত। বসে ওঠার আগে এক গোছা গোলাপ ফুল কিনে নিল রোদ্দুর।
কোলাজ-৩
"আমায় একটু আদর করো না পার্থ। কতদিন কাছে টান না আমায়!" আদুরে গলায় বলল সোহাগ।
পার্থ মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে উদাসীন গলায় বলল, "তোমারই তো পিরিয়ড হয়ে গেল, আমি কি করব?"
"সেক্স ছাড়া কি আদর হয়না?" রাগতভাবে পিছন ফিরল সোহাগ। পার্থ আড় চোখে একবার স্ত্রীকে দেখে আবার স্ক্রিনে মনোনিবেশ করল। পার্থর বেড়ে চলা উদাসীনতা সোহাগের ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। কলেজ, টিউশনের পর বাকি ফাঁকা সময় পার্থ নতুন ব্যবসার কাজে ব্যয় করে। ছেলের পড়াশুনা, স্কুল, সোহাগের রোজনামচা কিছুরই খোঁজ খবর রাখে না। সোহাগও ভীষণ নিস্পৃহ হয়ে পড়েছে দিন দিন। গতানুগতিক কাজ ও কথা ছাড়া আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার। তবু মাঝে মাঝে ভিখারিনীর মত চেয়ে বসে প্রেমের ছোঁয়া, প্রত্যাখ্যান বুকে নিয়ে পাশ ফিরে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে সে।
কোলাজ-৪
দীর্ঘ আট বছর পরেও সংসারের কাজে অপটু সোহাগ। ছেলেকে স্কুলে দেয়া-নেয়া বাদে যা কিছু টুকটাক কাজ করে। কিন্তু বড় সর দায়িত্বগুলো মায়ের কাঁধেই ন্যস্ত। বিরক্তি দিনে দিনে বাড়ছে পার্থর। বন্ধুর বৌরা কয়েক দিনেই সংসারের হাল ধরে নিয়েছে। সোহাগ এখনো পারেনি। অথবা হয়তো চায়না। ঘটকের মাধ্যমে আনা সম্বন্ধে তাদের বিয়ে। আটবছর পরে পার্থ ভাবে বিয়েটা বড় ভুল হয়ে গেছে।

Huggies Wonder Pant.

কোলাজ-৫
হাত দেখিয়ে টাক্সিটা দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ল সুদেষ্ণা। ওপরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল রোদ্দুর। তার মুখে চাপা হাসি, হাতে একগোছা গোলাপ। রোদ্দুর জানে গোলাপ সুদেষ্ণার বড় প্রিয়। তবু এই প্ররোচনায় পা দেবে না ও। গম্ভীর হয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, "গলফ গ্রীনের দিকে চলুন।" রোদ্দুর কিছু না বলেই বসে রইল।  রাগ আরো বেড়ে গেল সুদেষ্ণার। ঢাকুরিয়া লেকের পাশ দিয়ে ছুটে চলা গাড়িটিকে হঠাৎ থামতে বলে ভাড়া মিটিয়ে হাত ধরে টেনে নামল রোদ্দুর সুদেষ্ণাকে। একপ্রকার টানতে টানতেই নিয়ে গেল লেকের ধারে। একটা গাছের গুঁড়ির গায়ে প্রেয়সীকে সেঁধিয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল সে। সুদেষ্ণা এতক্ষন পর দেখল রোদ্দুর তার দেওয়া পাঞ্জাবিটা পড়েছে। মেরুন রঙে তার ফর্সা চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়েছে। "শাড়িটা তো বেশ মানিয়েছে।" হেসে বলল রোদ্দুর। তার সুধী আজ পড়েছে তার প্রথম চাকরির মাইনেতে কেনা বাসন্তী রঙের শাড়ি। সুধীর শ্যামবর্ণ আরো উজ্জ্বল বসন্তের ছোঁয়ায়। রোদ্দুরের চোখের দিকে তাকাতে বড় ভয় করে সুদেষ্ণার। যেন মনের সব রাগ, অভিমানের পাহাড় নিমেষে গলে জল হয়ে সমুদ্রের তরঙ্গ তোলে সারা শরীরে। সুদেষ্ণা বিহ্বল হয়ে যায়। রোদ্দুর তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে ওর অসহায়তা।
