নিখোঁজ?
কেয়া চ্যাটার্জী
দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো একটি মেয়ে। চুলগুলো এলোমেলো, বিধ্বস্ত চেহারা, চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় আগের রাতে ঘুমায়নি। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা তড়িঘড়ি বের করে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, "এই ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ কিছু করুন।" কদমতলা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অতনু বিশ্বাস ভীষণ শান্ত স্বরে বললেন, "বসুন। জল খান। তারপর ঠান্ডা মাথায় সব কিছু বলুন। আগে অভিযোগ লিখি। সব কিছুরই তো একটা নিয়ম আছে।" মেয়েটি একটু স্থিতু হওয়ার পর বলতে শুরু করলো, “আমি পরমা লাহা। ছবিটা আমার বন্ধু অপূর্ব নাথের। আমরা একই কলেজের বন্ধু।”
― বন্ধু না বয়ফ্রেন্ড? বলে রাখলে সুবিধা হয় আর কি।
অফিসারের প্রশ্নে একটু ইতস্তত করে পরমা বলল, “হ্যাঁ, বয়ফ্রেন্ড। পাঁচ বছরের সম্পর্ক। গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি ব্যাঙ্গালোর যাই একটা কোর্সের জন্য। আর অপূর্ব এখানেই থেকে যায়। একটা চাকরি পেয়েছিল। আমাদের প্রায়ই কথা হতো ফোনে, মেসেজে। গত দু বছরে চার-পাঁচ বার কলকাতা এসে দেখাও হয়েছে। কিন্তু লাস্ট একসপ্তাহ কিছুতেই ওর কোনো ট্রেস পাচ্ছি না। ফোন বন্ধ, মেসেজ বা ভিডিও কলের তো প্রশ্নই ওঠে না।” গলা কেঁপে ওঠে পরমার।
― বাড়িতে ফোন করেছেন? বা অন্যকোনো বন্ধুদের?
― ওর বা আমার বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা জানে না। তবে একজন বন্ধুকে দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। ওখানেও নেই। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কারুর কাছেও ওর কোনো খোঁজ নেই।
― ছেলেটির ঠিকানা দিন।
পরমা ফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করে বলল, "আসল বাড়ি কৃষ্ণনগর। ওখানকার ঠিকানা জানিনা। এখানে চেতলায় থাকতো। ভাড়া বাড়ির ঠিকানা এটা।”
অতনু বাবু দেখলেন স্ক্রিনে ভাসছে একটি তেইশ চব্বিশ বছর বয়সী ছেলের ছবি। খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি আর জিন্সে, তার এলোমেলো চুল আরো মোহময়ী। একটি দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে, দেওয়ালে একটি শ্বেত পাথরের ফলকে খোদাই করা ঠিকানা ২/২এ, গোবিন্দ আঢ্য রোড।
দিন সাতেক কেটে গেছে। হাতে কিছু ছোট খাটো কেস মিটিয়ে অতনু বাবু অপূর্বর কেসে মনোনিবেশ করলেন। বাড়িটা পুরোনো আমলের। সমস্ত প্রটোকল ভেঙে রাস্তার ধার ঘেঁষে উঠে গেছে বাড়ির দেওয়াল, সামনেই দরজার দুধারে লাল সিমেন্টে বাঁধানো রক। কলিং বেল নেই। লম্বা দরজার গোল লোহার কড়া বার তিনেক নাড়াতেই খট করে ভিতর থেকে খুলে গেল দরজাটি। সামনে দাঁড়িয়ে একজন বয়স্ক লোক। গাল ভর্তি সাদা দাঁড়ি-গোঁফ, পরণে একটি ফতুয়া আর হাঁটু অবধি ওঠানো ধুতি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পুলিশ দেখে একটু হকচকিয়ে গেছেন। শীর্ণ শরীরে একটু বল এনে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার?” অতনু বাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বললেন, "একটি ছেলের খোঁজে এসেছি। বসে কথা বলা যাক?” উঠোনেই একটি চেয়ারে বসার ব্যবস্থা হলো। উঠোনের একপাশে কুয়োতলা ও বাথরুম। বাড়িটি দুতলা তবে জীর্ণ। আয়তন ও পজিশনের জন্য যেকোনো প্রোমোটারের কাছে অতি লোভনীয়। অপূর্বর ছবি দেখে বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “হ্যাঁ ও তো এখানেই থাকতো। প্রায় পাঁচ বছর ছিল। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে। মাঝখানে একটা চাকরিও পেয়েছিল। ভাড়া সময় মতোই দিত।” অতনু বাবু বললেন, “তারপর? ভাড়া তুলে দিলেন, নাকি নিজেই চলে গেল?” বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “আমি কেন তুলবো স্যার? ঝামেলা তো কিছু ছিল না ছেলেটার। সকালে বেরোত, রাতে ফিরত। আরো পাঁচ ঘর ভাড়া থাকে নীচ-ওপর মিলিয়ে। অপূর্ব নিজেই এক সন্ধ্যেবেলা এসে বলল, “কাকু অফিস মুম্বাইতে পোস্টিং দিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে দেবো।” আমার একটু খারাপই লাগলো। এতদিন ছিল ছেলেটা। তার দুদিন পরেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।” অতনু একবার তার ঘরটা দেখে এলেন। নেহাতই ছোট একটা আদ্দিকালের ঘর, তার কোথাও কোনো রহস্য নেই। নতুন ভাড়াটের জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে, ফলে কোনো রকম ক্লু পাওয়ার ভাবনাও অলীক। অতনু বেরিয়ে এলেন। বৃদ্ধকে বললেন, “কোনো রকম খবর যদি পান আমায় ফোন করবেন।” বৃদ্ধ একটা কাগজে অতনুর মোবাইল নম্বর লিখে নিয়ে ঘাড় নাড়লেন।
https://www.amazon.in/Avengers-Kidsville-Sweatshirt-STY-18-19-005851_Blue_13-14-Years/dp/B07SL43J6T/ref=as_sl_pc_qf_sp_asin_til?tag=keya230b-21&linkCode=w00&linkId=74812a4b834d1bdd2e6ce0303a64cd07&creativeASIN=B07SL43J6T
