জন ড্যান: মেটাফিজিক্যাল কবি
কেয়া চ্যাটার্জি
সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজি সাহিত্যে উদিত হল এক নতুন ধারণার সূর্য। একদল তরুণ কবি পূর্বতন কবিদের রোম্যান্টিক ধ্যান ধারণার বাইরে গিয়ে পৃথিবীকে দেখতে শেখে এক অন্য ধরনের দৃষ্টি দিয়ে। প্রেমে কি শুধুই চাঁদ, তারা, ফুল, পাখিদের অধিকার? প্রেমিকা কেন হবে এক অলীক জগতের অধিবাসী? তাকে ছোঁয়া যাবে না কেন? শুধুই তার পথ চেয়ে কবি লিখে যাবে কিছু পেলব পংক্তি? তারুণ্যের উচ্ছ্বাস সেই না পাওয়া গুলির বিরুদ্ধে শানিয়ে তুলল নিজেদের কলম। জন্ম নিল কিছু ছক ভাঙা কাব্যের। গঠিত হল মেটাফিজিক্যাল কবি গোষ্ঠী।
এই গোষ্ঠীর কবিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল চিরাচরিত কাব্যের থেকে একটু আলাদা। কবিতাগুলি ছিল ছন্দবদ্ধ, আধ্যাত্মিক ও প্রেমের, কাব্যিক ভঙ্গি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও চমকপ্রদ। তবে মেটাফিজিক্যাল কবিতার আসল চমক ছিল তার উপমায়। দুটি অসম বস্তুকে উপমিত করে কবি তাঁর মনের ভাব ব্যক্ত করেন। এই ধরণের উপমা সম্বলিত কবিতার প্রয়াস এর আগে কখনো ইংরেজি সাহিত্যে ঘটেনি। সব থেকে কোমল অনুভূতিদের প্রকাশ কীভাবে কিছু নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর মাধ্যমে সম্ভব সেই ভাবনাই ঘিরে ধরল পাঠক মহলকে।
মেটাফিজিক্যাল কাব্যগুলির গঠন ছিল মোটামুটি একরকম ছকের। একজন কথক, মুক্ত ছন্দ এবং ভিন্ন ধরার উপমা যা পাঠককে চমকে দেবে। এই উপমার ভিতরেই নিহিত থাকে কবির জটিল ভাবনা, গভীর মনস্তত্ত্ব। মেটাফিজিক্যাল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন গবেষক ডক্টর জনসন। এই গোষ্ঠীর কবিদের রীতি ভাঙার সাহসিকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই কবিরা তাঁদের যৌন চাহিদার কথা, প্রেমের কথা, সামাজিক অবস্থানের কথা নির্দ্বিধায় জানাতেন। পূর্বতন কবিদের মতো তাঁদের পদ্যে ছিল না কোন অহেতুক অলঙ্কারের আতিশয্য। তৎকালীন কবিদের মধ্যে নাম উঠে আসে জর্জ হার্বার্ট, রিচার্ড ক্রস, হেনরি ভগান, থমাস কারিউ, অ্যান্ড্রু মার্ভেল, আব্রাহাম কাউলি, হার্বার্ট ওয়ালের প্রমুখের নাম উঠে এলেও এঁদের মধ্যে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন জন ডান।
১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের এক অভিজাত ক্যাথোলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জন ডান। তবে তাঁর শিক্ষাজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিভেদের জন্য। তাঁকে ইংল্যান্ডের সব থেকে ঐতিহ্যপূর্ণ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ পড়াশোনা শেষ করার আগেই ছেড়ে দিতে হয়। ধর্মীয় অভিমতের অমিলের কারণে তাঁর দাদাকে একটি চার্চের পৌরহিত্য ত্যাগ করতে হয় কারাবাসে প্রাণত্যাগ করতে হয়। এতো প্রতিকূলতার পরেও জীবনের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাননি। পরবর্তী কালে তিনি আইনের ওপর পড়াশোনা করেন। ধীরে ধীরে তিনি যে চার্চের অধীনে তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন সেটি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বিভেদের উর্দ্ধে গিয়ে নিজেকে শুধুমাত্র একজন খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিতেন।
কবিতা লেখার অভ্যাস ছোটোবেলা থেকেই তাঁকে ঘিরে ছিল। প্রাপ্তবয়সে কবিতা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি ভাগ করে নিতেন দরিদ্র ক্যাথোলিক পরিবারের সাথে। তিন বছর তিনি বসবাস করেন ইউরোপে। ফিরে এসে লর্ড এগেরটনের সেক্রেটারির কাজে নিযুক্ত হন। এই সময় তাঁর পরিচয় ঘটে তাঁরই মালিকের ভাইঝি অ্যান মোরের সাথে। তাঁরা দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। তাঁর প্রেমের অপরাধে তাঁকে কারাবাস করতে হয়। তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। বহু বছরের দারিদ্রতার জ্বালা সহ্য করার পর অ্যানের পিতা জর্জ মোর তাঁদের ক্ষমা করেন ও তার কন্যার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জন এই আরামের জীবন চাননি কখনোই। তিনি চার্চের চাকরির সুযোগ ছেড়ে দেন। তিনি রাজা প্রথম জেমসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর পৃষ্টপোষকতা আশা করেন। কিন্তু রাজা তাঁর দিকে নজর দিলেও তাঁকে কোন জীবিকা দিলেন না। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর অ্যানের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যায়। সাতটি সন্তানের দায়িত্ব ও চরম দারিদ্র তাঁকে অবেশেষে একটি চার্চের পুরোহিত হিসেবে যোগ দিতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে তিনি শহরের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত হয়ে ওঠেন। অবশেষে তাঁকে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রালের ডিন হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
জীবনের এই ওঠা পড়ার মাঝেও কবিতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁর জীবনের সবথেকে বেশি কবিতা তিনি লিখেছেন ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে ধরা পড়েছে বুদ্ধিমত্তা, কোমলতা, সন্দেহ, মানবিকতা। তাঁর কাব্যে ধরা পড়ে তাঁর গভীর মনস্তত্ত্ব, জীবনের প্রতি ভালোবাসা। তাঁর কবিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল The Flea, The Good Morrow, The Canonization, The Sun Rising, Go and catch ba falling star, The Anniversary, Holy Sonnets। এলিজাবেথান ও পেট্রারকান কবিদের চিরাচরিত ধরন থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। তাঁর ছন্দ ছিল সহজ, ভাষা ছিল সাধারন মানুষের হৃদয়গ্রাহ্য ও সাবলীল। তাঁর কাব্যে ছড়িয়ে আছে জীবনকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করার এক আনন্দ। জীবন, প্রেম, আধ্যাত্মিক চিন্তা ধারা সব ধারায় তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন এক রহস্যের চিহ্ন।
তাঁর এই শৈলী শুধুমাত্র তাঁর পরবর্তী কবিদের মধ্যেই সীমিত ছিল না। হার্বার্ট, ক্লিভল্যান্ড, মার্ভেল ছাড়াও তাঁর এই শৈলীর বশীভূত হয়েছিলেন কবি ড্রাইডেন, কোলেরিজ, ব্রাউনিং, এলিয়ট, পোপ, হপকিন্স প্রমুখরা। খুব কম কবি তাঁর জীবদ্দশায় এতটা বিখ্যাত হতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষা বোধ, শব্দ চয়ন তাঁকে মানুষের মনের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তাঁর মৌলিকত্ব ও আধুনিক প্রকাশভঙ্গি জন ডানের নামকে ইংরেজি সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল করে রেখেছে।
.jpeg)