একেবারে নতুন একটা ভ্রমণ মূলক ধারাবাহিক শুরু করলাম আজ। এই লেখার পাশাপাশি চলবে 'ওজন বাড়ান' ধারাবাহিকটিও। তাই ওজন বাড়ানের পাঠকরা হতাশ হবেন না। এই লেখাটি একেবারে নিজের জন্য লেখা। নিজেদের জন্য লেখা। সম্প্রতি ঘুরে এসেছি বিদেশ থেকে। কোনও ট্যুর এজেন্সি ছাড়া, নিজেদের প্রচেষ্টায়। তাও আবার রোড ট্রিপ। সেই অভিজ্ঞতাই সকলের সাথে ভাগ করে নিতে এই লেখা। তাছাড়া, যখন সময়ের ধূলিকণা স্মৃতির আল্ব্যামে জমে উঠবে, যখন ফিকে হয়ে আসবে কোনও এক ঘটনা তখন ফেসবুক মেমোরিতে ফিরে আসবে এই দিনগুলি - বারবার। এটাই জীবনের অন্যতম সম্পদ। আর এই লেখা পড়ে আপনারা যারা ভ্রমণ পিপাসু, তাদের যদি কোনও উপকার হয় তাহলে সেটা আমাদের উপরি পাওনা। 🥰🥰🥰
ঘরকুণোর বিদেশ যাত্রা
কেয়া চ্যাটার্জি
প্যারিস পর্ব
১. প্যারিসে পা
না, ঠিক ঘরকুনো আমরা নই। বেড়াতে যেতে কে না ভালোবাসে? গতে বাঁধা জীবন থেকে কয়েকদিনের ছুটি। কে না চায়? তবে হ্যাঁ, আমায় অনায়াসে ঘরকুনো হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়। সেজেগুজে বাইরে বেরোতে গেলেই আমার জীবনে বড় ল্যাদ লাগে। যাইহোক, এদিক ওদিকের কথায় মাথা না ঘামিয়ে আসল কথায় সরে আসা যাক। ফোকাস করা যাক কাজের কথায়। দুর্গা পুজোর কলকাতা ফেলে বেড়াতে যেতে মন চায়নি কখনও। কিন্তু এবারে হয়তো জগজ্জননী নিজেই সঙ্গ দিয়েছিলেন আমাদের জগৎ দেখার বাসনা পূরণে। তাই তৃতীয়ার কলকাতা, আলো – রোশনাই, যানজট, পুজোর গান, প্যান্ডেলের ভিড় ছেড়ে কত্তা, গিন্নী আর ছানা- তিনজন মিলে পাড়ি দিলাম ইউরোপের পথে। মূল গন্তব্য প্যারিস, সুইজারল্যান্ড হলেও বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ্য।
কলকাতার নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে আবু ধাবির কানেক্টিং ফ্লাইট ধরলাম। এতিহাদ এয়ারওয়েজ। আমার ও ঋভুর ক্ষেত্রে এই প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। মনে অনেক প্রশ্ন। কিছুটা জড়তাও ছিল। কোনও এজেন্সি ছাড়া নাকি প্রথম বিদেশ ট্যুর সম্ভব নয়। যেদিন থেকে প্ল্যানিং শুরু করেছিলাম সেদিন থেকেই এই কথা আমাদের দুজনের কানের কাছে পাঁচালির মতো আওড়ে গেছে অনেকেই। তাই একটা হালকা মানসিক চাপও ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো? যা যা, যেভাবে ভেবেছি, সব ঠিকঠাক করতে পারব তো? ইমিগ্রেশন নাকি ভারী বিষম বস্তু! অনেকক্ষণ সময় লাগে। অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে সেইসব ঝামেলায় পড়তে হয়নি। সবকিছুই হয়েছে একেবারে মাখনের মতো।
ইমিগ্রেশনের পরে হাতে ছিল বেশ কিছুটা সময়। রাত ন’টা পঁচিশে ফ্লাইট থাকলেও নিয়ম অনুযায়ী পৌঁছে গেছিলাম চার ঘণ্টা আগেই। ফলে পেটের ভেতর অদেখা ইঁদুর ঘোরাঘুরি শুরু করে দিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তো পারা যায় না। তাই সময় কাটাতে ঢুকে পড়লাম এয়ারপোর্ট ভিআইপি লাউঞ্জে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড যারা ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা জানেন যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার সাথে সাথে প্রায়োরিটি পাস থাকার ফলে এই ধরনের আন্তর্জাতিক মানের ফুড লাউঞ্জে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। আমাদের