এরপর যেতে হবে ছেলেটির অফিসে। পরমার কথা অনুযায়ী অফিসটা রাজারহাটে। ঠিকানা অনুসরণ করে অতনু এসে পৌঁছলো একটি চারতলা বাড়ীর সামনে। দেখলেই বোঝা যায় বাড়ীটা পুরোপুরি কমার্শিয়াল। বাড়ীটির তিনতলায় রিসেপশনে এসে অপূর্ব নাথের নাম নিলে মেয়েটি কিছুক্ষন ভ্রূ কুঁচকে ভেবে নিয়ে কম্পিউটারে ডেটাবেস দেখে বলল, “হ্যাঁ, এই ছেলেটি এখানে কাজ করতো, কিন্তু প্রায় দেড়-দু সপ্তাহ হলো ও কিছু না জানিয়েই আসছে না। আমরা মেইল করি, ও রিপ্লাই দেয় না, ফোনও বন্ধ। অগত্যা ওর পোস্টে নতুন ছেলে এপয়েন্ট করা হয়।” অতনু বললেন, “ওকে কি মুম্বাই ট্রান্সফার করা হয়েছিল এর মধ্যে?” মেয়েটি আবার কম্পিউটারে চোখ বুলিয়ে বলল, “না তো স্যার। সেরকম কোনো ইনফরমেশন এখানে নেই। আর ছেলেটি কাজে join করেছে মাস দুই হয়েছে। এর মধ্যে হেড অফিসে পোস্টিংয়ের কোনো চান্সই নেই।” অতনু কিছুক্ষন চুপচাপ চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে ম্যাডাম, ওর বাড়ীর ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিন। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।” অফিস থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ও তাঁর সহযোগী মৃণাল রায়কে ফোন করে সব ডিটেইলস দিয়ে খোঁজ নিতে বলে অতনু চললেন পরমার বাড়ী।
“দেখুন অফিসার, এটা তো আর আমরিশ পুরী আর শাহরুখ খানের সিনেমা নয় যে ভিলেনের মেয়ের সাথে প্রেম করছে দেখে ভিলেন হিরোকে সরিয়ে দিলো। আপনি যদি আমায় সন্দেহ করে থাকেন তাহলে আপনি ভুল করছেন। আমি ছেলেটিকে চিনিনা।” গরম কফি খেতে খেতে সাততলার বিশাল এপার্টমেন্টের ড্রয়িং রুমে বসে জানালেন বিশ্বজিৎ লাহা, পরমার বাবা। একটু দূরেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে পরমা। পাশের সোফা আর চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসে আছে আরো জনা কয়েক সমবয়সী ছেলেমেয়ে। তারা সকলেই পরমা আর অপূর্বর ক্লাসমেট বা ব্যাচমেট। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “অপূর্বর সাথে অনেকদিনই কোনো যোগাযোগ ছিল না আমাদের। আসলে ও নিজেই যোগাযোগ রাখতে চায়নি বলা যায়। কিছু একটা লুকিয়ে রাখতো আমাদের থেকে। আমরাও ওর ব্যবহারে খুব বিরক্ত হতাম। ওর অফিস বা কাজ সম্পর্কে কিছুই বলতে চাইতো না। ধীরে ধীরে, যা হয় আর কি, সম্পর্ক রইল না।” অতনু পরমার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনিও কি কিছুই জানতেন না পরমা?” পরমা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। অতনু বোঝেন অপূর্ব কোনো এক চক্রে আটকে পড়েছে যার ব্যাপারে সে কাউকে কিছুই বলতে চায়নি বা পারেনি। লোক দেখানো একটা চাকরি সে জুটিয়ে রেখেছিল কিন্তু তলে তলে জড়িয়েছে আরো বড় কোনো জালে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়লেন তিনি। কেসটা একটু জটিল। কোনো সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না এই রহস্যের কিনারা করার মতো। বাইকে করে বেশ কিছুটা চলে এসে অনুভব করলেন পিছনে যেন আরেকটা বাইক তাকে অনুসরণ করছে। ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে দিতে পিছনের বাইকটা কাছাকাছি এসে পড়ল। অতনু দেখলেন অপূর্বর বন্ধুদের একজন। কাছে এসে সে বলল, “ভালো করেছেন বাইকটা থামিয়ে, আপনাকে ডাকতেও পারছিলাম না, আবার আপনার বুলেটের সঙ্গে পাল্লা দিতেও পারছিলাম না।” বলেই হাসল ছেলেটি। মুখটি বেশ গোলগাল ও হাসিখুশি।অতনু বললেন, “এমন কিছু কি বলতে চাও যেটা ওখানে বলতে পারছিলে না?” ছেলেটি এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “কোথাও গিয়ে বসলে ভালো হয় স্যার। রাস্তায় এভাবে বলা যাবেনা।” অগত্যা অতনু তাকে তার বাড়ীতেই নিয়ে এলেন। একে অবিবাহিত, তার উপর কিছুদিন আগে মা-ও ছেড়ে চলে গেছেন। রাত দশটায় তার বাড়ীতে অতিথি এলে কেউ রুষ্ট হওয়ার নেই। বাবার তৈরি একতলা বাড়ীতেই তিনি তার ত্রিশটা বছর কাটিয়েছেন। আগামী বছর গুলোও হয়তো এভাবেই কাটবে। বসার ঘরে পুরোনো একটি সোফায় গা এলিয়ে দিল ছেলেটি। হেসে বলল, “আমার নাম স্যার জিমুত রায়। আমি অপূর্বর সাথে স্কুল আর কলেজ যুবন দুটোই কাটিয়েছি তাই ওকে পরমা বা ওর অন্যান্য বন্ধুদের থেকে একটু হলেও বেশি চিনি।” একগ্লাস জল জিমুতের দিকে এগিয়ে দিয়ে অতনু বললেন, “পুরোটা বলো জিমুত। তোমাকে খুব দরকার।” জলটা ঢকঢক করে খেয়ে জিমুত বলল, “আমরা ক্লাস নাইন থেকে একসাথে। একসাথে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, গ্রাজুয়েশন।” অতনু বললেন, “তুমিও কি কৃষ্ণনগরের?” জিমুত মাথা নেড়ে বলল, “ওর বাড়ি কৃষ্ণনগর ঠিকই কিন্তু অপূর্ব এখানে যখন আসে ও তখন ক্লাস নাইন। ওর বাবার কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর পড়াশুনা চালানোর জন্য ওকে ওর মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেয় ওর বাড়ির লোক।” অতনু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তাই নাকি? ওর মামাবাড়ি কোথায়?” জিমুত গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, “চেতলার আশেপাশেই। পরে যখন কলেজে ওঠে তখন মামাবাড়ি ছেড়ে দিয়ে একটা ভাড়াবাড়িতে ওঠে। আসলে ওর মামীমা খুব অশান্তি শুরু করেছিলেন ওর থাকা খাবার খরচ নিয়ে। খুব আত্মাভিমানী ছেলে ও।” অতনু বেশ আগ্রহ বোধ করেন এবার, বলেন, “তারপর? ওর মধ্যে কি কিছু অস্বাভাবিকত্ব ছিল?” জিমুত একটু চুপ করে রইল। যেন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। তারপর বলল, “অস্বাভাবিকত্ বলতে যা বোঝায় তা সকলের চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু দারিদ্র ওকে বুঝিয়েছিল যে জীবনে টাকাটাই সব। আর সেই বোধ থেকে ও ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ থেকেই রোজগারের পথ খুঁজে নেয়। ওর হাতে আসে প্রচুর কাঁচা টাকা।” অতনু অবাক হয়ে বলেন, “কাঁচা টাকা! সতের আঠারো বছর বয়সে কি করে কাঁচা টাকা হাতে আসে? ও কি কোনো এন্টিসোশ্যাল চক্রে জড়িত হয়ে পড়েছিল?” জিমুত মাথা নেড়ে বলল, “জানিনা স্যার। জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাইনি। বেশি প্রশ্ন করলে বরং এড়িয়ে যেত।” অতনু নিচের ঠোঁটে বুড়োআঙুল ছুঁইয়ে কিছু ভাবলেন তারপর বললেন, “লাস্ট কবে দেখা হয়েছে তোমার সাথে?” জিমুত বলল, “মাসখানেক আগে। নিজেই দেখা করে একটা ব্যাগ দেয় আমাকে। বলে ও নিজে এসেই নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এলো না। আমি কখনো খুলে দেখিনি কিন্তু ব্যাগের ওপর একটা নার্সিং হোমের নাম আর ঠিকানা লেখা। যেদিন ব্যাগটা দেয় সেদিন খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে। বলেছিল ও ছাড়া যেন কাউকে ব্যাগটা না দিই আর কাউকে যেন ভুলেও না বলি যে ব্যাগটা ও আমায় দিয়েছে। আমার মনে হয় ও কোনো চক্রে আটকে পড়েছে স্যার। একটু দেখুন।” জিমুত একটা ব্যাগ হাতে দেয় অতনুর। কালো রঙের একটা সাদামাটা ব্যাগ। ওপরে লেখা 'উই কেয়ার নার্সিং হোম' ট্যাংরা এলাকায় অবস্থান। জিমুতকে বিদায় জানিয়ে ডিনার সেরে ব্যাগটা নিয়ে বসেন অতনু।
ব্যাগের মধ্যে রয়েছে অনেক কাগজ। সবই মেডিক্যালের কাগজ। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট, এক্স-রে রিপোর্ট, ইউ-এস-জি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কমার্সের ছাত্র অপূর্ব এই সমস্ত কাগজ নিয়ে আসলে কি করতে পারে? এগুলো কি তার পরিচিত কারুর রিপোর্ট? কিন্তু এমন কি আছে এই কাগজে যা সে কাউকে বলতেই বারণ করে দিল? মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করতে শুরু করলো তার। আজ সারাদিন এই একটা কেস নিয়ে বেশ মাথা ঘামাতে হয়েছে। এক পেগ হুইস্কি খেয়ে নিদ্রামগ্ন হলেন অতনু বিশ্বাস।
ঘুম ভাঙলো সিনিয়ার অফিসারের ফোনে। সকাল সাতটা। “অতনু তোমার এলাকায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। স্পটে যাও তাড়াতাড়ি।” এরকম ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবুও অতনুর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কাল রাতে জিমুত একাই বেরিয়েছিল। বাড়ি ফিরেছে কিনা জানা হয়নি আর। রাস্তার ধারে বিশাল ফাঁকা জমি, ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি। তার মধ্যেই উল্টে পরে আছে একটা বাইক। বডিটা তুলে আনা হয়েছে। সারা গায়ে চাপ চাপ রক্ত জমে, রাস্তার সাথে ঘষা লেগে চামড়া উঠে গেছে শরীরের অনেক জায়গায়। তবু মুখটা স্পষ্ট। জিমুত। “বাইকের ব্রেকের তার কাটা ছিল স্যার। স্পিড বাড়াতেই স্কিট খেয়ে উল্টে পড়েছে বোধহয়।” একজন কনস্টেবল কথাটা বলেই আবার বাইকটি উদ্ধারের কাজে লেগে পড়ল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অতনুর। কিছু লোভী, স্বার্থপর মানুষের জন্য কতো নিরপরাধীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বাইক ঘুরিয়ে আবার চলল সে বাড়ির দিকে। দোতলায় উঠে এসে চমকে উঠলো অতনু, সেন্টার টেবিলে রাখা ব্যাগটা নেই। কাল রাতে এখানেই রেখেছিল সে ব্যাগটা। ছিঃ ছিঃ এতো বড় ব্লান্ডার কেউ করে! নিজের অজান্তেই একটা ঘুষি ঠুকে দিল সে দেওয়ালে। মাথার শিরা দুটো দপদপ করছে, অপরাধী তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এই কেসের নিষ্পত্তি সে করবেই।
কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে একটা রিকশা করে পৌঁছে যাওয়া যায় লোকাল থানায়। অপূর্বর ছবি ও পরিচয় দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তার কেস হিস্ট্রি হাতে চলে এলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, অপূর্বর নামে মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে প্রায় মাসখানেক আগে। ওর দাদা এসে করে গেছে। কিন্তু তারপর আর কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। এভাবে একটা পরিবার একটা ছেলেকে কি ভুলে যেতে পারে? থানার এক অফিসারের বাইকে চেপে অতনু এসে পৌঁছায় অপূর্বর বাড়ি। বড় রাস্তার পাশেই দুতলা, ছিমছাম, বাগান ঘেরা বাড়ি। ছোট্ট একটা লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢোকার আগেই গেটের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন ভদ্রমহিলা। পরণে ছাপা শাড়ি, আঁচলটা কোমড়ে গোঁজা, কপালের সিঁদুর ঘামে লেপ্টে গেছে, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ-বাহান্ন। স্বরূপের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। স্বরূপ পকেট থেকে কার্ড বের করে বললে, “কলকাতা পুলিশ।” কথাটা শুনে একটু থমকে গেলেন ভদ্রমহিলা। যেন এটা কোনোদিন আশা করেননি। একটু ইতস্তত করে বললেন, “এই বারান্দাতেই বসুন, বাড়িতে কেউ নেই। কি জানার আছে বলুন?” অপমানিত হলেও এগুলো সহ্য করা অভ্যেস হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলো, “অপূর্বর সম্পর্কে জানতে এসেছি।” মহিলা তেমনই কঠোর মুখে বললেন, “বলুন কি জানতে চান?” স্বরূপ একটু অবাক হলো। মহিলা যেন সব জেরার জন্যই প্রস্তুত। বলল, “ও কবে থেকে কলকাতায় আছে? কিভাবে নিজের পড়াশোনা চালাতো ওখানে? কোথায় থাকতো? কি চাকরি করতো? এইসব উত্তর আমার বিস্তারিত ভাবে চাই। আপনারা তো মিসিং ডায়েরি করেছিলেন। কলকাতায় কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি? কেন এখানে একটা ডায়েরি লিখিয়ে চুপ করে গেছেন?” মহিলা এবার মোড়া এনে বসলেন। একটু যেন ক্লান্ত লাগছে তাকে। কপালের মাঝখানটা চেপে ধরে কিছুক্ষন বসে থাকলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, “আমার দুই ছেলে। রূপ ও অপূর্ব। অপু যখন ক্লাস নাইনে তখন ওর বাবার একটা স্ট্রোক হয়ে বাঁদিকটা পরে যায়। কারখানার কাজটা যেতে বসেছিল, বড়বাবুকে হাতপায়ে ধরে বড় ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দিই। উচ্চমাধ্যমিকের পর ওর পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ছোটটাকে মাধ্যমিকের পর দাদার কাছে পাঠিয়ে দিই। কলকাতায়। কলেজের গন্ডীটা পেরোলেও তো অনেক মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু সহজ সরল ছেলেটা বড় শহরে গিয়ে কেমন পাল্টে গেল। মাস ছয়েকের মধ্যে টাকা পাঠাতে শুরু করলো। কখনো দশ হাজার, কখনো বিশ। সবই অপূর্ব নাথের কলকাতার একাউন্ট থেকে। আমাদের বুক কাঁপলো। ও তো তখনও স্কুল পাশ করেনি। দাদা একদিন ফোন করে বলল, অপুকে নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি হচ্ছে। বৌদি ওর হাবভাব চালচলন কিছুই মেনে নিতে পারছে না। ভীষণ উদ্ধত হয়ে পড়েছে ও। আমি তো অবাক। আমার ছেলে তো এমন ছিল না।” এইটুকু বলে মহিলা একটু থামলেন। হয়তো দম নিতে। হয়তো কান্নার বেগ সামাল দিতে। হঠাৎ গেট খোলার শব্দে দুজনেই সামনে তাকালো। একটি বছর ছাব্বিশ-সাতাশের ছেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। বারান্দায় উঠে এসে অতনুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনি পুলিশ? কি চাই?” অসন্তোষ চেপে অতনু বলল, “আপনার ভাইয়ের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে এসেছি।” ছেলেটি ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার কোনো ভাই নেই। আপনি আসতে পারেন।” হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল অতনুর। ওপার থেকে কিছু শুনে উঠে বসলো সে। রূপের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন আমার সাথে।” রূপ অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
একটা জানালাবিহীন ঘরে বসে আছে তিনটে প্রাণী। রূপ, পরমা আর অতনু। একটু আগে একটা মৃতদেহ সনাক্ত করে এসেছে ওরা। দুজনেই বলেছে ওটা অপূর্বর লাশ নয়। অতনু টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “উই কেয়ার নার্সিংহোম।” শব্দ তিনটি শুনেই যেন চমকে উঠল সামনের দুজন। অতনু ঠিক এটাই চেয়েছিল। ঠোঁটের কোণে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলল, “নামটা ভীষণ চেনা তাই না?” রূপ ইতস্তত করে বলল, “ভাই ওখানে কাজ করতো।” অতনু উঠে দাঁড়িয়ে রূপের সামনে টেবিলে হেলান দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “শুধু অপূর্ব কাজ করতো?” রূপ আড় চোখে পরমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনো অপরিচিতর সামনে কিছু বলতে পারবো না স্যার।” অতনু সেরকমই ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলল, “পরমা আপনার অপরিচিতা নাকি?” রূপ বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মতো তাকালো অতনুর দিকে, পরমাও ঘামছে। অতনু হঠাৎ রূপের কলার ধরে তুলে একটা জোর ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, “সত্যি কথাগুলো ভালোয় ভালোয় বলবি নাকি লাঠি আনবো? কেন নিজের ভাইকে মেরেছিস বল?” এমন বিনা মেঘে বজ্রপাতে রূপ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো, “বলছি স্যার বলছি। মারবেন না। এই মেয়েটা আমায় ফাঁসিয়েছে।” পরমা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বলল, “রূপ! আমি তোমায় ফাঁসিয়েছি? প্ল্যানটা তোমার ছিল, আর আমি তোমায় ফাঁসিয়েছি?” অতনু মনে মনে স্বস্তি পেল। তীর ঠিকঠাক চাকে গিয়ে লেগেছে। ধমকের সুরে বললো, “এসব দোষারোপ পর্ব জেলে বসে করবে দুজনে। আগে পুরো ঘটনা বলো। ঠিক আছে আমিই বলছি। তার আগে একজনকে ডেকে নেবো।” অতনুর কথা শেষ হতেই একজন অফিসার ঢুকে এলেন ঘরে সঙ্গে বিশ্বজিৎ লাহা। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু বিড়বিড় করে বলে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। অতনু হাসি চেপে বলল, “বলুন মিস্টার আমরিশ পুরী কেমন চলছে আপনার নার্সিংহোমের ব্যবসা?” মিস্টার লাহা উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল।