একটা সিমেন্টের বাঁধানো সীটে ওরা বসল। মোবাইলের স্ক্রিনে আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রোদ্দুর দেখাচ্ছিল ওদের এনজিওর আজকের কর্মকান্ড। দুঃস্থ দের বস্ত্রদান করে আগমন জানানো হল ঋতুরাজ বসন্তকে। রোদ্দুরের কাঁধে মাথা রেখে সদ্য থার্ড ইয়ার পাস সুদেষ্ণা বলে,  "আমি যখন চাকরি পেয়ে যাব তোমার এনজিও জয়েন করব।" রোদ্দুর হেসে তার কপালে কপাল ঠুকে বলে, "ঠিক আছে। প্রেমটা তবে ওখানেই করব।"
কোলাজ-৬
নিজের বাড়িতে মদ খেতে পারেনা পার্থ। বাবা মার চোখে পড়ল লজ্জার শেষ থাকবে না। এক বন্ধুর  ফ্লাটে রবিবারের সান্ধ্য আড্ডা জমেছে। এখানে এলে মনটা একটু হালকা হলেও দীর্ঘশ্বাসটা আরো ভারী হয় সোহাগের। অন্য বন্ধুদের দেখে, তাদের খুনসুটি দেখে ভালো লাগে ওর। আড় চোখে পার্থকে দেখে সে। এখন সে এক অন্য মানুষ। উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, মজারু। বাড়ি ফিরেই পাল্টে যাবে লোকটা।  হয়তো সাময়িক খেলায় মাতবে কিছুক্ষণের জন্য। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়বে। অতৃপ্ত মন ও শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে সোহাগ। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল সোহাগের। বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষন কথা বলে ফিরে এল সে। বাড়ি ফিরে ব্যাগ গোছাতে আরম্ভ করে সোহাগ। পার্থ অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইল। "বিশ্বভারতীর চাকরীটা হয়ে গেছে। আমি কালই গিয়ে জয়েন করব। ঋষির পড়াশুনার ব্যবস্থাও করে নিয়েছি।" নিস্পৃহভাবে বলল সোহাগ। পার্থ অবাক হয়ে বলল, "বাহ সব ব্যবস্থাই তো করে নিয়েছ। না বলে গেলেই পারতে! " সোহাগ নিস্পৃহ হয়ে বলল, " ঐটুকু সহবত আমার আছে।" পার্থ নিস্পলক তাকিয়ে রইল তার আট বছরের পুরনো স্ত্রীকে। এতটা কাঠিন্য তো দেখেনি আগে!
ধীরে ধীরে সে গেল সোহাগের স্টুডিওতে। এখানে বসেই সে রং দিত তার কল্পনাদের। সোহাগের ছবিরা কথা বলে উঠত। পার্থর একটা পোট্রেট এঁকেছিল সোহাগ। "পারব কি ছেড়ে থাকতে?" ছবিটার গায়ে হাত বুলিয়ে নিজের মনেই বলে উঠল সে।
কোলাজ- ৭
দরজাটা খুলে দিল একটি বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে। আজ তিনমাস পর সোহাগকে দেখবে পার্থ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে পার্থর কপালে, হাতটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। নার্ভাস লাগছে পার্থর। ঋষির বহু অনুরোধে ও আবদারে দোল পূর্ণিমা উৎযাপন করতে এসেছেন পার্থ শান্তিনিকেতনে। সঙ্গে যদিও মা বাবাও আছেন তবু ভয় হচ্ছে তার। প্রায় তিনমাস কথা হয়নি সোহাগের সাথে। কেমন আছে সে? পার্থকে ছেড়ে হয়তো সুখেই আছে। স্বাধীন আছে।
মেয়েটিকে পাস কাটিয়ে ঘরে ঢুকল পার্থ। ঘরে আরো কিছু মেয়ে বসে। সোহাগ একটি নিচু সোফায় বসে কিছু বলছে ওদের। পার্থকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে সে বলল, " আজ আর হবে না। সুদেষ্ণা, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে যেও প্লিজ।" সবাই ধীরে ধীরে প্রস্থান করল। পার্থ ইতস্তত করে বসল সোফায়। সোহাগ জিজ্ঞেস করল, "মা-বাবা এসেছেন?"