কাছে দু’ধরনের প্রায়োরিটি পাস ছিল, তবে আমরা এসবিআই- এর পাস ব্যবহার করি। একে তো তৃতীয়ার সন্ধ্যে তার উপর আগামী কটা দিন কেমন খাবার দাবার পাবো সেই নিয়ে একটু দ্বন্দ্ব তো ছিলই। তাই ডায়েটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুফে মেনু সাজানো হয়েছিল বাংলার ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে। ভাত, সোনা মুগের ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, দই পোনা, বাসন্তি পোলাও, কষা মাংস, চিকেন কারি, পটলের দোলমা, স্যালাড, গন্ধরাজ ঘোল, আম পোড়া সরবত যেমন ছিল তেমন ছিল মটন বিরিয়ানি, রায়তা, দু রকমের চাটনি, নানা রকমের পাঁপড়, চাট কাউন্টারে পাপড়ি চাট। এছাড়াও, নানা রকমের কফি, জুশ, ফল, মিষ্টি, আইস ক্রিম, সফট ও হার্ড ড্রিঙ্কস।
এবার প্লেনে চড়ার পালা। সময় হতেই বোর্ডিং পাস হাতে রেডি হলাম আমরা। এরপর ধীরে ধীরে প্লেনের চাকা গতিবেগ বাড়িয়ে মাটি ছেড়ে আকাশে ভেসে উঠতেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠল। অবশেষে আমাদের যাত্রা হল শুরু।
আবু ধাবি এয়ারপোর্টে যখন পা রাখলাম তখন মোবাইলের ঘড়িতে সময় রাত একটা। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে টার্মিনাল থ্রি থেকে ছাড়ল প্যারিসগামী বিমান। ততক্ষণে যদিও রাতের ঘুম চটে গেছে। বিমান সেবিকা খাবার পরিবেশন করে গেল। এই রাত তিনটের সময় খাবো কি খাবো না ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ভেসে ওঠা হিন্দি সিনেমা ‘দশবী’ দেখতে দেখতে খেয়েই ফেললাম হিন্দু নন ভেজ মিল। যতই হোক, পাপী পেট আর অভিষেক বচ্চন বলে কথা!
ঘড়িতে সকাল আটটা। পাইলট জানিয়ে দিলেন আমরা এসে পৌঁছেছি সিটি অফ লাভ প্যারিসে। মুহূর্তে ঘুম উড়ে গেল। ইতিমধ্যে গরম কফি আর চিকেন অমলেট পেটস্থ করা হয়ে গেছে। এবার কেবিন লাগেজ কাঁধে চাপিয়ে গুটি গুটি পায়ে ইমিগ্রেশনের দিকে পা বাড়ানোর পালা। তারপর লাগেজ কালেকশন, ট্যাক্সি বুকিং ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনেছিলাম ফ্রান্সের ইমিগ্রেশন অফিসারেরা নাকি ভীষণ কড়া। কিন্তু কাউন্টারে পৌঁছে আমাদের সেই শোনা কথা যে ভ্রান্ত তার প্রমাণ পেলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার হাসি মুখে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর পাসপোর্টের সঙ্গে একে একে মুখ মিলিয়ে সুইচ টিপে খুলে দিলেন পাশের কাঁচের দরজা। ভেবেছিলাম দু-তিন ঘণ্টা জলাঞ্জলি দিতে হবে শুধুমাত্র এই কাজটিতেই। কিন্তু দেখলাম ঘড়ি ধরে সাত মিনিটে সব কাজ শেষ করে আমরা ব্যাগেজ নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়েই দেখা মিলল সারি সারি ট্যাক্সির লাইনের। তবে এখানে বলে রাখা ভালো বিমান বন্দরের নিজস্ব একটি সরকার অনুমোদিত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই গাড়ি নেওয়া ভালো কারণ বড় শহরে পর্যটকদের সাথে স্ক্যামিং হয় প্রচুর। ট্যাক্সি বুকিঙের আগে চালকের কাছ থেকে এটাও জেনে নিতে হবে যে সে কার্ডে পেমেন্ট নেয় কি না। যাতে পরে ঝামেলা না হয়। আমরা প্রথম দিন থেকে কার্ডেই পেমেন্ট করেছি কারণ তখনও নতুন দেশের নতুন টাকা পুরোপুরি চেনা হয়নি।
ক্রমশ...




.jpeg)
.jpeg)