অতনু সামান্য হেসে বলতে শুরু করলো, “ একটা থ্রিলার গল্পে দু ধরণের অপরাধী থাকে জানেন তো। এক, মাথা মোটা যে ভাবে অপরাধ করে ফেলে প্রমান লোপাট করলেই হলো। বোকা পুলিশ কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। আর এক ধরণের আছে যে অপরপক্ষকে সমান শক্তিশালী ভেবেই অপরাধ করে। এরা খুব ধূর্ত, এদের ধরতে পারাটা খুব চাপের। কিন্তু এরা যদি একত্র হয় তাহলেও কিন্তু কেস বেশ জটিল হয়ে যায়।” মিস্টার লাহা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনার গল্প গাছা শোনার জন্য এখানে বসে থাকতে পারবো না মিস্টার বিশ্বাস। আমি আসছি।” বিশ্বজিৎ বাবু ওঠার উদ্যোগ করতেই অতনুর বন্দুকের ঠান্ডা নল তার কানের লতি ছুঁলো, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজিৎ লাহা আবার স্বস্থানে বসে পড়লেন। অতনু আবার ঠোঁটে হাসি এনে বলল, '' গুড। কিন্তু মিস্টার লাহা গল্পটা যে আপনাকে শুনতেই হবে। কারণ আপনি তো এই গল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। আচ্ছা এতো পাকা খেলোয়াড় হয়ে এরকম আনাড়ির হাতে খেলার শেষটা দিলেন কি করে বলুন তো?” বিশ্বজিৎ লাহা একবার রূপের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনেই অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন, “যা বলতে চান স্পষ্ট করে বলুন।” অতনু এবার তার গাম্ভীর্য পরিধান করে বলতে শুরু করলো, “জিমুতের মৃত্যুর পর আমার এই কেসটা নিয়ে একটা রোখ চেপে গেছিল। একজন নিরপরাধী মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তার ওপর বাড়ি এসে দেখি জিমুতের দেওয়া ব্যাগটা আমারই বাড়ি থেকে চুরি গেছে। মাথাটা গেল আরো গরম হয়ে। বুঝলাম এই ঘি সোজা আঙুলে উঠবে না। তাই সিভিল ড্রেসে চলে গেলাম কৃষ্ণনগর। আর এখানে রেখে গেলাম আমার ক্রাইম ব্রাঞ্চ এসিস্টেন্ট তপন বসুকে। সঙ্গের অফিসার মাথা নাড়লেন। তপন উই কেয়ার নার্সিংহোমে পেট ব্যথার অভিনয় করে পেশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়। তাকে সকালবেলা ভর্তি নিয়ে নেওয়ার পর, সারাদিনে বিভিন্ন টেস্ট করার পর সন্ধ্যেবেলা জানানো হয় তার কিডনি ড্যামেজ হয়েছে তাই ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিতেও বলা হয়। আমাদের অফিসাররা পেশেন্ট পার্টির কর্তব্য সেরে সেই রাতে তপনকে ও আরো একজন অফিসারকে পেশেন্ট পার্টি হিসেবে ওখানে রেখে বাইরে টহল দিতে থাকেন আর ভেতরে তপন ও তার সহকর্মী তার কাজ করতে থাকে। ওরা মাঝরাতে ওদের মিশন শুরু করে। প্রথমত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলিকে মিটার রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিকল করে। এই সুযোগে অফিসে ঢুকে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে নার্সিংহোমের মালিক হিসেবে ওদের সামনে উঠে আসে বিশ্বজিৎ লাহার নাম। আরো কিছু কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে এই নার্সিংহোম অর্গান ট্রাফিকিং চক্রের একটি মূল পান্ডা। অর্থাৎ রুগীর সামান্য রোগকে কোনো একটি অর্গান ফেইলিওর বলে, ভুল রিপোর্ট দেখিয়ে প্রচুর টাকা হাতানো ও সাথে সাথে ভালো অর্গান পাচার করার কাজ করা হয় এই নার্সিংহোমে। আমাদের টিম অনেকদিন ধরেই এই চক্রের সন্ধানে ছিল কিন্তু কোনো সূত্র না পাওয়ায় এগোতে পারছিল না। সূত্রটি দিয়ে গেল জিমুত। এদিকে আমি আমার কৃষ্ণনগরের অফিসার মৃণাল রায়কে সব কিছু জানিয়ে অপূর্বর বাড়ি আর বাড়ির লোকের ওপর নজর রাখতে বলে দিয়েছিলাম। অপূর্ব নাথের বাড়িতে থাকেন একজন অসুস্থ বাবা, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা মা আর তার দাদা, রূপ নাথ। আমার প্রথম থেকেই ভীষণ খটকা লেগেছিল এই ব্যাপারে যে একটা ছেলের মিসিং হওয়ার পর তার বাড়ির লোক দ্বিতীয়বার কেন তার খোঁজ করল না? আমার অর্ডারের পরেরদিন সকাল থেকে মৃণাল সিভিল ড্রেসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টহল দিতে থাকে। সকাল দশটা নাগাদ রূপ বেরোয় স্কুটার নিয়ে। তার পিছু নিয়ে জানা যায় তার কারখানার ঠিকানা। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি রূপ ওখানেই থাকে। তারপর সে যায় আরেক জায়গায়। আরেকটা অফিসে। মৃণাল পিছু নিয়ে যায় সেখানে। একটা টিনের চালের বাড়ি অফিসের নাম নেই, অফিস সুলভ চাকচিক্য বা কাঠামো নেই, মাত্র একটি ঘর। সন্দেহ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই তবু সন্দেহ প্রবল হলো। সারা সন্ধে ওই বাড়ির কাছাকাছি লুকিয়ে থেকেও রূপকে একবারের জন্যও বেরোতে দেখা গেল না। আশেপাশের লোকজনের থেকে জানতে পারল ওই বাড়িটি সম্বন্ধে তারা খুব বেশি কিছু জানেননা। শুধু রোজ একটি ছেলে এসে দরজা খুলে ঢুকে পড়ে, বেরোয় সেই রাত্রে। আর অন্য কাউকে যেতে বা আসতে দেখা যায়নি। রাত দশটা নাগাদ রূপ বেরিয়ে আবার স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মৃণাল সবটা জানিয়ে আমায় ফোন করলো। আমি পরেরদিনই পৌঁছই। জিমুতের মৃত্যুর সঙ্গে কোথায় যেন যোগসূত্র পাচ্ছিলাম। রাত দশটায় রূপ বেরোল, আমি সুন্দর সুযোগ পেলাম ঘরটা সার্চ করার। তালা খুলতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। রূপ সিকিউরিটির ব্যবস্থা বেশ ভালোই করেছিল। যাইহোক, ভেতরে ঢুকে শুধুই দেখলাম কাগজ আর কাগজ। আলমারি, টেবিল, বাক্স ভর্তি কাগজ। কিসের কাগজ? ঘেঁটে পেলাম সেই একটাই নাম। উই কেয়ার নার্সিংহোম। সেই একই ধরনের রিপোর্ট প্রত্যেকটি ফাইলে, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট , usg রিপোর্ট যেমনটা জিমুতের দেওয়া ব্যাগে ছিল। দেখে যতটুকু বুঝলাম অর্গান ট্রাফিকিংয়ের সমস্ত নথিপত্র এখানে লোকানো রয়েছে। বুঝলাম অপূর্ব আর রূপ একই সংস্থার হয়ে কাজ করতো, একজন কলকাতায় আর একজন এখানে। কিন্তু আমার কাছে কোন ব্যাগটা ছিল বুঝতে পারছিলাম না। ওখানে একই ধরনের অনেকগুলো ব্যাগ। সার্চ করতে করতে একটা নাম চোখে পড়ল, পলাশ নাথ। জিমুত আমায় যে ব্যাগটা দিয়েছিল তাতে এই নামের ব্যাক্তির রিপোর্ট ছিল, দেখেছিলাম। বুঝতে বাকি রইল না এই ব্যাগটাই আমায় দেওয়া ব্যাগ এবং আমার বাড়ি থেকে চুরি গেছিল। পরের দিন সকাল সকাল পৌঁছলাম রূপের বাড়ি। ওর মায়ের কাছে থেকে আরো কিছু কথা জানতে। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে দুই ছেলের কার্যকলাপ সম্পর্কে উনি কিছুই জানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপ ফিরে এলো। ওর চেহারা দেখে বুঝলাম ব্যাগটি যে নেই এবং পুলিশ যে অপূর্বর খোঁজে এতো দূর চলে এসেছে এই খবর ও পেয়েছে। ওর কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন লাগল। ও যেন কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর সম্পর্কে কোনো কথাই বলতে চাইছে না। অনুমান করলাম যে অপূর্বর সম্পর্কে কোনো কথা ও যদি বলে ফেলে তাহলে ও নিজেও ফেঁসে যাবে। মনে মনে ঠিক করলাম ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে, তাহলে যদি কোনো কথা বের করা যায়। সুযোগও এসে গেল। কিছুক্ষন পরেই ফোন আসে তপনের। সে জানায় নার্সিংহোম সম্পর্কে সব খবরাখবর এবং ওরা দুজন কর্মচারীকে গোপনে আটক করে আরো কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। আমি তৎক্ষণাৎ ওকে একটা মেসেজ করলাম মর্গে একটা বডি ঠিক করার জন্য। লাশ সনাক্তকরণের অছিলায় রূপকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। এরপরে যে প্রশ্নগুলি করবো তার উত্তর আশা করি বাকিদের থেকে পাবো। তাই তো রূপ, পরমা?” অতনু এবার থামল। রূপ, পরমা মাথা নিচু করে বসে আছে।
রূপ ধীরে ধীরে মাথা তুলে একবার পরমার দিকে তাকালো। মেয়েটি তখন থরথর করে কাঁপছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে নার্ভ ঠিক রাখতে পারছে না। রূপ বলতে শুরু করে, “বাবার অসুস্থতার পর মা ভাইকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিলো আর আমায় লেখাপড়া বন্ধ করে ঢুকে পড়তে হলো কারখানায়। কষ্ট হয়েছিল কিন্তু ভাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মেনে নিলাম সব। কলকাতায় এসে ভাই কদিনের মধ্যে প্রচুর টাকা পাঠাতে শুরু করে মায়ের একাউন্টে। এদিকে আমার মাইনে ছয়-সাতের ওপর ওঠে না। ভীষণ হিংসা হলো, ভাই বরাবর বুদ্ধিতে, কাজে আমার থেকে এগিয়ে। আবার চিন্তাও হলো, কোথায় পাচ্ছে এতো টাকা? বারবার প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছে। হেসে বলেছে, “কলকাতায় টাকা ওড়ে রে দাদা।” চিন্তা আরো বেড়ে গেল যখন মামা ফোন করে বলে ভাইকে নিয়ে বাড়িতে খুব সমস্যা হচ্ছে। ও নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি আসি কলকাতায় সবকিছু জানতে। এসে জানতে পারি ভাই চেতলার কোনো একটা বাড়িতে ভাড়া রয়েছে। সেখানেও পৌঁছে যাই। কিন্তু ওকে বাড়িতে পাইনি। সারা দুপুর আর সন্ধ্যে ওই বাড়ির চাতালে কাটাই। রাত এগারোটার সময় ভাই ফেরে। আমাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে হকচকিয়ে যায়। আমি ওর বেশভুষা দেখে তো অবাক। এতো দামী জামা কাপড়, জুতো! ঘরে ঢুকে ওকে চেপে ধরলাম― বল বল কি করছিস তুই? কোথায় পাচ্ছিস এতো টাকা? প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে ধীরে ধীরে সব বলে। ও বলে যে একটা নার্সিংহোমে কিছু একটা কাজ ও করছে যার জন্য এত পরিমান টাকা অর্জন করছে। আমায় বলে এসব কারখানায় কি আছে দাদা? আমার সাথে আয় দেখবি কতো টাকা চারিদিকে ছড়িয়ে। পরের দিন আমাকেও মিস্টার লাহার কাছে নিয়ে যায় ও। মিস্টার লাহা আমায় নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন আগে কিছুদিন সার্ভিস দেখে পুরোপুরি আপয়েন্ট করবেন। বিশ্বাস করুন তখনও জানতাম না আসলে কি কাজে জড়িয়ে পড়ছি।” রূপ একটু দম নেওয়ার জন্য থামল। সামনে রাখা গ্লাস তুলে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করলো, “ধীরে ধীরে আমিও এই কাজে লেগে পড়ি। দারিদ্রের ঝড়ের পরে অর্থের বৃষ্টি লোভের জোয়ার এনে দেয়। এই সময় আমার পরিচয় হয় পরমার সাথে। ও ভাইয়ের বন্ধু ছিল। ভাই ওকে পছন্দ করতো। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম পরমার ভাইয়ের প্রতি সেই অনুভূতি নেই।” রূপ থামে। পরের কথাগুলো বলে পরমা, “অপূর্বর সাথে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না। ও নার্সিংহোমে কাজ করতে শুরু করার দুবছর পর একই কলেজে ভর্তি হই আমরা। ও নিজে থেকেই আমার কাছাকাছি থাকতো কিন্তু রূপের সাথে আলাপ হওয়ার পর আমি রূপকে পছন্দ করতে শুরু করলাম। রূপ ততোদিনে নার্সিংহোমে আর বাড়িতে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে অপূর্বর সাথে। অপূর্বই আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।” অতনু জিজ্ঞেস করল, “তারপর?” রূপ ধীরে ধীরে তাকালো মিস্টার লাহার দিকে। তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। রূপের দিয়ে তাকিয়ে সে ফেটে পড়লো, “আমার দিকে কি তাকাচ্ছ স্কাউনড্রেল? আমি তোমায় বলেছিলাম অপূর্বকে খুন করতে?” তারপর অতনুর দিকে ফিরে বলল, “শুনুন অফিসার। আমি একটা নার্সিংহোম খুলে অর্গান ট্রাফিকিং করেছি, স্বীকার করছি কিন্তু এই দুটো খুনে আমার কোনো হাত নেই। অপূর্ব আমার কাছে কাজ চেয়েছিল। হি ওয়াস এ ব্রিলিয়ান্ট বয়। পড়াশুনা করলে এগোতে পারতো। কিন্তু সেই সময় আমার এমন একজন এজেন্টের দরকার ছিল যাকে দেখে কেউ সন্দেহ করবে না। একজন স্কুল বয়ের থেকে বেটার ইনোসেন্ট কে আর হতে পারে। আমি কাজ দিয়েছিলাম। ও শুধু ক্লায়েন্ট আনত আর যোগাযোগ করাতো ব্যাস। হি ওয়াস আ রেস্পন্সিবল গাই। বাট দিস ফেলো ইস আবসার্ড। ওকে শুধুই কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার কাজে রেখেছিলাম। লাস্ট টাইম ও ওর বাবাকে নিয়ে আসে হসপিটালে। এমন চামার ছেলে জীবনে দেখিনি। বাবার কিডনি ও নিজে ক্লায়েন্ট এনে বিক্রি করে। অপূর্ব এটা জানতো না। জানতে পেরে ক্ষেপে যায়। ওই কেসের সব কাগজ ও নিজের কাছে রেখে হুমকি দেয় যে ও এই চক্র সম্পর্কে সব পুলিশকে জানিয়ে দেবে। আমি বলেছিলাম তোমার ভাই তুমি কিভাবে ম্যানেজ করবে তোমার ব্যাপার। দুদিন পরে শুনি অপূর্বকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।” পরমা রূপের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলতে থাকে, “অপূর্বকে বাবা মুম্বাই চলে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়েছিলাম। সেই মতো ও ব্যাগ পত্রও গুছিয়ে রেখেছিল। ওর যাওয়ার কদিন আগে ও ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দেয়। কোথায় যায় জানি না। ফোন করেও পাইনি। হঠাৎই একদিন ওকে এসপ্লানেড এর একটা হোটেল থেকে বেরোতে দেখে আমার কলেজের এক বন্ধু। অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু অপূর্ব শুনতে পায়নি। ভিড়ে মিলিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমি যাই ওখানে, রূপও যায় ওকে বোঝাতে। হোটেলে গিয়ে ওকে পাইনি। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিল। রেজিস্ট্রার চেক করে দেখলাম চেক আউট করেনি। তার মানে ফিরে আসবে। আমরা দুজন হোটেলের বাইরেই একটু আড়ালে অপেক্ষা করতে থাকি। রাত প্রায় বারোটা নাগাদ অপূর্বকে দেখা যায় হোটেলের গেটে। আমরা ওকে গেটের সামনেই ধরি। সেইসময় ও পুরোপুরি ড্রাঙ্ক। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। রূপকে আমার সাথে দেখে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। ওকে মুম্বাইয়ের টোপ দিয়ে কলকাতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা ও বুঝতে পেরেছিল তাই বলতে থাকে যদি কলকাতা ছাড়তেই হয় ও সব কিছু পুলিশকে জানিয়ে তবে কলকাতা ছাড়বে। একটা ট্যাক্সি ডেকে আমরা তিনজন বাইপাসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হই। রূপ সেই সময় অপূর্বকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বারণ করে। কিন্তু অপূর্ব কিছুতেই মানতে চাইছিল না। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না যে ওর পঙ্গু বাবাকেও রূপ হার্ট সার্জারির নাম করে ওর লালসার শিকার বানিয়েছে। দুজনের ঝগড়া শুরু হয়, ক্রমে তা হাতাহাতিতে পরিণত হয়। রূপ একসময় সঙ্গে আনা দড়ি আর কাপড় দিয়ে অপূর্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। ফোন করে অফিস থেকে গাড়ি ডাকা হয়। ওই গাড়িতে চাপিয়ে অপূর্বকে কলকাতার বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি এর বেশি আর কিছুই জানিনা স্যার। রূপ ওকে কোথায় রেখেছে তাও জানিনা। রূপের কথা মতো কেসটা ঢাকা দেওয়ার জন্য মিসিং ডায়েরি করি পরেরদিন।” অতনু এবার চোয়াল শক্ত করে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলো, “জিমুতকে কেন মারা হলো? কেই বা মারলো?” পরমা এবার খানিকটা জল খেল। কপালের ঘাম মুছল ওড়না দিয়ে। কিছুটা দম নিয়ে বলল, “সেদিন রাতে জিমুতকে আপনার পিছুপিছু যেতে দেখে সন্দেহ হয়। ওকে আমার স্কুটি নিয়ে ফলো করে আপনার বাড়ি পৌঁছই। জিমুতের হাতে একটা ব্যাগ দেখেই পুরোটা আন্দাজ করে ফেলি। রূপের সেদিন রাতের ট্রেনে কলকাতা আসার কথা। ওকে ফোন করে জানতে পারি কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই চলে আসতে বলি আপনার এলাকায়। কিন্তু আমরা ভেতরে কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু অপেক্ষা ছিল জিমুতের আপনার বাড়ি থেকে বেরোনোর। জিমুত বেরোতেই ওকে ফলো করে কিছুটা দূরে এসে রাস্তা আটকে দাঁড়াই। ও প্রথমে কিছুটা অবাক হয় আমাকে আর রূপকে একসাথে দেখে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ও কিছুই বটে চায়নি। বরং আপনাকে কল করে বসে। সেই সময় রূপ ওর ফোন কেড়ে নিয়ে ওকে ফেলে দেয় পাশের পুকুরে। জিমুত সাঁতার জানতো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও মারা যায়। ওর বডি তুলে বাইকে বসিয়ে আরো দু কিলোমিটার দূরে এক জলাভূমিতে ফেলে দিল আর বাইকের ব্রেকের তার কেটে দিল যাতে গোটা ব্যাপারটা একসিডেন্ট মনে হয়। সকালে যখন আপনি বাড়ি ছেড়ে বেরোন ঠিক তখনই ব্যালকনির গ্রিল বেয়ে ব্যাগটা নিয়ে ও পালিয়ে আসে।” অতনু মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করে। পিছনে ডুকরে কেঁদে ওঠে রূপ-অপূর্বর মা, যিনি এতক্ষন সব শুনছিলেন। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঘরে। রূপ মাকে এতক্ষন খেয়াল করেনি। মায়ের উপস্থিতি তাকে বিচলিত করে তোলে। সে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলে ওঠে, “আমায় এরেস্ট করুন অফিসার। আমার লোভ থেকে বাবাও বাঁচতে পারেনি। ওই যে পলাশ নাথ, আমার বাবা। আমি আমার বাবার কিডনি বিক্রি করেছি। আমায় শাস্তি দিন।” অতনু রূপের দুগালে দুটি সশব্দ চড় মেরে তার চুলের মুঠি ধরে প্রশ্ন করে, “অপূর্বকে কোথায় রেখেছিস বল?” রূপ ঢোঁক গিলে কোনোমতে বলে, “অপু নেই?” রূপের মা চিৎকার করে ওঠেন, “নেই মানে? কি করেছিস তুই?” রূপ একটা পৈশাচিক হাসি হেসে বলে ওঠে, “কবর দিয়েছি। একটা নির্মীয়মান বাড়ির নিচে কবর দিয়ে এসেছি। ছোটবেলা থেকে আমার পথের কাঁটা হয়ে বসেছিল। পৃথিবীর সব ভালো কি একজনের জন্যই বরাদ্দ? আমার টাকা চাই। ওতো এথিক্স কপচে পেট চলে না মা। বাবার আর কদ্দিন বাকি ছিল বলতো? কেন বেকার আটকালো আমায়? ও যেন কতো সাধু পুরুষ!” রূপের কথা শেষ হওয়ার আগেই এলোপাথাড়ি কিল চড় মারতে শুরু করেন রূপের মা। তার চোখ ভরা জল। দুই ছেলের অমানুষিক আচরণে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওঁর হৃদয়। মহিলা পুলিশ দিয়ে ওঁকে বিরত করে রূপের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেন তপন। অতনু অর্ডার দেন, “এই সাইকো ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানুন বডিটা কোথায় পুঁতেছে। আর নার্সিংহোম ও তার যাবতীয় নথিপত্র সিজ করুন। এই একটা সূত্র ধরে আমরা আরো অনেক কালপ্রিটদের ধরতে পারবো। সো বি কেয়ারফুল তপন।” তপন রূপকে নিয়ে চলে যায়। একে একে পরমা ও বিশ্বজিৎ লাহাও হ্যান্ডকাফ পরে এগোতে থাকেন। অতনু মিস্টার লাহার সামনে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আপনার টিমটা বেশ ভালোই ছিল জানেন তো। কিন্তু সমস্যা বাধল দুটো পেয়াদাকে নিয়ে। ওদের একজনের বিবেক জেগে উঠেছিল আরেকজনের চিরতরে মরে গেছিল। এবার আপনি হাজতে বসে ভেবে দেখুন বাকি জীবনটা আপনার বিবেক আপনাকে কোন রাস্তায় নিয়ে যেতে চায়। নিজের কপাল তো পোড়ালেন সাথে মেয়েটাকেও নিলেন।” বিশ্বজিৎ লাহা তির্যক হাসি হেসে বলল, “দেখা যাক কতদিন হাজতে বসতে পারি।” অতনু তার ইঙ্গিত বুঝেও পাত্তা দিল না, বলল, “কনস্টেবল ওদের নিয়ে যাও।”
সবার চলে যাওয়ার পর অতনুর চোখ পড়ল ঘরের এক কোণে বসে থাকা রূপ-অপূর্বর মায়ের দিকে। একমাত্র ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে সে কিছু বিড়বিড় করে যাচ্ছে। অতনু তার কাছে গিয়ে বলল, “ম্যাডাম আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।” তিনি তার উদ্বেগহীন চোখ দুটি অতনুর দিকে মেলে ধরে বললেন, “একটা ইট কাঠের খাঁচা ওটা। ঠিক পৌঁছে যাবো। অন্তত এই খবর টুকু দিতে তো যেতেই হবে যে আমি দুটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলাম।” তিনি চলে গেলেন। অতনু তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। গ্রীষ্মের গনগনে রোদে তার ক্লান্ত অবয়ব মিশে গেলো অবলীলায়। এভাবেই নষ্ট হয়ে যায় কতো স্বপ্ন, কতো জীবন। এই মৃত্যু গুলির কেউ হিসেব রাখেনা।
সমাপ্ত।