― হ্যাঁ। বাইরে আছেন।
সোহাগ অবাক হয়ে বলল, "বাইরে? বাইরে কেন?"
সোহাগ গটগট করে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষন পর পার্থর মা-বাবাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। সন্ধ্যে নামতেই ঋষি ফিরল স্কুল থেকে। এমনিতে রোজ বিকেল বিকেল ছুটি হয় কিন্তু কিছুদিন হল রিহার্সালের জন্য দেরী হচ্ছে ফিরতে। ঠাকুমা দাদুকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল কোলে। বাবার সঙ্গে কিছু সৌজন্যমূলক কথা হল। পার্থ বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার সঙ্গে প্রয়োজনাতিরিক্ত একটা কথাও সোহাগ বলছে না। পার্থর যেন কোনো অস্তিত্বই নেই তার জীবনে। ভীষণ অভিমান হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে প্রফেসর পার্থ বোস। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, "চলি। রুম বুক করে এসেছি। অনেকটা গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।"
সোহাগ নিস্পৃহের মত উত্তর দিল, "বাবা মা এখানেই পাশের ঘরে থাকবেন ঋষির সাথে।"
পার্থ মা বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝল বহুদিন পর নাতি কে কাছে পাওয়ার আনন্দ তারা হারাতে চাইছেন না। অব্যক্ত অভিমানের পাহাড় বুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। আসবে না, আর কোনোদিন দেখবে না সে সোহাগের মুখ।
কোলাজ-৮
হাত থেকে বইগুলো পরে গেল সুদেষ্ণার। ও কে দাঁড়িয়ে গাছের নীচে? হলুদ টি-শার্ট, নীল ডেনিম। রোদ্দুর! সুদেষ্ণা ছুটে গেল কলাভবনের মেন গেটের দিকে। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। "তুমি? এখানে? কবে এলে? জানাওনি কেন?" রোদ্দুর হেসে বলল, "রোষ রোষ প্রিয়ে। থামো। একটু দম নাও। প্রশ্নের মিছিল নামিয়ে দিলে যে!" সুদেষ্ণা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কিছুক্ষন গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রায় ছমাস পর রোদ্দুরকে দেখছে সে। রোদ্দুর বুঝতে পারছে তার প্রেমিকার মনের অবস্থা। হাতের ওপর টোকা দিয়ে বলল, "ম্যাডাম, ক্লাস যে শুরু হয়ে গেল। দৌড়োও। বিকেলে এখানেই দাঁড়াবো। দেখা হবে।" সুদেষ্ণা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চলল ক্লাসের দিকে। পিছন ফিরে ফিরে বারে বারে দেখতে লাগল।
রোদ্দুর দাঁড়িয়ে থাকল যতক্ষণ সুদেষ্ণাকে দেখা গেল। তার সুধী পথের বাঁকে মিলিয়ে যেতেই ফিরল সে হোটেলের দিকে।
প্রায় ছমাস আগে সুদেষ্ণা চলে আসে শান্তিনিকেতনে আর্ট নিয়ে পড়তে। রোদ্দুর পরে থাকল ইঁট কাঠ পাথরের জঙ্গলে। ফোনে কথা হলেও, ভিডিও কলে দেখা হলেও সামনা সামনি দেখার অনুভূতিই আলাদা। কাল দোল পূর্ণিমা। প্রেমিকার গাল আবিরে না রাঙাতে পারলে বছরটাই মাটি। তাই সুদেষ্ণাকে কিছু না জানিয়েই, অফিসে দুদিনের ছুটি নিয়ে চলে এসেছে সে।
হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়ল মিউজিয়ামের গেটে। একি স্যার? রোদ্দুর দৌড়ে গেল। "স্যার, স্যার।" পিছন ফিরল পার্থ। দৌড়ে আসছে একটা ছেলে। তাকে উদ্দেশ্য করেই হয়তো। কাছে আসতেই বুঝতে পারল ২০১৪ ব্যাচের রোদ্দুর। দুনম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পায়নি ছেলেটা। কোনো চেষ্টাও করেনি। ওর বন্ধুরা বিদেশে গিয়ে পি.এচ.ডি করছে, এদিকে ও একটা সামান্য চাকরি আঁকড়েই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে। একা মাকে ছেড়ে ও বিদেশে গিয়ে নাকি বাঁচতে পারবেনা। বড্ড বোকা তবু ভীষণ মন ভালো হয়ে যায় ওকে দেখলে। এগিয়ে এসে বলল, "স্যার আপনি এখানে?"
― এই ঘুরতে এসেছি। তোমাদের ম্যাম এখানে কলাভবনে প্রফেসর।
পার্থ অনুভব করল তার বুকের ভিতরটা গর্বে ভরে উঠছে। "তা তুই? কোনো কাজে নাকি ঘুরতে?"
― আমি স্যার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ও কলাভবনের স্টুডেন্ট। হয়তো ম্যামকে চেনে।
পার্থর অভিজ্ঞ চোখ শব্দের বন্ধু আর অন্তরের বান্ধবীর খোঁজ পেয়ে গেল। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, "বেশ তবে ঘোর ভালো করে। কাল দেখা হবে।" রোদ্দুর মাথা নেড়ে সায় জানালো। যাওয়ার আগে একটা প্রণাম সেরে নিল। পার্থ আলতো করে চুলটা ঘেঁটে দিল ওর। পুরোনো খুশি খুশি মুখ গুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। গেট পেরিয়ে প্রবেশ করল সে রবিকবির ফেলে আসা জগতে। কাল বসন্ত পঞ্চমী। সোহাগ কি আগের মতোই তাকে রাঙিয়ে তুলবে?
#কোলাজ_৯
লোকে লোকারণ্য উৎসবের মাঠটি। মাঝখানে একটা বড় মঞ্চ। ছাত্র ছাত্রীরা প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তবলা-বায়া, হারমোনিয়াম, গিটারে সজ্জিত ছেলে মেয়েদের ঠিক বসন্তের পাখিদের মত দেখাচ্ছে। এখনো উৎসব শুরু হয়নি। জীবনে এই প্রথম বসন্ত উৎসব দেখা পার্থর। সোহাগ আর ঋষি এখানে না এলে হয়তো জীবনের জিগস এর এই খোপটা অসম্পূর্ণই থেকে যেত। সোহাগও ভারী ছিমছাম অথচ সুন্দর করে সেজেছে। ঘরের কাজ গুলোও আগের তুলনায় চটপট সেরে বেরিয়ে এসেছে। ঋষি এই ছবছর বয়সেই বেশ স্বনির্ভর। নিজেকে বড় এক লাগছে আজ। কোথায় তার অবস্থান? সেকি শুধুই একজন কর্মজীবনে  সফল ব্যক্তি? ভালো স্বামী, ভালো বাবা, ভালো ছেলে... চিন্তায় ছেদ পড়ল তার মিনছে শুরু হয়েছে উদ্বোধনী সংগীত সাথে ছাত্র ছাত্রীদের নৃত্য পরিবেশনা। মঞ্চের চারিধারে একটি ছেলেকে ঘুরে বেড়াতে দেখছে পার্থ। ভালো করে দেখে বুঝল ছেলেটি রোদ্দুর। একটি মেয়ের ছবি তুলেই চলেছে। নিজের মনেই হেসে ফেলল পার্থ। এই তবে সেই বন্ধু! সোহাগ পার্থর বাবা মা আর ঋষিকে নিয়ে ব্যস্ত। আরেকদিকে মঞ্চের কাজের দিকেও সমান নজর রাখছে। সোহাগ কি এতটা দক্ষ ছিল কোনোদিন? নাকি সুযোগই পায়নি ও কখনো নিজেকে প্রকাশ করার। এতদূরে এত অপরিচিতদের ভিড়ে কোথাও হয়তো সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। আরেকটি সময় দিলে হয়তো এই সোহাগকে এতদূরে এসে চিনতে হতো না পার্থর।
ঋষি উঠেছে মঞ্চে। গান করছে। "ফুলে ফুলে, ঢলে ঢলে, বহে কিবা মৃদু বায়..." মঞ্চের, সোহাগের খুব কাছে চলে এল পার্থ। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আজ আনন্দের এই মুহূর্তটা সোহাগের সাথে ভাগ করতে না পারলে যে এর মূল্যটাই থাকবেনা। উত্তেজনায় চেপে ধরল সে সোহাগের হাতটা। সোহাগ চমকে তাকাল, তার চোখেও জল। বাৎসল্য প্রেম সমস্ত অহংকার, ভুল বোঝাবুঝি, ইগোর দ্বন্দ্বকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে।  তারা দুজন যে একই নৌকার কান্ডারী। সেই নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ভালোবাসার পথে, সম্পর্কের গভীরতার পথে, বিশ্বাসের পথে, ধৈর্য্যের পথে।
ঋষি দৌড়ে এলো। মা বাবাকে একসাথে দেখে তার খুব ভালো লাগলো। জড়িয়ে ধরলো সে দুজনকে। ঋষিকে কোলে নিয়ে সোহাগের হাত ধরে বেরিয়ে আসে ভিড় ঠেলে। তাদের সব  অভিমান ভুলে এগিয়ে যেতে হবে তাদের সৃষ্ট আগামীর জন্য।
কোলাজ- ১০
সুদেষ্ণার চোখের জল মুছে ট্রেনে উঠে পড়ল রোদ্দুর। এবার যাওয়ার পালা। "আবার আসবো। তোমার অপেক্ষায় থাকবো। কেঁদো না প্লিজ।" সুদেষ্ণা হাসে। সে স্বপ্ন দেখে আগামীর। ভবিষ্যতে একসাথে থাকার। ভালোবাসার। ট্রেন চলে গেল। "পরেরবার এসে সাইকেল চড়বো।" জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে রোদ্দুর। তার চোখে ভাসতে থাকে কলকাতার দিনগুলো। কাঁধে মাথা, হাতে হাতের দিনগুলো। এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার ঠোঁটে। মুহূর্তরা ভীষণ দামী। অমূল্য।
  পার্থ গাড়িটা স্টার্ট দেয়। ঋষি মুখ লুকিয়ে আছে মায়ের কোলে। সে তার চোখের জল লুকোনো শিখে গেছে। পার্থ আর সোহাগ পরস্পরের দিকে তাকায়। অনেকদিন পর তারা একসাথে হাসে। পার্থ নেমে এসে ঋষিকে জড়িয়ে ধরে বলে, "আর কটা দিন অপেক্ষা করো, পাপা এখানেই চলে আসছে। বরাবর।" ঋষি বিস্ময়ে তাকায় মা বাবার দিকে। তারা হাসছে। তারা তার জন্যই হাসছে। পার্থ উঠে দাঁড়িয়ে সোহাগের চোখের দিকে তাকায়, " তোমার অসম্পূর্ণতাই আমার সম্পূর্ণতা সোহাগ। আর আমার অসম্পূর্ণতা তোমার। আমরা আলাদা থাকতেই পারে না।"
পার্থ-রোদ্দুর চলে গেল। চলে গেল ফিরে আসার জন্যই। পার্থ- সোহাগ, রোদ্দুর- সুদেষ্ণারা একটা রঙিন কোলাজ তৈরি করে চলেছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।
(সমাপ্ত)

ল্যুভ মিউজিয়াম

 #ঘরকুণোর_বিদেশ_যাত্রা #কেয়া_চ্যাটার্জি প্যারিস পর্ব • #ল্যুভর মিউজিয়াম ও প্যারিসের একটি সন্ধ্যে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ যখন প্যারিস শহরটি এতটা বিস...